মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো আর নেই
কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো মারা গেছেন। শনিবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাতে এ তথ্য জানা যায়। পৃথিবীর কোন কোণে যদি আজ থেকে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত একজনও সাম্যবাদী চেতনার মানুষ অবশিষ্ট থাকে তাঁর কাছে তিনি ফিদেল ক্যাস্ত্রো। এমন আদর্শ যিনি জমকালো সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রে থেকেও আটচল্লিশ বছর ধরে গড়েছেন সাম্যবাদী কিউবা।
জমকালোই বটে, কারণ যখন তাঁর জন্ম তখন কিউবা শাসন করছিল আমেরিকান কোম্পানিগুলো। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মের সুবাদে কখনো কষ্ট পেতে হয়নি তাঁকে। তবুও তাঁকে নাড়া দিতো তৎকালীন শ্রমিকদের জীবন। সেইসব শ্রমিক যাঁরা দিনের পর দিন খামারে মরণপণ পরিশ্রম করেও খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান কিছুরই নিশ্চয়তা পেতোনা। তিনি সাম্যবাদের নায়ক। কিউবার অধিনায়ক ফিদেল ক্যাস্ত্রো।
১৯২৬ সালের ১৩ই আগস্ট জন্মানো স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত কিউবার পাগলাটে ছেলেটিকে খুব ছোটবেলা থেকে জয়ের নেশায় পেয়ে বসেছিলো। স্কুল জীবনে মাত্র ৫ ডলারের জন্য দেয়ালে বাইক ঠুকে দিয়ে হাসপাতালের বিছানায় বিজয়োল্লাস করার মত দুঃসাহস কেবল তিনিই রাখেন।
বাস্কেটবলে অসম্ভব ভালো খেলোয়াড় ও তুখোড় মেধাবী ফিদেল চাইলেই অনেক নির্ভার জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু পাগলাটে স্বভাব আর মানবিকতা তাঁর কপালে কখনো সেটি জুটোয়নি। প্রচ- মেধার জোরে তিনি হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে লেখাপড়া শেষ করেছিলেন। বস্তুত হাভানা ইউনিভার্সিটিতেই তাঁর রাজনীতির প্রথম পাঠ শুরু হয়। সে সময়ের হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতা ম্যাক্স লেসনিকের ভাষায়, ক্যাস্ত্রো রাজনীতির নতুন দিগন্ত। ক্যাস্ত্রো সম্পর্কে এক বর্ণনায় তিনি বলেন, প্রচুর কথা বলতেন ক্যাস্ত্রো। সবটা সময় কিউবার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতেন।
যুবক বয়সে তিনি সংসারীও হতে চেয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে বিয়ে করেছিলেন। মারিতা বেলার্তোকে বিয়ে করে পেশাদার আইনজীবী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নিজের মানবিকতার কারণে পুঁজিবাদী আচরণ করতে পারেননি। গরীব কৃষকদের বিনা পয়সায় মামলা লড়ে দিতে দিতে নিজের সংসারের দিকেই তাকাতে পারেননি। ছোট্ট একটি বাসায় মারিতা ও একমাত্র সন্তান ফিদেলিতোকে নিয়ে বসবাস করতেন। সে বাসায় বিল পরিশোধ করতে না পারায় বহুবার বিদ্যুত সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়।
১৯৫২ এর নির্বাচনই ক্যাস্ত্রোর জীবনকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। নির্বাচনে তৎকালীন কিউবার বাম রাজনৈতিক দল ‘অর্থডক্সো’ থেকে হাভানার সবচাইতে গরীব অঞ্চলের মনোনয়ন পেয়ে প্রচারণা শুরু করেন। যদিও তিনি রাষ্ট্রপতি পদেই মনোনয়ন চেয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। নির্বাচনের কিছুদিন আগে সামরিক স্বৈরাচারী ফুলহেনসিও বাতিস্তা জোরপূর্বক ক্ষমতার কব্জা নিলে তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘বাতিস্তা যদি শক্তি দিয়ে ক্ষমতা দখল করে, তাহলে তাকে শক্তি দিয়েই উৎখাত করতে হবে।’
এই আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়েই ক্যাস্ত্রোর বিপ্লবী যাত্রা শুরু হয়। এই পর্বেও দেখা যায় সেই তরুণ ডানপিটে ক্যাস্ত্রোকে। ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ের ২৬ তারিখ মাত্র ১০০’র মতো প্রশিক্ষণহীন বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে বসেন বাতিস্তার সবচাইতে বড় সামরিক ঘাঁটিগুলোর একটা ‘মনকারা’ সামরিক ব্যারাকে। বাতিস্তা বাহিনী সেই আক্রমণে ক্যাস্ত্রোর ৫৬ জন সহযোদ্ধাকে আটক করে নির্দয়ভাবে খুন করে। ক্যাস্ত্রো ও তাঁর ভাই রাউল পালিয়ে গেলেও পরে তাদের আটক করে ১৫ বছরের কারাদ- দেয়া হয়। অনেকে এই আক্রমণকে পাগলামী বলে ধরে নিলেও এই আক্রমণের ফলে জনসমর্থন ক্যাস্ত্রোর দিকে ঝুঁকতে থাকে। ১৯৫৫ সালে বিশ্ব মা দিবসে দুই ক্যাস্ত্রো ভাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় বাতিস্তা।
এর পরের ঘটনা সবারই জানা। মেক্সিকো থেকে ৮২ জন সৈন্য নিয়ে কিউবার পথে যাত্রা। ভুল জায়গায় পৌঁছে বাতিস্তার বিমানবাহিনীর এবং পরবর্তিতে স্থলবাহিনীর আক্রমণে ৮২ জনের বাহিনী ছোট হয়ে ১৭ জনের হয়ে যাওয়া। এসব ইতিহাস সবারই জানা।
কিন্তু সেদিন রাউলকে কি বলেছিলেন ক্যাস্ত্রো? এই বাক্যটি যুগে যুগে সকল বিপ্লবীর অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। সেদিন রাউলকে ডেকে ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, কতটা রাইফেল আনতে পেরেছো? রাউল পাঁচটির কথা বললে তিনি বলেন, আমাদের দুইজনের কাছে দুটো আছে, সবমিলিয়ে সাতটা। তার মানে আমরা যুদ্ধে জিতে গেছি। হ্যাঁ, তিনি যুদ্ধে জিতেছেন। হয়তো পুনরায় সংগঠিত হতে সময় লেগেছে, কিন্তু তিনি ঠিকই জিতেছেন। তিনি ঠিকই বাতিস্তাকে অস্ত্রের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন।
আসলে জেতাটা ছিলো ক্যাস্ত্রোর জন্য বিপ্লবের শুরু। একে একে তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন দেখেছেন ১০টি মার্কিন সরকার। চোরাগোপ্তা হামলা থেকে বেঁচেছেন অসংখ্য বার। সিআইএ বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করলেও তাঁকে হত্যা করতে পারেননি।
আমেরিকাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ৪৮টি বছর। যেখানে মার্কিন সহায়তা বন্ধের ভয়ে আজকাল উন্নয়নশীল দেশগুলো সবসময় ভয়ে থাকে। সেখানে তিনি কিউবার হয়ে কাজ না করার অপরাধে সে সময়ে সকল মার্কিন প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রায়ত্ব করেছিলেন। সারাবিশ্বে পরমাণু যুদ্ধের মহড়া সৃষ্টি করেছিলেন। বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছিলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ক্যাস্ত্রো ছিলেন এমনই আক্রমণাত্মক।
আজ আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে। আমরা অপরাধীকে আপিলের সুযোগ দিয়েছি। ক্যাস্ত্রো আদেশ দিয়েছিলেন সকল যুদ্ধাপরাধীদের জনসমক্ষে খুন করার। তাঁর আদেশ বাস্তবায়ন করেন রাউল ও চে। হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধীকে জনসমক্ষে খুন করা হয় তখন। কিছু কিছু হত্যার ভিডিওচিত্র এখনও আছে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ক্যাস্ত্রো তখন জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও শত্রুর প্রতি এমন নমনীয় আচরণ করা হয়নি। আমার সৈন্য দ্বারা একজন মানুষও নির্যাতিত হয়নি।’ এই একটি বাক্য থেকে অনেক কিছু শেখার আছে এখন আমাদের।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন তবে কি এই মহান নেতা মিথ্যা বলেছিলেন? না তিনি মিথ্যা বলেননি। তিনি সত্যই বলেছেন। আপন দেশে থেকে যারা দেশবিরোধী কাজ করে, তাদের মানুষ হিসেবে দেখেননি ক্যাস্ত্রো। তাদের হায়েনা হিসেবেই দেখেছেন তিনি। আর হায়েনাদের উপযুক্ত শাস্তিই তিনি দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি কখনো অনুতাপও করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, একবারের দালাল চিরজীবনের দালাল। এজন্যই কখনো দালাল ধরা পড়লেই তার শাস্তি ক্যাস্ত্রোর আদালতে মৃত্যুদ-ই ছিলো।
শেষ সময়ে এসে তাঁর প্রাপ্তি আর ভুলগুলো নিয়ে অনেকেই অনেক মত ব্যক্ত করতে পারেন। তিনি নিজেই অবশ্য বলেছিলেন, ‘আমার অনেক কাজ সঠিক হয়নি। আমার কাজগুলো আরো নিখুঁত হতে পারতো। তবুও আরেকবার যদি সুযোগ পাওয়া যেত তাহলেও আমি এই বিপ্লবের পথকেই বেছে নিতাম।’
তাঁর কীর্তি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের অনেক ধরনের মতামত থাকতে পারে। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন ক্যাস্ত্রোর জনপ্রিয়তার কথা। শিক্ষা আর স্বাস্থ্যখাতে কিউবার উন্নতির কথাও অকপটে স্বীকার করেন মার্কিন এই সাবেক প্রেসিডেন্ট।
দিনের শেষে ক্যাস্ত্রোর নিজের বোনটিও তাঁর উপর থেকে সমর্থন সরিয়ে নিলেও তিনি প্রমাণ করেছেন তথাকথিত শাসন ব্যবস্থা কখনো সমাজে সাম্য আনতে পারে না। সেই কারণেই হয়তো তিনি কখনো তার প্রতিশ্র“ত নির্বাচনটি দেননি আজো। আসলে যে দেশের ক্যাস্ত্রোর মত নেতা রয়েছে, সে দেশে নির্বাচনের দরকারও হয় না। তিনিই কিউবাকে আদর্শ করে সকল উন্নয়নশীল দেশকে শিখিয়েছেন কি করে পরাশক্তিকে কাবু করতে হয়। তিনিই সকল রাষ্ট্রনায়ককে শিখিয়েছেন রাষ্ট্রক্ষমতায় অবতীর্ণ হয়েও ‘বে অব পিগ’ এ নিজেকেই অবতীর্ণ হতে হয় মাতৃভূমির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে। তিনিই শিখিয়েছেন, রাষ্ট্র যত ছোটই হোক না কেন নেতৃত্বই প্রমাণ করে কতটা শক্তিশালী। তাই পুরো লাতিন আমেরিকা জুড়েই ক্যাস্ত্রোরই প্রতিধ্বনি।