কত উদ্ভাবনই হচ্ছে প্রতিদিন। নানা রকম। বিচিত্র। তেমনই এক উদ্ভাবনের কথা মানবকণ্ঠের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
ছয়/সাত মাস আগে যে আইডিয়াটি মাথায় এসেছিল তা বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেল। আমার আওতাধীন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের জলমগ্ন ঘাগটিয়া গ্রামে প্রকল্পটি চালু করে দিলাম। প্রায় অর্ধশত ফ্লোটিং ল্যাট্রিন ইন্সটল করা হল। ব্যবহারও শুরু হয়ে গেছে। শিশুরা তো রীতিমত উৎসাহী। একটি আইডিয়া মাথায় এলে তা বাস্তবায়ন যে কতটা জটিল তা অনুভব করলাম। এটি স্যানিটেশনের সফটওয়্যার বেইজড কোন সমাধান নয়। এটি ভাসমান শৌচাগার। সাথে আছে জৈব সার তৈরির ব্যবস্থা। পরবর্তী ধাপে বায়োগ্যাসও তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিগগিরি বাস্তবায়ন হবে। উপজেলা ও উইনিয়ন পরিষদ গভর্ন্যান্স প্রজেক্ট সহায়তা দিয়েছে এতে। ফতেপুরের নবনির্বাচিত তরুণ চেয়ারম্যান রণজিৎ চৌধুরী রাজনকে স্পেশাল ধন্যবাদ সরাসরি মাঠে নেমে সহায়তা প্রদানের জন্য। ঘাগটিয়ার গ্রামবাসীও আশাতীত সহায়তা করেছেন। আগে যা ডিজাইন করেছিলাম, তা কিছুটা মডিফাই করা হয়েছে। তিন ড্রামের স্থলে পাঁচ ড্রাম লাগানো হয়েছে। এতে ফ্লোটিং স্ট্যাবিলিটি বেড়েছে। সবাই ইউজ করতে পারছে।
সাত মাস আগে আইডিয়াটা মাথায় আসে এইভাবে: বিশ্বম্ভরপুরে এসেই বুঝলাম বড্ড বিচিত্র এই মুলুক, বিচিত্র এ এলাকার ভূপ্রকৃতি। মেঘালয়ের ধার ঘেঁষে থাকা এই নিম্নাঞ্চলের হাওরবেষ্টিত বিশাল এলাকা আগাম বর্ষার পানিতে বছরের প্রায় ছয় মাস থাকে নিমজ্জিত। একেবারে মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত। বসতগুলো একটু উঁচু জায়গায় থাকায় শুধু সেটুকুই জেগে থাকে সাগরে জেগে ওঠা পাহাড়চূড়ার মত; চারপাশটা পানিতে ডুবে থাকে। এই ছয় মাস এই এলাকায় স্যানিটেশন বলে কিছুই থাকে না। খেয়াল করলাম, এসময় তাদের শৌচাগারগুলোও পানির নিচে তলিয়ে যায় এবং তারা খোলাখুলিভাবে উন্মুক্ত জলাশয়েই শৌচক্রিয়া (Open Defecation) সম্পাদন করে সেই জলাশয়ের দূষিত পানি একই সাথে দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ এমনকি রান্নার কাজেও ব্যবহার করে। বছরের ওই বিশাল সময়টুকুতে তারা স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থাকে। ফলে ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা ব্যাপকভাবে বিস্তারের সাথে সাথে ওই এলাকার অধিবাসীদের খাদ্য থেকে পুষ্টি আহরণের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় কেননা দূষিত পানি পানের ফলে মলের তারল্য স্বাভাবিকের থেকে বৃদ্ধি পায় যা খাদ্য থেকে পুষ্টি সংগ্রহের ব্যর্থতা নির্দেশ করে। অন্ত্রে খাদ্যের পুষ্টি ভালভাবে শোষিত হলে মল পানিতে অনেকক্ষণ সলিড অবস্থায় ভাসতে থাকে, কিন্তু এই এলাকার মানুষের অপাচ্য পুষ্টিময় মল পানিতে দ্রুত দ্রবীভূত হয়ে যায়। ফলে দীর্ঘমেয়াদী পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত হয়ে ওই সব এলাকার শিশুরা দুর্বল মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। বাংলাদেশ স্যানিটেশনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও এই অঞ্চলের বিশাল জনপদ বছরের উল্লেখযোগ্য সময় সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একবার উপজেলা এনজিও কমিটির মাসিক সভায় বিষয়টা আলোচনা হল। আমি প্রস্তাব করলাম, আমি কি একটা স্বল্পমূল্যের ভাসমান শৌচাগারের ডিজাইন করে দিতে পারি? সবাই সাধুবাদ জানাল। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা দাঁড়াল বিশাল; কোন ফান্ড পাওয়া যাবে না, গেলেও খুবই নগণ্য। বুয়েটের সিভিল ডিপার্টমেন্টের ভাই-বোনেরা ব্র্যাকে যে ডিজাইন জমা দিয়েছে, তা বেশ ব্যয়বহুল, একেকটা বানাতে ৫০-৬০ হাজারের কম ব্যয় হবে না, আর জমে থাকা বর্জ্য নিষ্কাশনে আলাদা ট্রান্সপোর্ট লাগবে। কিন্তু সেই রাতেই হঠাৎ একটা বুদ্ধি চলে এল মাথায়!
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সংলগ্ন ধোপাজান ও চলতি নদীতে বিপুল সংখ্যক অবৈধ বালু-পাথর উত্তোলনকারী বোমা মেশিন দ্বারা অনুমোদন ছাড়াই বালু-পাথর উত্তোলন করে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছে। ওই বোমা মেশিনগুলো বিশেষ ধরণের শক্তিশালি পাম্পবিশেষ যা নদীর ওপর সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ১৬-২০ টি স্টিল ড্রামের প্ল্যাটফর্মের ওপর বসানো থাকে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক ধোপাজান ও চলতি নদীতে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত বোমা মেশিনবিরোধী অভিযান পরিচালনার সময় প্রচুর ড্রাম, ঝাঁঝরি, পাম্প, ডিজেল ইঞ্জিন প্রভৃতি জব্দ করতে হয়। ড্রামগুলো দুর্বৃত্তরা বেশ ভাল কোয়ালিটির বাছাই করে, মজবুত, টেকসই, পানিতেও ৫-৬ বছরেও লীক হয় না। এমন ড্রাম নদীতে ভাসছে প্রায় ৫০০০। এগুলো আমরা আগে ওখানেই ফেলে আসতাম, কেননা আনার ঝক্কি কম নয়। তবুও বিভিন্ন সময়ে অনেক ড্রাম জব্দ হয়ে আমার অফিসের উঠানে বেকার পড়ে আছে আজ অব্দি। আমার উদ্ভাবিত শৌচাগারটির মূল উপাদান হল এই ড্রাম। এটি খুবই সাধারণ ডিজাইনে নির্মিত যা যে কেউ খুব স্বল্প সময় ও খরচে বানিয়ে ফেলতে পারে। এর উপাদানগুলো খুবই সহজে জোগাড় করা যায় যার সব ক’টাই পাওয়া যায় ওই অভিযানে জব্দ করা মালামাল থেকে; যেমন: পলিমার দড়ি, বাঁশ, ড্রাম। মূলত তিনটি খালি তেলের ড্রামের ওপর শৌচাগারটি স্থাপিত যার মাঝের ড্রামটি সেপ্টিক ট্যাঙ্ক বা Cesspool হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ড্রাম তিনটি পাশাপাশি রেখে আড়াআড়ি চারটি বাঁশ ওপর নিচে দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। মাঝের ড্রামের ওপরের ষ্টীল প্লাস্টিক টয়লেট প্যানের মাপে কেটে ফেলতে হয়, এই প্যানের দাম মাত্র ২৫ টাকা। তারপর গুজনেকসহ (দুর্গন্ধ প্রতিরোধক) প্যানটি স্থাপন করতে হয়। প্যানের দু’পাশে ইট/কাঠের পাদানি স্থাপন করা হয়। দু’পাশের খালি ড্রাম দুটি পুরো সিস্টেমটিকে ভাসিয়ে রাখে। এরপর ছাদ ও পর্দার উদ্দেশে চিত্রের মত করে প্লাস্টিকের ব্যাগের ছাউনি দেয়া হয়। এই ছাউনিটুকুই শুধু মোবাইল কোর্টের অভিযানে পাওয়া যায় না। মাত্র ২০০-২৫০ টাকায় তৈরি হয়ে যায় একটি সম্পূর্ণ ভাসমান শৌচাগার।
মাঝখানে অবস্থিত মাঝারি আকারের একটি ড্রাম প্রায় ২০০ লিটার আয়তন বিশিষ্ট। ড্রামটির ভেতরে গুজনেক-বিশিষ্ট প্লাস্টিক প্যানটি প্রবেশের ফলে এটি ১৬০ লিটার আয়তনের বর্জ্য ধারণ করতে পারবে। তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবার প্রতিবার শৌচক্রিয়ায় এক/ দেড় লিটার করে পানি ব্যবহার করলে ১০/১৫ দিনের মধ্যে তা পূর্ণ হয়ে যাবে। তারপর পূর্ণ শৌচাগারটি নৌকার সাথে বেঁধে পানিতে ভেলার মত ভাসিয়ে নিকটবর্তী ডাঙ্গায় নিয়ে পাম্পিং করে বের করে তা অত্যন্ত উর্বর জৈবসার প্রস্তুতির কাজে ব্যবহার করা যাবে। মানববর্জ্য থেকে সার উৎপাদনে আগ্রহী এনজিও (যেমন: প্রাক্টিক্যাল অ্যাকশান বাংলাদেশ) ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে মানববর্জ্য থেকে সার উৎপাদন শুরু করেছে। এখানেও তারা এবং আরো কয়েকটি এনজিও এই ব্যাপারে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশ্বম্ভরপুরে প্রথমে ফতেপুর ও দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নে এটি পাইলটিং করা হবে এবং সুবিধাজনক কয়েকটি স্থানে জৈব সার তৈরির ডাম্পিং স্টেশন বানানো হবে। যে পরিমাণ ড্রাম এখন নদীতে আছে, তা দিয়ে অন্তত দেড় হাজার পরিবারে স্যানিটেশন সুবিধা প্রদান করা সম্ভব। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল হাওরাঞ্চলের মানুষের বর্ষাকালীন সময়ে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি হবে যা তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
manobkantha.com