ইমাম আবু হানিফা (রহ.) : জীবন ও কর্ম
---
মাওলানা মিরাজ রহমান
যে মহামনীষীগণ ইসলামের বিধান সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে তা অন্যান্য মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য আজীবন আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন তন্মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন অন্যতম। কুরআন হাদিস গবেষণা তথা ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাকে সমকালীন যুগে ফকীহদের সর্দার বলে গণ্য করা হত। এছাড়া তিনি ইরাকের কুফা নগরীর ‘মুফতী’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ইলমী ময়দানে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক। আজো তিনি ইমাম আজম নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন এবং প্রসিদ্ধ চার ইমামের মাঝে তাঁকেই শ্রেষ্ঠ ইমাম হিসেবে অভিহিত করা হয়।
জন্ম ও নামকরণ : ইমাম আবু হানিফা ইরাকের কুফায় ৫ সেপ্টেম্বর ৬৯৯ ইংরেজী মোতাবেক ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) -এর আসল নাম নুমান ইবনে সাবেত ইবনে যূতি। আবু হানিফা তার কুনিয়্যাত বা ডাকনাম। পরবর্তী যুগে তিনি ইমাম আবু হানিফা নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। বিশ্ববাসী তাকে আবু হানিফা নামেই বেশী চেনে। (মুসলিম মণীষা, আবদুল মওদুদ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা)
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) একজন তাবেয়ী ছিলেন : মূলত সাহাবী আনাস ইবনে মালিক (রা.) -এর সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার কারনে ইমাম আবু হানিফাকে (রহ.) তাবেয়ী বলা হয়ে থাকে। তখন পৃথিবীতে অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আল হারিছ (রা.); [মৃত্যু: ৮৫ হিজরি]; হজরত ওয়াছিলা ইবনে আল আস কাআ (রা.) [মৃত্যু: ৮৫ হিজরি]; হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (রা.) [মৃত্যু: ৮৭ হিজরি]; হজরত সাআল ইবনে সায়াদ (রা.) [মৃত্যু: ৯১ হিজরি]; হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) [মৃত্যু: ৯৩ হিজরি]; হজরত মাহমুদ ইবনে লবিদ আল আশহালি (রা.) [মৃত্যু: ৯৬ হিজরি]; হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইউছর আল মাজানী (রা.) [মৃত্যু: ৯৬ হিজরি]; হজরত মাহমুদ ইবনে আরবাবি আল আনসারী (রা.) [মৃত্যু: ৯৯ হিজরি]; হজরত আল হারমাম ইবনে জিয়াদ আল বাহিলী (রা.) [মৃত্যু: ১০২ হিজরি] এবং হজরত আবু আল তোফায়েল আমীর ইবনে ওয়াছিলা আল কিনানী (রা.) [মৃত্যু: ১০২ হিজরি] -এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এদের সকলের না হলেও সাত জনের সাক্ষাত লাভ করেছিলেন এবং তিন জনের কাছে থেকে ইলমে দাহিসের দরস হাসিল করেছিলেন। সুতরাং তিনি তাবেয়ী। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)
বংশ পরিচয় : ইমাম আবু হানিফার (রহ.) দাদা যুতি ছিলেন ফারিসের অধিবাসী । তিনি ছিলেন অগ্নি উপাসক । ৩৬ হিজরিতে তিনি ইসলাম গ্রহন করেন এবং স্ত্রীকে নিয়ে হিজরত করে মক্কা চলে আসেন। কুফায় পৌঁছে তিনি হজরত আলীর (রা.) সান্নিধ্য লাভ করেন এবং সেখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন । এরপর তিনি কাপড়ের ব্যবসা দ্বারা জীবিকা নির্বাহের ব্যাবস্থা করেন। একবার নওরোজের সময় তিনি কিছু ফালুদা হজরত আলীকে (রা.) উপহার দিলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, এ কি জিনিস? তিনি বলেন, নওরোজের ফালুদা। ৪০ হিজরিতে যুতির এক পুত্র জন্মগ্রহন করেন। নাম রাখেন ছাবিত । বরকতের জন্য তাঁকে হজরত আলীর (রা.) কাছে নিয়ে এলে- তিনি শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেন। ছবিতের ৪০ বছর বয়সে ৮০ হিজরিতে তাঁর ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহনকরে । এই সময় উমাইয়া শাসক আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান মুসলিম জাহানের শাসনকর্তা ছিলেন। জনক জননী আদর করে নাম রাখেন নুমান। ইনিই বিশ্ববিখ্যাত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)
প্রাথমিক জীবন বা ব্যবসায়িক জীবন : ইমাম আবু হানিফার (রহ.) প্রাথমিক জীবন কেমন ছিল এ বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ বেশীকিছু উদ্ধৃত করেননি। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী। ইমাম আবু হানিফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমণ মুল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানী ও রফতানী হতো। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। তৎকালীন বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়া-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তাঁর নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। পিতা ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী । তাঁর মৃত্যুর পর এই ব্যাবসার দায়িত্ব নিতে হয় যুবক ইমাম আবু হানিফাকে। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)। তাঁর অসামান্য দক্ষতা ও নিষ্ঠায় ব্যাবসা প্রসারিত করার পাশাপাশি কাপড় তৈরির এক কারখানা স্থাপন করেন। যা কিছু দিনের মধ্যেই অনন্য হয়ে ওঠে। ব্যবসায় তার সততার পরিচয় পেয়ে দিগ্বিদিক থেকে লোকেরা তার দোকানে ভিড় জমাতেন। এভাবে তিনি জন মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করলেন। ইমাম শাবী (রহ.) তাকে ইলমের ব্যাপারে উৎসাহিত করার আগ পর্যন্ত তিনি এ ব্যবসাকেই নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। (উসুলুদ্দিন ইনদা আবি হানিফা, পৃষ্ঠা- ৬৬)
ব্যবসা জীবন থেকে শিক্ষা জীবনে পদার্পন : কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীক কাজেই তাঁকে বিভিন্ন বাজার ও বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শাবীর (রহ.) সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শাবী আবু হনীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি? ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শাবী (রহ.) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে? আবু হানিফা সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শাবী আবু হানিফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম আবু হানিফা বলেন, ইমাম শাবীর (রহ) সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। এ সময় আবু হানিফার (রহ.) বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)
শিক্ষা জীবনের সূচনা : প্রথমত- ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ‘কূফা’ শহরেই ইলমে কালাম ও ইলমে ফিকাহ শিক্ষা করেন।
অতঃপর কূফার শীর্ষস্থানীয় ফিকাহ শাস্ত্রবিদ হাম্মাদ (রহ.)-এর নিকট জ্ঞান আহরণ করতে থাকেন। তিনি দীর্ঘ আঠারো বছর ইমাম হাম্মাদের একান্ত সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জনে নিমগ্ন থাকেন। অতঃপর ১২০ হিজরীতে স্বীয় ওস্তাদ হজরত হাম্মাদ ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়। এ সময় তিনি উস্তাদের স্হলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রে কুফার ‘মাদ্রাসাতুর রায়’-এর পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন ৷ এরপর তিনি কুফা শহর থেকে সফর করে দীর্ঘ ছয়টি বছর মক্কা-মাদীনা অবস্থান করে সেখানকার সকল শাইখদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করেন।
হাদিসশাস্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ : ফিকাহ অধ্যায়নের এরপর তিনি হাদিস শিক্ষার জন্য তদানিন্তন হাদিস বেত্তাদের খিদমতে হাজির হন এবং শিক্ষা লাভ করেন। তখনও কোন প্রনিধান যোগ্য হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়নি। কোন একজন মুহাদ্দিস সকল হাদিসের হাফিজ ছিলেন না। প্রথমে তিনি কুফায় অবস্থানরত মুহাদ্দিসদের থেকে হাদিস শেখেন। এরপর তিন বসরা যান। সেখানে হজরত কাতাদাহ (রহ.)-এর খিদমতে হাজির হন এবং হাদিসের দরস হাসিল করেন। তারপর ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হজরত শুবা (রহ.)-এর দরসে যোগ দেন। তাঁকে হাদিস শাস্ত্রে ‘আমিরুল মুমিনিন’ বলা হয়। কুফা ও বসরার পর ইমাম আবু হানিফা হারামাইন শরিফাইন এর দিকে দৃষ্টিপাত করেন । প্রথমে তিনি মক্কা গেলেন এবং সেখানে তিনি হাদিসবিদ হজরত আতা ইবনে আবু রিবাহ (রহ.) -এর দরবারে যান এবং দরসে শামিল হয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। ১১৫ হিজরিতে আতা (রহ.) ইন্তেকাল করলে তিনি মক্কায় চলে আসেন এবং হজরত ইকরামা (রহ.) -এর কাছ থেকেও হাদিসের সনদ লাভ করেন। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)
ফিকাহশাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফার (রহ.) অবদান : যুক্তিবিদ্যাসহ অন্যান্য বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞানে গুণান্বিত হওয়ার পাশাপাশি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধানের উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ইমাম শাবী (রহ.) -এর অনুপ্রেরণায় আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক তাওফিক প্রাপ্ত হওয়ার পর তিনি ফিক্বহের জগতে পদার্পন করেন। ইলমে দ্বীন শিক্ষার্জনের মানসে বিভিন্ন মুহাদ্দিস ও ফকীহদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। ফিকহের উপর তার এত আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল যে, তিনি হাম্মাদ ইবনে আবি সুলায়মান (রহ.) এর সান্নিধ্যে সুদীর্ঘ্য ১৮ টি বছর ইলমে দ্বীন শিক্ষার্জনে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। কুরআন হাদিস গবেষণা তথা ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাকে সমকালীন যুগে ফকীহদের সর্দার বলে গণ্য করা হত। এছাড়া তিনি ইরাকের কুফা নগরীর ‘মুফতী’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ইলমী ময়দানে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক। আজো তিনি ইমাম আজম নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন এবং প্রসিদ্ধ চার ইমামের মাঝে তাঁকেই শ্রেষ্ঠ ইমাম হিসেবে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে ইরাক, চীন, ভারত, পাকিস্তান,বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ নিজেদের জীবনচলার পথে উদ্ভুত সমস্যার সমাধানে ইসলামের দিকনির্দেশনা হিসেবে তার মাজহাবকে মেনে চলেন।এমনকি উসমানী সাম্রাজ্যের অন্তর্গত এলাকাসমুহে আবু হানিফা (রহ.)-এর মাজহাবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হত। (উসুলুদ্দিন ইনদা আবি হানিফা-৯৯)
ইমাম আবু হানিফার হজব্রত পালন : ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তিনি ৫৫ বার পবিত্র হাজ্জব্রত পালন করেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় (উকূদুল জামান, পৃ- ২২০) । প্রত্যেক সফরেই তিনি মক্কা- মাদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত উলামা, মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসিনের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। (আল জাওয়াহিরুল মযিয়াহ, খণ্ড- ২, পৃ- ৪৭৩)।
চারিত্রিক বর্ণনা-গুণাবলী : তিনি ছিলেন আপোষহীন ব্যাক্তিত্ব। নীতির জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কুফার উমাইয়া গভর্নর ইয়াজিদ ইবনে আমর ইবনে হুবায়রা এবং পরে আব্বাসি খলিফা মানসুর তাঁকে প্রধান কাজির পদ দান করলে তিনি তা দৃঢ় তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। এই কারণে তাঁকে দৈহিক শাস্তি ও কারাদণ্ড ভোগ করতে হয় এবং অবশেষে বিষ পানে প্রান ত্যাগ করতে হয়। তিনি নির্যাতন ভোগ করেছেন কারাগারে জীবন কাটিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত মজলুম অবস্থায় দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। তবুও তিনি নীতির প্রশ্নে আপোষ করেন নি । (আখবারু আবি হানিফা ওয়া আসহাবিহি-৬৬)
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রচিত গ্রন্থাবলী : ইমাম আবু হানিফা (রহ.) -এর বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন । তার রচিত গ্রন্থের অধিকাংশই পৃথিবীর বিভিন্ন মিউজিয়ামে ও গ্রন্থাগারে পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। কয়েকটি মুদ্রিত হয়েছে। কয়েকটির একাধিক শরাহ রচিত হয়েছে । এখানে তাররিচিত ২০টি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো- ১. আল-ফিকাহুল আকবর। ২. আল-ফিকাহুল আবসাত। ৩. কিতাব আল আলিম অয়াল মুতাআল্লিম। ৪. আল-অসিয়া। ৫. আর-রিসালা। ৬. মুসনাদ আবু হানিফা। ৭. অসিয়া ইলা ইবনিহি হাম্মাদ। ৮. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি ইউসুফ ইবনে খালিদ। ৯. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি আল কাজী আবি ইউসুফ। ১০. রিসালা ইলা উসমান আল বাত্তি। ১১. আল কাসিদা আল কাফিয়া (আননুমানিয়া)। ১২. মুজাদালা লি আহাদিদ দাহ রিন। ১৩. মারিফাতুল মাজাহিব। ১৪. আল জাওয়াবিত আস সালাসা। ১৫. রিসালা ফিল ফারাইয। ১৬. দুআউ আবি হানিফা। ১৭. মুখাতাবাতু আবি হানিফা মাআ জাফর ইবনে মুহাম্মদ। ১৮. বাআজ ফতোয়া আবি হানিফা। ১৯. কিতাবের মাক সুদ ফিস সারফ। ২০. কিতাবু মাখারিজ ফিল হিয়াল।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে আলেমদের অভিমত : ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর প্রশংসা নিয়ে জগৎবিখ্যাত ওলামায়ে কেরামদের বেশকিছু বক্তব্য পাওয়া যায়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের বক্তব্য উল্লেখ করা হলো- ১. ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেছেন, ফিক্বহের ব্যাপারে মানবজাতি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর পরিবারভুক্ত। ২. ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন (রহ.) বলেন, তিনি হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ ব্যক্তি ছিলেন; আমি কাউকে শুনিনি তাকে দুর্বল বলতে। ৩. আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন, তিনি ইলম, তাকওয়া, যুহদ ও আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয়ায় ছিলেন অতুলনীয়। ৪. তার ইন্তিকালের সংবাদ শুনে শুবা ইবনে হাজ্জাজ আল আতকী (রহ.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) -এর সাথে কুফার ফিক্বহ চলে গেল। আল্লাহ তায়ালা তার এবং আমাদের উপর রহমত করুন। ৫. ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, যদিও কিছু বিষয়ে লোকেরা ইমাম আবু হানিফা (রহ.) -এর বিরোধিতা করে থাকে এবং তার সিদ্ধান্ত দেয়া বিষয়গুলোকে প্রত্যাখ্যান করে তবে, কেউ কখনো তার জ্ঞান-গরিমা, বুঝ শক্তি নিয়ে সন্দেহ করেনি।
মৃত্যু : ১৫ রজব ১৫০ হিজরি ৭৬৭ খ্রিস্তাব্দে তিনি কারাগারে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদের কাজী হাসান ইবনে আম্মারাহ তাঁর গোসল দেন ও কাফন পরান। জোহরের পর তাঁর প্রথম নামাজে জানাজাহ অনুষ্ঠিত হয়। অগণিত লোক এতে শরিক হয়। পড়ে আসর পর্যন্ত আরও ছয় বার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় এবং আসরের নামাজের পর তাঁর অয়াসিয়ত অনুযায়ী খায়জরান কবরস্থানে দাফন করা হয়। দাফনের পর ২০ দিন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মানুষ কবরে তাঁর জানাজার নামাজ আদায় করেন।