g ইতিহাসের পাঠশালায় প্রাচীন যুগ (প্রথম পর্ব) | AmaderBrahmanbaria.Com – আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া

বুধবার, ১৮ই অক্টোবর, ২০১৭ ইং ৩রা কার্তিক, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

ইতিহাসের পাঠশালায় প্রাচীন যুগ (প্রথম পর্ব)

AmaderBrahmanbaria.COM
ডিসেম্বর ৯, ২০১৫

---

১. পাথর যখন কথা কয় : তখন ১৭৯৯ সাল! মিসরের ‘রোজেটা’ বা রশীদ নামের জায়গায় তাবু গেড়েছে সম্রাট নেপোলিয়নের সৈন্যরা। এখানে পরিখা খনন করতে যেয়ে তারা হঠাৎ পেয়ে যায় কালো ব্যাসল্টের এক প্রকান্ড পাথর! পাথরের মসৃন পাশে বিভিন্ন প্রাচীন লিপি আঁকা।

সৈন্যবাহিনীর প্রকৌশলী বোর্সাদ ইতোমধ্যে প্রাচীন মিশরের দুর্বোধ্য লিপির ব্যাপারে খুবই কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলেন। তাই পাথরের গায়ে আঁকা লিপিগুলোর অর্থ উদ্ধারে তিনি উঠে পড়ে লেগে গেলেন। কিন্তু কাজটা খুব সহজ ছিল না। তিনি দেখলেন পাথরের গাঁয়ে তিনটি ধাপে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লেখা হয়েছে। প্রথম ধাপে মিসরের সেই পুরনো ছবি আঁকা হায়ারোগ্লিফিক লিপি। দ্বিতীয় ধাপে ছিল পরবর্তীকালের ডেমোটিক লিপি এবং শেষ ধাপে মিসরে টলেমিদের শাসনের সময়কার গ্রিক লিপি। রোজেটায় পাওয়া গিয়েছিল বলে পাথরটির নাম হয়ে যায় রোজেটা পাথর।

বোর্সাদ পাথরটি পাঠিয়ে দেন স্বয়ং নেপোলিয়নের কাছে। নেপোলিয়ন ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সাথে নিলেন। তিনি পাথরটির অনেকগুলো নিখুঁত ছবি করিয়ে সেগুলো পাঠিয়ে দেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা পন্ডিতদের কাছে। শেষ দুই ধাপের অর্থ পাওয়া গেলেও প্রথম ধাপটির অর্থ উদ্ধার করা খুবই মুশকিল ছিল। অবশেষে দীর্ঘ চৌদ্দ বছর গবেষণার পর ফ্রান্সের বহু ভাষাবিদ জ্যাঁ ফ্রাঁসোয়া শ্যাম্পোলিয়র সাধনা সফল হল। শেষ দুই ধাপের সাথে মিলিয়ে তিনি প্রথম ধাপটির ভাষা ফোটাতে সফল হলেন। কথা বলে উঠল রোজেটা পাথর।

রোজেটা পাথরের সূত্র ধরেই প্রাচীন মিসরের হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়। আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে মিসরে এ লিপিতে লেখা শুরু হয়। রোজেটা পাথর লেখা হয়েছে অনেক পরে ১৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পঞ্চম টলেমি এতে হায়ারোগ্লিফিক ও ডেমোটিক লিপির পাশাপাশি গ্রিক ভাষাও ব্যবহার করেছিলেন। এতে লাভ হয়েছে পন্ডিতদের। গ্রিক ও ডেমোটিক লিপির সূত্র ধরেই প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক লিপির রহস্যের জট খোলা সম্ভব হয়। ফলে পৃথিবীবাসীর সামনে ভেসে ওঠে প্রাচীন মিসরের অনেক অজানা ইতিহাস। ‘হায়ারোগ্লিফিক’ নামটি গ্রিকদের দেওয়া। এর অর্থ হলো পবিত্র লিপি। এ পদ্ধতিতে ছোট ছোট প্র্রতীক চি‎হ্ন দিয়ে লেখা হত। মিসরীয়রা এ পদ্ধতিতে লেখার জন্য ৭৫০ টি চি‎হ্ন ব্যবহার করত। কাঠ, পাথর এবং প্যাপিরাসে এ পদ্ধতিতে লেখা হত। আমাদের হাতে যেসব হায়ারোগ্লিফিক লেখা রয়েছে তার অন্যতম উৎস হলো পিরামিডের ভেতর পাওয়া প্যাপিরাসের রোল। হায়ারোগ্লিফিক লিপির সূত্র ধরেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে প্রাচীন মিসরের অনেক অজানা ইতিহাস।

৫০০০ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কে মিসরের ইতিহাসে বলা হয় প্রাক রাজবংশীয় যুগ। এ সময় মিসর কতকগুলো ছোট ছোট নগররাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এগুলোকে বলা হত ‘নোম’। ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেনেস নামে এক রাজা সমগ্র মিসরকে একক রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসেন। দক্ষিণ মিসরের নেম্ফিস হয় রাজধানী। এভাবে মিসরে রাজবংশীয় যুগের সূচনা ঘটে। মিসরের রাজাদের উপাধী ছিল ফারাও। মোট ৩০টি রাজবংশ মিসর শাসন করেছে।

১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পশ্চিম এশিয়ার যাযাবর জাতি হাইকসসরা মিসর দখল করে নেয়। তাদের হাতে ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি বল্লম। এক সময় মিসরীয়রাও ব্রোঞ্জের বল্লম তৈরির পদ্ধতি শিখে ফেলল। এ অস্ত্র দিয়েই তারা বিদেশীদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। ১৫৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসরীয়রা আহমোজের নেতৃত্বে হাইকসসদের বিতাড়িত করে।

আহমোজের সময় থেকে মিসরে শুরু হয় মধ্য সাম্রাজ্য যুগ। এ সময় থেকে মিসরীয় সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটতে শুরু করে। এমনকি পশ্চিম এশীয় আর্য ও সেমেটিকদের অঞ্চলেও মিসরীয় প্রাধান্য বিস্তৃত হয়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তখন আর্য ও সেমেটিক ভাষাভাষী বিভিন্ন জাতির ছড়াছড়ি। এবার সেদিকেই দৃষ্টিপাত করা যাক।

ইতিহাসের প্রসঙ্গঁ আসলেই এশিয়া মাইনরের উত্তরের একটি অঞ্চল আমাদের দৃষ্টি কাঁড়ে। আজকের জর্জিয়া ও ককেশাস যে অঞ্চলে অবস্থিত সেই অঞ্চল জুড়ে সুদূর অতীতে ছিল এক বিশাল তৃণভূমি। তৃণভূমির আকর্ষণে সেখানে সুদূর অতীতকাল থেকেই ছিল মেষপালক জনগোষ্ঠির বসবাস। ভাষার দিক থেকে তারা ছিল দুটি অংশে বিভক্ত। দক্ষিণ দিকের জনগোষ্ঠি ছিল সেমেটিক ভাষাভাষী। আর উত্তরের জনগোষ্ঠি ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাকে আর্য ভাষা বলা হয়। এই আর্যভাষীরা ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে। তাদের একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্যেও গড়ে তুলেছিল বসতি। এদের মধ্যে অন্যতম হল হিট্টীয়রা।   

২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে হিট্টীয়রা ককেশাস থেকে চলে আসে তুরস্কে। ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে তারা তুরস্কে গড়ে তোলে হিট্টাইট নগরী। লোহার ব্যবহারের প্রচলন ঘটায় এরাই। লেখার কায়দা তারা শিখেছিল মেসোপটেমীয়দের কাছ থেকে। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরে অন্য ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠীর আক্রমণে পতন ঘটে হিট্টাইট রাষ্ট্রের।

সিরিয়ার উত্তরে আর্যদের আরেকটি গোষ্ঠী ছিল মিতানীয়রা। ঐতিহাসিক টয়েনবির মতে মিসর দখলকারী হাইকসসরাও ছিল আর্য। পারস্য সভ্যতাও গড়ে তোলেছিল আর্যদের একটি শাখা। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য একসময় এদের অধীনে চলে গিয়েছিল। অন্যদিকে সেমেটিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী যে সব অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলেছিল তার মধ্যে অন্যতম হল-

মেসোপটেমিয়া: মেসোপটেমিয়া শব্দের অর্থ হল দুই নদীর মধ্যবর্তী জায়গা। মেসোপটেমিয়ার বর্তমান অবস্থান ইরাকে। দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী হওয়ায় গ্রিক ভাষায় অঞ্চলটির নাম হয়েছে মেসোপটেমিয়া। এ অঞ্চলে কয়েকটি সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল। সর্বপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা সেমেটিক ভাষাভাষী ছিলনা। তবে পরবর্তী ব্যাবিলনীয় ও অ্যাসিরিয় সভ্যতা সেমেটিক ভাষাভাষী হলেও সুমেরীয় সংস্কৃতির উত্তরসূরী ছিল। তাই ইতিহাসবিদরা সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরিয় ও ক্যালদীয় সভ্যতাকে মেসোপটেমীয় সভ্যতা বলে সাধারণ নামকরণ করেছেন। সেমেটিকব্যাবিলনীয়রাই প্রথম সমগ্র মেসোপটেমিয়ায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৭৫০ সালের মধ্যে সমগ্র মেসোপটেমিয়া ব্যাবিলনের অধীনে এসে যায়।

ফিনিশিয়া:  ভূমধ্যসাগরের তীরে আজকের লেবাননে গড়ে উঠেছিল সেমেটিক ভাষাভাষী ফিনিশীয়দের রাষ্ট্র। জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইতিহাসে তাদের জুড়ি মেলা ভার। টায়ার ও সিডন ছিল তাদের বিখ্যাত বাণ্যিজ্য বন্দর। ওল্ড টেস্টামেন্টে এ দু’টি শহরের অধিবাসীদের কথা এসেছে। ইঞ্জিলে নবী যিসাসের এ দু’টি শহর সফরের কথা উল্লিখিত হয়েছে (ইঞ্জিল: মথি ১৫:২১)। আলেকজান্ডার টায়ার বন্দর ধ্বংসের পরে আলেকজান্দ্রিয়া সমুদ্র বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সভ্যতার ইতিহাসে ফিনিশীয়দের সবচেয়ে বড় অবদান হল বর্ণমালার উদ্ভাবন। তাদের ১২টি ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে সূচনা হয় আধুনিক বর্ণমালার। আমরা ইংরেজি ভাষায় যে ল্যাটিন বর্ণমালা ব্যবহার করি তা এসেছে ফিনিশীয় বর্ণমালা থেকে। ফিনিশীয় বর্ণমালার সাথে গ্রিকরা স্বরবর্ণ যুক্ত সম্পূর্ণ বর্ণমালা তৈরী করেছিল। আফ্রিকার উপকূলে ফিনিশীয়দের প্রতিষ্ঠিত দু’টি শহরের একটি ছিল কার্থেজ। এর অবস্থান ছিল সম্ভবত আজকের তিউনিসিয়ায়। এই কার্থেজিয়ানরা পরবর্তীতে রোমানদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্ধী রূপে পরিণত হয়েছিল।

ইরাম: আজকের সিরিয়ার তৎকালীন নাম ছিল ইরাম। ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা অনুসারে নোয়ার পুত্র শামের এক ছেলের নাম ছিল ইরাম (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খন্ড:১০:২২)। ইরামের বংশধরদের বলা হয় ইরামীয় এবং তাদের দেশের নাম ইরাম। তাদের রাজধানী ছিল দামেস্ক। ফিনিশীয়দের মত তাদের ভাষাও ছিল সেমেটিক ভাষা। সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপির বদলে তারা ফিনিশীয়দের বর্ণমালা ব্যবহার করত। ফলে লেখার ক্ষেত্রে তাদের ভাষার ব্যবহার ছিল সুবিধাজনক। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এ ভাষায় লেখার প্রচলন ঘটে। ব্যাবিলনীয় ও অ্যাসিরীয়দের মধ্যে এ ভাষার ব্যবহার জনপ্রিয় ছিল। এ ভাষার নাম ছিল আরামীয় ভাষা। মেসোপটেমিয়ার ক্যালদীয় সম্রাট নেবুচাদনেজারের সময়েও ব্যাবিলনে আরামীয় ভাষা প্রচলিত ছিল। এর পরবর্তী পারস্য সাম্রাজ্যের সরকারি ভাষা ছিল এটি। এমনকি প্রাচীন হিব্রু ভাষার ওপরেও প্রাধান্য বিস্তার করেছিল এ ভাষা। ওল্ড টেস্টামেন্টের দানিয়েল ও ইষ্রার পুস্তকের একাংশ লেখা হয়েছিল এ ভাষায়। যিসাসের সময়েও নাকি বনি-ইসরাইলরা এ ভাষায় কথা বলত (ইঞ্জিল: ইউহোন্না ২০:১৬)। হযরত ইসহাক ও ইয়াকুবের স্ত্রীরা ছিলেন ইরামীয় (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খন্ড:২৪ ও ২৮)।

এবারে ফেরা যাক আবারও মিসরের প্রসঙ্গে। আহমোজ যে রাজবংশের পত্তণ করেন তাকে বলা হয় অষ্টাদেশ রাজবংশ। এ রাজবংশের সময়েই মিসরীয় সভ্যতা সর্বাধিক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। ফারাও তৃতীয় থাতমোসের সময়ে (১৪৭৯-১৪৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মিসরীয় সাম্রাজ্যের সীমানা এশিয়ায় প্রবেশ করে পৌছে যায় মেসোপটেমিয়ার সীমানা পর্যন্ত। মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনীয় সভ্যতার তখন চলছে পড়ন্ত দশা। ব্যাবিলনীয় সম্রাট হাম্বুরাব্বির সময়কালের (১৭৯২-১৭৫০ খ্রি.পূ.) পরবর্তীতে মেসোপটেমিয়ায় অন্ধকার যুগ শুরু হয়। ফলে সে অঞ্চলে মিসরের কোন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল না। তৃতীয় আমেনহোতেপের (১৪১১-১৩৭৫ খ্রি.পূ.) সময়ে মিসরীয় সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির একেবারে শীর্ষে পৌছায়। তাঁর পরেই শুরু হয় পতনের ধারা। ১৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে বসেন চতুর্থ আমেনহোতেপ। এই চতুর্থ আমেনহোতেপ চিরায়ত মিসরীয় ধর্ম বর্জন করে একেশ্বরবাদ গ্রহণের কারণে ইতিহাসের সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তিত্বের একজনে পরিণত হয়েছেন। ধর্ম বদলের পরে নামও বদলে তিনি হয়েছিলেন আখেন আতেন। সাধারণত তিনি ইখনাটন নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন অষ্টাদশ রাজবংশের দশম ফারাও। ইখনাটনের ধর্ম বিপ্লব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।

 

তৃতীয় আমেনহোতেপের সময়ে হিট্টিয়, ব্যাবিলনীয় ও মিতানীয় রাজারা তাদের রাজ্য রক্ষার জন্য ফারাওদের সাথে সদ্ভাব রাখার একটা পথ বের করল। রাজ পরিবারের মেয়েদের তারা ফারাওদের অন্তঃপুরে পাঠিয়ে দিল। এ ঘটনার সূত্রের তৃতীয় আমেনহোতেপ মিতানির রাজা দশরথের মেয়ে তিয়েকে বিয়ে করেন। এই তিয়ের গর্ভজাত সন্তান হলেন ইখনাটন। মিতানীয়রা ছিল মিসরীয়দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভিন্নধর্মী আর্যগোষ্ঠী। তাই পিতা-মাতার আলাদা ভাষা-ধর্ম ও জাতীয়তা ইখনাটনের ভাবনায় নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

 


তবে তাঁর ধর্ম বিপ্লব সফল হয়নি। তাঁর পুত্র তুতেনখামেনের বাল্য বয়সে মৃত্যুর পরে আবারও পুরনো ধর্ম ফিরে আসে। অষ্টাদশ রাজবংশের শেষ পুরুষ তুতেনখামেন। তাঁকে নিয়ে যে রহস্য তৈরী হয়েছিল তা মাত্র কয়েক বছর আগে ২০০৮ সালে ভেদ করা সম্ভব হয়েছে।

দ্বিতীয় রামেসেসের সময়ে (১২৯২-১২২৫ খ্রি.পূ.) সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব উদ্ধারের চেষ্টা চলে। তাঁর সময়েই মুসার আবির্ভাব ঘটেছিল। তৃতীয় রামেসেসের (১১৯৮-১১৬৭ খ্রি.পূ.) সময়ে মিসরীয় সাম্রাজ্য আরও দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। এক সময়ে নুবিয়া আর লিবিয়ার সম্রাটরা মিসরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।

এক সময় মেসোপটেমিয়ায়ও অন্ধকার কেটে গিয়ে গড়ে ওঠে সেখানকার তৃতীয় সভ্যতা অ্যাসিরিয় সভ্যতা। ওল্ড টেস্টামেন্টের সূত্র থেকে জানা যায় অ্যাসিরিয় সম্রাটরাও মিসরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। অ্যাসিরিয়দের পতনের পরে মেসোপটেমিয়ায় গড়ে ওঠে ৪র্থ ও শেষ সভ্যতা ক্যালদীয় সভ্যতা। ক্যালদীয় সম্রাট নেবুচাদনেজার (৬০৪-৫৬১ খ্রি.পূ.) মিসর দখল করতে পারেন নি। তবে মিসরীয়দের হাত থেকে ইরাম (সিরিয়া) দখল করে তাদের তাড়িয়ে দেন।

৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যদের অন্যতম শাখা পারসীয়রা পূর্ব দিক থেকে এসে ক্যালদীয় সাম্রাজ্য দখল করে নিল। মিসরও বাদ গেলনা। গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে আমরা জানতে পারি যে, ৫২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস পুত্র ক্যাম্বিসেস মিসর দখল করে ব্যাপক লুন্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালান। এরপর তিনি মিসরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।


এক সময় পারস্য সাম্রাজ্যও পদানত হয় সেসিডোনীয় বীর আলেকজান্ডারের কাছে। ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি পারস্য সাম্রাজ্য দখলের পথে মিসরও দখল করে নেন। এর পরবর্তী ৩০০ বছর মিসরে চলে মেসিডোনীয়দের শাসন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজারের কাছে মিসর তার স্বতন্ত্র সত্ত্বা সম্পূর্ণভাবে হারায়। মিসর পরিণত হয় রোমান প্রদেশে। আরও বহুদিন পর মিসর চলে যায় ইসলামী খিলাফতের অধীনে।

মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাস মূলত শোষণ, অত্যাচার ও বিকৃত বিলাসীতার এক কুৎসিত কদাকার ইতিহাস। অন্যান্য সভ্যতার মতই এখানেও সমাজের ওপর তলায় বিপুল ঐশ্বর্য্যরে বন্যা আর নিচের তলায় হাহাকার আর কান্না। উৎপাদন প্রণালী ছিল সামন্ততন্ত্রী ধরণের। মিসর ছিল কৃষি জমিতে পরিপূর্ণ। ফারাও দেশের সমস্ত জমির মালিক। ফারাওয়ের অনুগত সামন্তদের হাতে থাকত বড় বড় জমিদারী। ভূমিদাস আর দাসরা এই সব জমিতে কাজ করত। ভূমিদাস ছাড়াও মুক্ত কৃষক মিসরে ছিল। উৎপন্ন ফসলের এক পঞ্চমাংশ তারা রাজকীয় শস্যাগারে কর হিসেবে জমা দিত।

এসবের পাশাপাশি ছিল ধর্ম ব্যবসায়ী মন্দির আর পুরোহিতদের সম্পত্তি। অত্যন্ত কুৎসিত এক ধর্ম এরা প্রচার করত যেখানে দৈববলে রাজা ও পুরোহিত শোষণের অধিকার পেয়ে যেত। পিরামিড ছিল এই বিকৃত ধর্মবিশ্বাসের ফসল। এগুলো ছিল ফারাওদের সমাধি।


ফারাওরা বিশ্বাস করত লাম্পট্য ও বিলাসিতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা আবার দেহ নিয়ে জেগে ওঠবে দেবতা ওসিরিসের রাজ্যে। তাই তাদের দেহকে নষ্ট হতে দেয়া চলেনা। তাই মমিকরণের মাধ্যমে দেহ সংরক্ষণের শেষে তাদেরকে লাম্পট্য ও বিলাসিতার বিপুল উপকরণসহ সমাহিত করা হত দুর্ভেদ্য পিরামিডের নিরাপদ অভ্যন্তরে। একেকটি পিরামিড নির্মাণের সময় দেশের অর্থনীতিতে টান পড়ত। খুফুর পিরামিড নির্মাণের সময় ১ লক্ষ দাস ও শ্রমিক ২০ বছর ধরে কাজ করেছিল। অসংখ্য দাস ও শ্রমিক মারা যেত এ কাজে। এ কাজের জন্য সারা দেশ থেকে অসংখ্য দাস ধরে এনে শেকল পরিয়ে কাজে লাগানো হত। এভাবেই শোষণ ও অত্যাচারের শেকলে বাধা পড়েছিল অসংখ্য মানুষের জীবন। লম্পট রাজার কাল্পনিক জগতের বিকৃত লালসা পূরণের জন্য কী অমানুষিক আয়োজন। প্রতিটি পিরামিডের পাথরের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে অবিচার ও শোষণের এক করুণ ইতিহাস। শোষণ, অবিচার ও অন্যায়ের কলংক মাথায় নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এসব পিরামিড। তাই পিরামিড সভ্যতার এক কুৎসিত নিদর্শন।  

শোষণের এই নারকীয় ব্যবস্থাকে চালু রাখার জন্য জনগণের সামনে রাজতন্ত্রের দৈব সাহায্য প্রচারের কাজে নেমেছিলেন পরজীবী ভাঁড়াটে ধর্ম ব্যবসায়ী পুরোহিত সম্প্রদায়। দেশজুড়ে স্থাপিত অসংখ্য মন্দিরে তারা কাল্পনিক দেবতাদের শক্তি ও মাহাত্মের কথা প্রচার করতেন, যারা না কি রাজাকে পাঠিয়েছেন শাসন ও শোষণের জন্য।

সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থায় শোষক দাস মালিক শ্রেণী ও রাষ্ট্রশক্তি তাদের শোষণ ও নিপীড়নকে বৈধ প্রতিপন্ন করার জন্য ধর্মকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। সে সময়কার নৈতিকতা ও আইনে ধর্মের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। ধর্ম ও দেবতারা ছিল সামাজিক জীবনের বিধায়ক। তবে এসব দেবতাদের রাজশক্তি ও শোষক গোষ্ঠীর পক্ষে দালালীটা ছিল খুবই স্থূল আর নগ্ন। এসব দেবতারা যেন ব্যস্তই থাকতেন রাজশক্তির মনোবাঞ্চা পূরণের কাজে। রাজারা নাকি দেবতারই মনোনীত ব্যক্তি। আবার কখনও মানুষ আর দেবতায় হয়ে যেত একাকার। এই মানুষ হলেন রাজারা । দেবতাদের মন্দির বানাতে অর্থ দিতেন রাজারা। যে অর্থের মালিক তারা হতেন দাসদের পাজরভাঙ্গা শ্রমে। আর এসব মন্দিরের কর্তা হতেন রাজাদের ভাঁড়াটে ধর্মীয় পুরোহিতরা। মন্দিরে বসে তারা দিবানিশি প্রচার করতেন ক্ষমতাধর দেবতাদের শক্তিমত্তা আর দাপটের কথা। যাদের মনোনীত ব্যক্তি স্বয়ং রাজা। দেবতাদের শক্তিকে মানুষ ভয় করত। পুরোহিতরা প্রচার করত দাস ও প্রজাদের রাজভক্তি কমে যাওয়াতেই দেবতাদের অভিশাপে তাদের ওপর নেমে আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাই শোষিত মানুষ দেবতাদের অভিশাপকে প্রচন্ড ভয় করত। দেবতাদের অভিশাপের ভয়ে তারা জবুথবু হয়ে থাকত। আর রাজরাজড়াদের সামনে মাথা টুকত। যারা হলেন দেবতার জাত। নীরবে দেবসন্তানদের শোষণ ও অত্যাচারকে সহ্য করে যেত। মুখ বুজে মেনে নিত অশুভ পরিণতির ভয়ে।

প্রাচীন মিসরের রাজারা নিজেদের বড় বড় দেবতাদের বংশধর, মনোনীত ব্যক্তি কিংবা ছোট দেবতা বা অবতার হিসেবে উপস্থাপন করত। প্রাচীন মিসওে সূর্যকে সবচেয়ে বড় দেবতা মনে করা হত। এর নাম ছিল ‘আমন রে’। ফারাওরা নিজেদের এই সূর্যদেবতার বংশধর বলে দাবি করত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে মিসরের রাজধানী থিবিসে অবস্থিত প্রধান দেবতা আমান-রে-এর মন্দিরের মালিকানায় ছিল ১,০৭,০০০ দাস, ৮৮টি সমুদ্রগামী জাহাজ, ৫৩টি নৌবন্দর, ৫০,০০০ গবাদীপশু, সমস্ত মিশরের মোট আবাদী জমির এক সপ্তমাংশ এবং মিসর ও সিরিয়া অঞ্চলের ১৬৯ টি শহরের রাজত্ব। এ সবই লাগত পুরোহিতকুলের ভোগে। পুরনো প্যাপিরাস থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। এসব তথ্য থেকে বুঝতে কষ্ট হয়না আমন দেবতা কীভাবে মিসরের শোষিত মানুষের ঘাড়ে অভিশাপ হয়ে চেপেছিলেন। সূর্যের আলো ছাড়া ফসল ফলেনা, জীবন বাঁচেনা। তাই সূর্যদেব আমন দেবতার নামে তার প্রতিনিধি ও উপাসক পুরোহিতকুল শোষিত মানুষের ঘাড়ে কাঠাল ভেঙ্গে খেয়েছে। দেবতার নামে মানুষকে বানিয়েছে ক্রীতদাস। কৃষকের ঘাড়ে চাপিয়েছে করের বোঝা।

 

২. আসুরবানিপালের পাঠাগারে 

১৮৫০ সালের কথা! ভারতবর্ষে তখনও ব্রিটিশ সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার স্থলে চলছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। আর শাসন মানেই তো শোষণ। অনেক ইংরেজ তখন ভাগ্য গড়ার জন্য পাড়ি জমাত ভারতে। এরকমই একজন ইংরেজ ছিলেন হেনরি লেয়ার্ড। শ্রীলংকায় তার একটি ভাল চাকরি হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি রওনা দিয়েছিলেন ভারতের পথে। সোজা পথে জাহাজে রওনা দিলেই পারতেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁর কী যে মনে হল! সিদ্ধান্ত নিলেন মেসোপটেমিয়া, পারস্য প্রভৃতি দেশ দেখে স্থলপথে ভারতে আসবেন।

এসব দেশ তখন ছিল তুরস্কের ওসমানীয় খিলাফতের অধীনে। তাই অনুমতি নিয়ে তিনি ঢুকে গেলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যে। উত্তর মেসোপটেমিয়ায় বেড়াবার সময় তার মনে হলো এই তো সেই প্রাচীন জাতির দেশ, এখানে খুঁজলে কি তাদের চিহ্ন পাওয়া যাবে না? তাঁর আর চাকরি করা হলনা। কিছু মজুর নিয়ে লেগে গেলেন খননের কাজে। এক সময় সঙ্গের টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেল। আবার টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে খনন শুরু করলেন। খোঁড়া-খুড়ি দেখে আরও কিছু কৌতুহলী লোকজন এসে তার সাথে যোগ দিল। তুর্কী রাজ কর্তৃপক্ষ ঘরবাড়ী ছেড়ে বিদেশে এসে এই মাটি কাটার কান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তারা এর ব্যাখ্যা চাইল। তবে আরও কিছু খননের পরে যখন মাটির নীচ হতে নানা রকম অদ্ভূত মূর্তি আর ঘর-বাড়ি বের হয়ে আসতে লাগল তখন তাদের বিস্ময়ের আর সীমা থাকল না। অবশেষে ইংরেজ ও ফ্রান্স সরকারের সহায়তায় খনন কাজ আরও কিছু দূর অগ্রসর হল। এক সময় শ্রমিকের গাইতি-কোদাল থেমে গেল। মাটির নীচ হতে বেরিয়ে পড়ল এক আশ্চর্য শহর।

এই শহর ছিল অ্যাসিরিয়দের রাজধানী। এর নাম নিনেভা। এই শহর ধ্বংস হয়েছিল ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তবুও তার অনেক কিছুই আজও অক্ষত। এই শহরের ধ্বংসস্তুপে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন পৃথিবীর এক বিশাল গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারটি স্থাপিত হয়েছিল ৬৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। স্থাপন করেছিলেন অ্যাসিরিয় সম্রাট আসুরবানিপাল। এরও দেড় হাজার বছর আগের মৃৎফলক সেখানে পাওয়া গেছে। কাঁদামাটির মৃৎফলকে লিখে সেগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে ইটের মত শক্ত করে নেওয়া হত। তাই মাটির নিচেও সেগুলো অক্ষত অবস্থায় থেকে গিয়েছে। এগুলোই হল আসুর বানিপালের পাঠাগারের বই।

প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা এই পাঠাগারের হাজার হাজার মৃৎফলকের সাহায্যেই। আসুর বানিপাল তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা পুরনো আমল থেকে তখন পর্যন্ত লেখা যতগুলো মৃৎফলক ছিল তার সবগুলো জড়ো করেন তার পাঠাগারে। এখানে সুমেরীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত বানানো মৃৎফলক ছিল অনেক পুরনো সুমেরীয় মৃৎফলক তিনি সংরক্ষণ করেছিলেন। এগুলো ছাড়াও সুমেরীয় শহর নিপ্পুরে পাওয়া গিয়েছিল ৫০০০ মৃৎফলক। এসব মৃৎফলক থেকেই বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়ের মেসোপটেমীয় সভ্যতাগুলোর ইতিহাস। এ অঞ্চলে কয়েকটি সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল। এবার দৃষ্টি দেয়া যাক সে ইতিহাসের দিকে।

 

সুমেরীয় সভ্যতা:

সুমেরীয় সভ্যতার শুরু প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে। এটাই মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা। এর সমসাময়িক সভ্যতা হল মিসরীয় সভ্যতা। বেশ কিছু শহর নিয়ে সুমেরীয় সভ্যতার বিকাশ। এগুলোর মধ্যে উর, ইউরুক, লারসা, ইরুদু এবং কিশ ছিল উল্লেখযোগ্য। সুমেরের অবস্থান ছিল মেসোপটেমিয়ার সর্বদক্ষিণে। সুমেরীয় নগরীগুলো ছিল বিভিন্ন দেবতার অধীনে সার্বভৌম। একক কোন রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। শুধু যুদ্ধের প্রয়োজন হলেই তারা একত্রিত হতো। কৃষি ছিল আয়ের মূল উৎস। সমাজ ছিল শ্রেণিবিভক্ত। কিউনিফর্ম নামে একটি অক্ষরভিত্তিক বর্ণলিপি উদ্ভাবন করেছিল সুমেরীয়রা। ফিনিশীয় বর্ণমালার আরামীয় ভাষার আগ পর্যন্ত এটাই ছিল সে অঞ্চলের প্রচলিত লিপি। অসংখ্য মৃৎফলক লেখা হয়েছে এ লিপিতে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মহাকাব্যটি হল সুমেরীয়দের রচিত গিলগামেশ মহাকাব্য। আসুরবানিপালের পাঠাগার হতে কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা এ মহাকাব্যটি উদ্ধার করা হয়েছে। সূর্যদেবতা শামাস ছিলেন সুমেরীয়দের প্রধান দেবতা। রাজাই হতেন একাধারে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কর্তা।

ব্যাবিলনীয় সভ্যতা:

মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণের ব্যাবিলন নগরী ঘিরে গড়ে উঠেছিল বিশাল সভ্যতা, যা ব্যাবিলনীয় সভ্যতা নামে পরিচিত। এ সভ্যতার গড়ে ওঠার শুরু  খ্রিস্টপূর্ব ২০৫০ সাল হতে। এর আগে সুমেরের নগরগুলো বিভিন্ন দেবতার অধীনে ছিল সার্বভৌম। সমস্ত সুমেরে এক সার্বভৌম রাজশক্তি কখনও দেখা যায়নি। সেমেটিক ব্যাবিলনীয়রাই সুমেরে তথা মেসোপটেমিয়ায় প্রথম দেশব্যপী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। রাজা হাম্বুরাবিই প্রথম সমগ্র মেসোপটেমিয়াকে ব্যাবিলনের অধীনে এনে এক অখন্ড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম আইনের দৃষ্টান্ত হলো প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সম্রাট হাম্বুবাব্বির আইন সংহিতা। হাম্বুবাব্বির রাজত্বকাল হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ১৭৯২ থেকে ১৭৫০ অব্দ। এই বিয়াল্লিশ বছরে তিনি তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী সম্রাটে পরিণত হন। রাজত্বের শেষ দিকে হাম্বুরাব্বি তাঁর আদেশিত বিধানমালা প্রস্তরখন্ডে খোদাই করার নির্দেশ দেন। এই খোদাই করা প্রস্তর স্তম্ভগুলো বিভিন্ন মন্দিরে স্থাপন করা হয়। এই রকম একটি প্রস্তুর স্তম্ভ এখনও প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে চমৎকার অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে। এ স্তম্ভটি হাম্বুরাব্বির সময় সিপ্পার শহরের শামাশ দেবতার মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছিল।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে পশ্চিম ইরানের দুর্ধর্ষ এলামীয়রা এটাকে যুদ্ধে লুন্ঠিত দ্রব্য হিসেবে তাদের রাজধানী সুসায় নিয়ে যায়। ফরাসি পুরাতত্ত্ববিদেরা ১৯০১ সালে এটাকে সুসার ধ্বংসাবশেষ থেকে খুঁড়ে বের করেন। স্তম্ভটি একটি আট ফুট উঁচু মসৃণ ব্যাসাল্ট পাথর, যার ওপর দিকটা স্থূলভাবে বৃত্তাকার। এখানে একটি ছবিতে দেখা যায় হাম্বুরাব্বি প্রার্থনার ভঙ্গিতে সিংহাসনে উপবিষ্ট শামাশ দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ন্যায় বিচারের দেবতা সূর্যদেব শামাশ তাঁকে এই আইন সংহিতা দিচ্ছেন এরকমই একটা দৃশ্য খোদাই করা আছে। স্তম্ভের বাকি অংশে সংবাদপত্রের মতন কলামে দুইশত বিরাশিটি আইন অত্যন্ত বিশুদ্ধ ব্যাবিলনীয় ভাষায় খোদাই করা আছে। এই দুশ বিরাশিটি আইন মূলত নানা রকম আইনভঙ্গ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ, পরিবার, সম্পত্তি, বৃত্তিধারী লোকদের পারিশ্রমিক এবং দায়িত্ব, কৃষি সংক্রান্ত আইনগত সমস্যা, ভাঁড়ার হার এবং পরিমাণ, দাস ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি সংক্রান্ত। অবশেষে একখানা লম্বা উপসংহারে বলা হয়েছে, “যে সুযোগ্য রাজা হাম্বুরাব্বি প্রতিষ্ঠিত এই ন্যায় আইন সংহিতা উৎকীর্ণ স্তম্ভের ক্ষতিসাধন অথবা পরিবর্তন করবে তার ওপরে দৈব অভিশাপ নেমে আসবে।”

দৈব অভিশাপ! বাহ চমৎকার! বিধান জারি করলেন হাম্বুরাব্বি আর অভিশাপ দেবেন সূর্য দেবতা শামাশ! আবার এই বিধানসমূহ স্থাপন করা হল মন্দিরে মন্দিরে। আইনের ওপরে রয়েছে শামাশ দেবতার ছবি। অর্থাৎ সবকিছু মিলে মনে হচ্ছে ধর্ম আর রাজতন্ত্রে কোন ব্যবধান নেই। আজকের যুগে আইনের কাজ হয় আদালতে, তখন হতো ধর্ম মন্দিরে। দেবতারা পাহারা দিতেন সে সব আইন। রাজতন্ত্রের যেন একটি অনিবার্য অংশ রূপেই ধর্মের অস্তিত্ব দেখা দিয়েছিল।

তা কী আছে সেসব আইনে? হাম্বুরাব্বির আইন সংহিতা এবং অন্যান্য প্রাপ্ত প্রমাণপত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সমাজ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। আওএলুম, মুশকেলুম এবং ওয়ারদুম। আওএলুম মানে অভিজাত শ্রেণী যারা ছিল দাস মালিক। মুশকেলুম মানে সাধারণ প্রজা, ওয়ারদুম মানে দাস। আইন সংহিতায় পলাতক ওয়ারদুমের আশ্রয়দাতার জন্য ছিল মারাত্মক শাস্তির ব্যবস্থা। একজন মুশকেলুম যদি কোন আওএলুমের চোখ অন্ধ করে দেয় তবে সেই মুশকেলুমের চোখ বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু কোন আওএলুম যদি একজন মুশকেলুমের চোখ অন্ধ করে অথবা হাড় ভেঙ্গে ফেলে তাহলে সে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক মিনা পরিমাণ রূপা দিতে বাধ্য থাকবে। এই হচ্ছে মহান রাজা ও তাঁর চামচা মহা শক্তিধর শামাশ দেবতার ন্যায়বোধ।

অ্যাসিরিয় সভ্যতা:

ব্যবিলনীয় সভ্যতার পতনের পরবর্তী দীর্ঘ সময় জুড়ে অ্যাসিরিয়দের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত মেসোপটেমিয়ায় চলছিল অন্ধকার যুগ। এক সময় মেসোপটেমিয়ার অন্ধকার যুগ কাটিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠল উত্তরের অ্যাসিরিয়া। মেসোপটেমিয়ার উত্তর অংশকে বলা হত অ্যাসিরিয়া। মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের সভ্যতাগুলোর মধ্যে সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য সভ্যতা হল এই অ্যাসিরিয় সভ্যতা।  অ্যাসিরিয় সভ্যতার গড়ে ওঠার সময়কাল অনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে শুরু।  ব্যাবিলন থেকে প্রায় দুশ মাইল উত্তরে দজলা নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। এর রাজধানী নিনেভা ছিল ব্যাবিলন নগরী থেকে দুশ মাইল দূরে দজলা নদীর তীরে অবস্থিত। লুটের মাল ছিল অ্যাসিরিয় অর্থনীতির মূল উৎস। তারা বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করে লুটে আনত ধন-সম্পদ। বৃত্তকে প্রথম ৩৬০  ডিগ্রিতে ভাগ করে অ্যাসিরিয়রা। পৃথিবীর সবেচেয় প্রাচীন লাইব্রেরী গড়ে তুলেছিলেন শেষ অ্যাসিরিয় রাজা আসুরবানিপাল। প্রাচীন সুমেরীয় কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে লেখা ২২০০০ টি কাদামাটির শ্লেট ছিল এ লাইব্রেরির বই। সম্রাট আসুরবানিপাল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ছিলেন। তিনি ছিলেন যেমনই নিষ্ঠুর তেমনই বিদগ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রে যিনি পরিচয় দিতেন চূড়ান্ত বর্বরতার। তিনিই গড়ে তুলেছিলেন প্রাচীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাঠাগার। তার সময়কাল ছিল ৬৬৮ থেকে ৬৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

ক্যালদীয় সভ্যতা:

কোন সভ্যতাই ইতিহাসে দীর্ঘদিন পর্যন্ত টিকেনি। বিকাশের এক পর্যায়ে এসে তার পতন ঘটেছে অন্য কোন উদীয়মান সভ্যতার কাছে। অ্যাসিরিয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ৩০০ বছরের পুরনো এই সভ্যতা প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। নতুনভাবে জেগে ওঠা ব্যাবিলনের ক্যালদীয় রাজা আর পূর্বদিকের পারসীয়রা দখল করে নিল এ সাম্রাজ্য। রাজা আসুরবানিপালের মৃত্যুর পরে ব্যাবিলনের রাজা অ্যাসিরিয়দের রাজধানী নিনেভা ধ্বংস করলেন। এটা ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঘটনা। পুরো অ্যাসিরিয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে কতকগুলো পৃথক রাষ্ট্রের মধ্যে মিশে যায়। এগুলো হচ্ছে মিডিয়া, পারস্য, ক্যালদিয়া, মিসর এবং লিডিয়া। এদের মধ্যে সুযোগ সন্ধানী ক্যালদীয়রা ক্রমে নতুন ব্যাবিলন শহরকে কেন্দ্র করে পুরো মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের প্রভু হয়ে পড়ে। নতুনভাবে জেগে ওঠা এই ক্যালদীয় সাম্রাজ্য  ইহুদী ইতিহাসের গাতিপথকে বদলে দিয়েছিল।

এই সভ্যতা গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নিয়েছিলেন সম্রাট নেবুচাদনেজার। তাঁর রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০৪ থেকে ৫৬১ অব্দ পর্যন্ত। বহুদিন আগের রাজা হাম্বুরাবির মত তিনিও সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চলকে তাঁর পদানত করলেন। বিশেষ করে মিসরীয়দের হাত থেকে সিরিয়া অঞ্চলটি দখল করে এশিয়ার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে উঠলেন। ইতিহাসে তাঁর এ সকল বিজয় অভিযান অন্য আরও দশজন সম্রাজ্যের অধিপতির মতই বৈচিত্রহীন। কিন্তু একটি নিষ্ঠুর অভিযান তাকে ইতিহাসে তাৎপর্যমন্ডিত করে তুলেছে। এটা হল ইহুদীদের জুডা রাজ্য ও জেরুজালেম ধ্বংসের অভিযান।

নেবুচাদনেজার শেষ বয়সে উন্মাদ হয়ে গেলেন। নিজেকে পশু ভাবতে লাগলেন এবং হাঁটু মুড়ে হাত পেতে পশুর মত হাঁটতে হাঁটতে ঘাস খাওয়ার ভঙ্গি করতে লাগলেন। যৌবনে তিনি বিয়ে করেছিলেন মিডিয়ার রাজকন্যাকে। মিডিয়া বর্তমান ইরানের অংশ। মিডিয়া ছিল পাহাড় পর্বতের দেশ। রাজকন্যার তাই সমতল ব্যাবিলন শহর ভাল লাগলনা। রাজা নেবুচাদনেজার তাই রাণীকে খুশি করার জন্য রাজপ্রাসাদের ছাদে তৈরি করেছিলেন কৃত্রিম বাগান।

এটাকেই বলা হয় ব্যাবিলনের শূণ্য উদ্যান যা প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। একই সাথে রাজকীয় বিলাসীতারও এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার এসব রাজকীয় বিলাসিতার পেছনে লুকিয়ে আছে অজস্র মানুষের কান্না আর হাহাকার। রাজ-রাজড়ারা তাদের তুচ্ছ শখ পূরণের জন্য এসব স্থাপত্য নির্মাণ করত আর রাজ্যের অসংখ্য মানুষ হয় অনাহারে নয়ত এসব স্থাপত্য নির্মাণ করতে গিয়ে অমানুষিক শ্রমের বোঝা বইতে না পেরে ধুকে ধুকে মারা যেত। রাজতন্ত্রের ইতিহাসের সমস্ত স্থাপত্যকলা- হোক তা পিরামিড কিংবা তাজমহল আসলে নিষ্ঠুর কলংকের নিদর্শন। কারণ এসব স্থাপনার জন্য দাম কিংবা চাষীদের ধরে এনে শেকল পরিয়ে কাজে লাগানো হত। তাদের জমিগুলো চাষ হতনা। ফলে দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিত। এ সংকট রাজারা চাপিয়ে দিত যেসব প্রজারা চাষের কাজে আছে তাদের ফসলের ওপর করের হার বাড়িয়ে দিয়ে।

ফলে রাজাকে ফসলের অধিকাংশই দিয়ে দেওয়ায় এসব চাষীদের সন্তানরা না খেয়ে মারা যেত। তাজমহল নির্মাণের সময় সম্রাট শাহজাহান ভারতের চাষীদের কাছ থেকে কর হিসেবে তাদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেকের জায়গায় চার ভাগের তিনভাগই নিয়ে যেতে শুরু করেন। ফলে অসংখ্য মানুষ না খেয়ে মারা যায়। অন্যদিকে যারা নির্মাণ কাজে লিপ্ত ছিল তাদের অনেকে শ্রমের ধকল সইতে না পেরে কীটপতঙ্গের মত মারা যায়। এটাই হল প্রাচীন ও মধ্যযুগের সমস্ত স্থাপত্যের পেছনের মর্মকথা। তাই এসব স্থাপত্য গৌরবের বিষয় নয় বরং কলংকজনক ইতিহাসের নির্মম সাক্ষীদাতা হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এগুলো আসলে ঘৃণার থুথু নিক্ষেপের সবচেয়ে আদর্শ জায়গা হতে পারে।

রাজ-রাজড়াদের অতিরিক্ত আমোদ-প্রমোদ আর ফুর্তি বিলাস দেশের সাধারণ মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিত। এসব আমোদ-প্রমোদের মূল্য পরিশোধ করতে হত দাস শ্রেণী ও চাষা শ্রেণীর মানুষকে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে। তাই অতিরিক্ত ফুর্তি-বিলাস রাজ্যের শ্রমজীবি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেত। ফলে দেশের অর্থনীতি হয়ে পড়ত দূর্বল ও সংকটগ্রস্থ। ক্যালদীয়দের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটেছিল। অতিরিক্ত ভোগ-বিলাসের কারণে তাদের সাম্রাজ্য একসময় ভেঙ্গে পড়ল। পদানত হল মেসোপটেমিয়া থেকে দূরে পূর্বদিকের পারস্য দেশে গড়ে ওঠা নতুন সভ্যতার কাছে। পারস্য সম্রাট সাইরাস ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্যালদিয় সাম্রাজ্য তথা সমগ্র মেসোপটেমিয়া দখল করে নেন। ক্যালদীয় সাম্রাজ্যই ছিল মেসোপটেমীয় সভ্যতার শেষ ও চূড়ান্ত ধাপ।

পারস্য সভ্যতা:

খ্রিস্টপূর্ব ৬১২ অব্দে অ্যাসিরিয়দের পতন ঘটলে পারস্য উপসাগর ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে আর্যদের একটি শাখা পারস্য সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তারা যে ভাষায় কথা বলত তাকে বলা হত পার্সি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাষার নামে জাতির ও দেশের নাম নির্ধারিত হত। তাই এক্ষেত্রেও জাতির নাম ‘পারসীয়’ ও দেশের নাম ‘পারস্য’। পরবর্তীতে ভাষার নাম হয় ফারসি।

ইরান অঞ্চলে প্রবেশ করা পারসীয় আর্যরা দু’টি প্রধান গোত্রে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল মেডেস। অ্যাসিরীয়দের পতনের পরে এরা আর্মেনিয়া ও অ্যাসিরিয়া অধিকার করে মিডিয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এই মিডিয়ার রাজকন্যাকেই বিয়ে করেছিলেন নেবুচাদনেজার। তার মতই মিডিয়রাও ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের এ দূর্বলতার সুযোগ নিল অন্য আর্য গোত্রীয় তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র আনশান। সুযোগ বুঝে এখানকার শাসনকর্তা সইরাস মিডিয় সাম্রাজ্য দখল করে নিলেন। মিডিয় ও আনশানের মিলিত শক্তিতে জন্ম নিল শক্তিশালী পারস্য সভ্যতা।

 

৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস দখল করে নিলেন ক্যালদিয়ার রাজধানী ব্যাবিলন। এর আগে দখল করে নিয়েছিলেন লিডিয়া। লিডিয়া বিজয়ের পরে তার সৈন্যরা অগ্রসর হয় ব্যাবিলনের দিকে। ব্যাবিলনের অভিজাত শ্রেণী তখন আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত। দজলা নদীর তীরেই ছিল ব্যাবিলন শহরের বাঁধ। সাইরাসের সৈন্যরা নদীর বাঁধ বন্ধ করে নদীর পানি একদিকে সরিয়ে দিল। তারা শুকনো নদীর ভেতর দিয়ে শহরে ঢুকল এবং বিনাযুদ্ধে ব্যাবিলন দখল করে নিল।

সইরাস আনশানের ক্ষমতায় এসেছিলেন ৫৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। বিশ বছরের মধ্যে তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। ৫২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক বর্বর জাতির আক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়। এটাই প্রথম বাইরের কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্য যা সমগ্র মেসোপটেমিয়া ও মিশর দখল করে নিল।

৩.হিব্রুভাষী দেশে দেশে : ইতিহাসের প্রসঙ্গ আসলেই আর্যভাষীদের মতই আরেকটি ভাষা ভাষীরা আমাদের দৃষ্টি কাঁড়ে। এরা হল হিব্রুভাষী । হিব্রুভাষী ইহুদীদের ইতিহাসটি এতই পুরনো যে এর সাথে অনিবার্যভাবে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ইতিহাসও জড়িয়ে গিয়েছে। ইহুদী জীবনধারাকে সরাসরিভাবে স্পর্শ করেছে প্রাচীন সভ্যতার প্রধান ধারাগুলো। সেজন্য ইহুদী ইতিহাস যেন আসলে প্রাচীন মিসরীয়, মেসোপটেমীয়, মেসিডোনীয়, রোমান ও মুসলিম খিলাফতের ইতিহাসেরই অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। ইহুদী ইতিহাসের পথ ধরে হাটলে সামনে এসে দাঁড়ায় হারিয়ে যাওয়া কত সভ্যতার ইতিহাস। মনে পড়ে যায় হারিয়ে দিনের কত গল্প কত কথা কত কাহিনী। এই ইতিহাসের সাথে এসে পড়ে হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর গল্প।

গল্পের শুরুটা হয় ইহুদীদের আদি পিতা ইব্রাহিমকে দিয়ে। গল্পের গোড়ায় এসে যায় প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার কথা। কারণ ইব্রাহিম বসবাস করতেন এখানেই, উত্তর-পশ্চিম মেসোপটেমিয়ায়। সময়কালটা ছিল ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি। সে সময় সুমেরীয় সভ্যতার চলছে পড়ন্ত দশা। ইব্রাহিম থাকতেন সুমেরীয় শহর উর শহরে। তাঁর পূর্ব পুরুষদের আদি বাস ছিল আরব মরুভূমিতে। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বের দাবী রাখে তা হল, ইহুদী ইতিহাসের গোড়াটা ফিলিস্তিনে নয় বরং সুমেরীয় সভ্যতায় অর্থাৎ বর্তমান ইরাক অঞ্চলে খুজে পাওয়া যায়। উর শহরটির অবস্থান ছিল বর্তমান ইরাকে। এখান থেকেই এক সময় ইব্রাহিম তাঁর বংশের লোকজন নিয়ে চলে যান ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ফিলিস্তিন অঞ্চলে। ফিলিস্তিন ভূখন্ডের সাথে ইহুদী ইতিহাসের যোগসূত্র স্থাপিত হয় এখান থেকেই। ইব্রাহিমের নাতি ইয়াকুবের নেতৃত্বে তারা সেখানকার কেনানে বসতি স্থাপন করে। ইয়াকুবের আরেক নাম ইসরাইল। এ নাম থেকেই ইহুদীদের পরিচয় হয় ইসরাইলী বলে।

ইয়াকুবের পুত্র ইউসুফকে তাঁর সৎ ভাইরা ফেলে দেয় পানির কূপে। সেখান থেকে একজন মিশরীয় ব্যবসায়ী তাঁকে উদ্ধার করে ফারাওয়ের রাজ কর্মচারীর কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এই বালক দাসই একদিন হয়ে যান ফারাওয়ের মন্ত্রী। ভাগ্যের কী পরিহাস ! একদিন এই ইউসুফই তাঁর হিংসুক ভাইদের প্রাণ বাঁচিয়ে আশ্রয় দিলেন মিশরে।

কেনান দেশে তখন প্রচন্ড দূর্ভিক্ষ চলছে। অন্যান্য কেনানীয়দের সাথে ইউসুফের ভাইরাও খাদ্য ভিক্ষা করার জন্য গেল মিশরে ইউসুফের কাছে। ভাইয়ে ভাইয়ে পরিচয় হল। কিন্তু ইউসুফ প্রতিশোধ নিলেন না। বরং তাদের জন্য খাদ্যশস্যের ব্যবস্থা করলেন। এমনকি তাদেরকে তিনি অনুর্বর কেনান থেকে নিয়ে আসলেন মিসরে। গোশেন নামে মিসরের একটি উর্বর এলাকা দান করলেন তাদেরকে যেখানে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। এ ঘটনার তাৎপর্য দুটো। প্রথমত প্রতিশোধ না নেয়ার বিষয়টি। সেই যুগে চাষযোগ্য ভূমির তুলনায় শ্রম ছিল অপর্যাপ্ত। তাই চাষবাসের জন্য শ্রম দানে সমর্থ মানুষকে হত্যা না করে কাজে লাগানো ছিল কল্যাণকর। কারণ চাষ করে যে ফসল অর্জিত হবে তার একটি অংশ কর হিসেবে রাজকোষকে করবে সমৃদ্ধ। বহুদিন পরে এরকমই একটি উদ্যোগ নিতে দেখা যায় মুসলিম বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে। তিনি জঘণ্য অপরাধী ৬০,০০০ ক্রুসেডারকে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে চাষের উপযোগী জমি প্রদান করেছিলেন। যা ছিল ইতিহাসের একটি অসাধারণ বিচক্ষণ  দৃষ্টান্ত।

দ্বিতীয় তাৎপর্যটি হলো ইসরাইলীদের ফিলিস্তিনের কেনান অঞ্চল ছেড়ে মিসরে পুনর্বাসিত হওয়ার ঘটনা। ইরাক অঞ্চল ছেড়ে ফিলিস্তিনে এসে আবার মিসরে চলে যাওয়া থেকে প্রমাণ পায় যে ফিলিস্তিনের ওপর বর্তমানের ইহুদী যায়নবাদীদের ঐশ্বরিক দাবিটি ভিত্তিহীন। যায়নবাদ দাবি করে যে, যিহোবার সাথে ইহুদীদের একটি চুক্তি আছে। আর সেই চুক্তি অনুযায়ী ফিলিস্তিন ইহুদীদের জন্য যিহোবার প্রতিশ্রুত ভূমি (promised land) এবং এর বিরুদ্ধে কোন ইহলৌকিক যুক্তি খাটবে না বা অন্য কোন ধর্মের যুক্তিও খাটবেনা। মজার ব্যাপার হলো মিসরে ইউসুফের বদৌলতে উর্বর জমি পেয়ে ইসরাইলীরা তাদের এই প্রতিশ্র“তি ভূমি ছেড়ে সেখানেই চলে যেতে শুরু করল। ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে দূর্ভিক্ষ পীড়িত ফিলিস্তিন ছেড়ে প্রায় সকল ইহুদীই গিয়ে ভিড় করল মিসরে। সেখানে তারা ক্রমে ফারাওদের দাসে পরিণত হল। ইহুদীরা প্রায় চারশ বছর মিসরে থাকল। কালক্রমে সেখানে অত্যাচারী শাসকের আবির্ভাব ঘটল। ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসরে রামেসেস নামে এক রাজা এল। সেই ফারাও ইহুদীদের হত্যা করার আদেশ দিল। অবশেষে ১৩০০-১২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ইহুদীদের নতুন নেতা মুসা তাদেরকে মুক্ত করে লোহিত সাগর পেরিয়ে নিয়ে আসেন এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থল সিনাই উপদ্বীপে। মিসরের ফারাওদের হাত থেকে পালিয়ে এসে ইহুদীরা কিন্তু কেনানে অর্থাৎ তাদের বর্তমানের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’-তে ফিরে গেলনা। তারা থেকে গেল এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থল সিনাই উপদ্বীপেই। সেখানে তারা থাকল প্রায় ২৫০ বছর।  ইহুদী কিংবদন্তী হল মুসা যিহোবার সাথে দেখা করার জন্য সিনাই পাহাড়ে আরোহন করেন। সেখানে ৪০ দিন অবস্থান করে যিহোবার কাছ থেকে ১০টি নির্দেশ নিয়ে ফিরে আসেন। মুসার মৃত্যুর পর ইহুদীরা যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

ইহুদীদের কোন রাজা ছিলনা। ধর্মযাজকরাই তাদের শাসন করত। এদেরকে বলা হত জজ। এক পর্যায়ে ইহুদীরা তাদের একজন রাজা ঠিক করল। তাঁর নাম সউল। তিনি ইহুদীদের প্রথম রাজা। কিন্তু তাঁর কোন স্থায়ী আবাস ছিল না। তিনি তাঁবুতে থাকতেন। খুব সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন। সউলের পর রাজা হলেন ডেভিড। যাকে আমরা হযরত দাউদ বলে চিনি।  

ইহুদী কিংবদন্তীতে ডেভিডের অনেক বীরত্বগাথা আছে। গোলিয়াথ নামের এক দৈত্যকে তিনি বধ করেন। রাজা সউলের মেয়ে এতে খুশি হয়ে তাকে বিয়ে করেন। এভাবে তিনি ইহুদীদের রাজায় পরিণত হন। এই রাজা দাউদ ইহুদীদের জন্য একটি স্থায়ী আবাসভূমির কথা ভাবলেন। ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে তিনি ইহুদীদের নিয়ে অগ্রসর হলেন জেরুজালেমের দিকে। যিবুসাইটসদের হাত থেকে দখল করলেন জেরুজালেম। দাউদের জেরুজালেম দখলের সময়ে মেসোপটেমিয়ায় চলছে অন্ধকার যুগ। সুমেরীয় সভ্যতার পরবর্তী সময়কার প্রাচীন ব্যবলনীয় সভ্যতা হারিয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছিল কিছু ছোট ছোট রাজ্যের অস্তিত্ব। এদের কেউ একক আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল না। ফিলিস্তিন অঞ্চল জুড়ে ছিল অনেকগুলো জাতির বসবাস। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

কেনানীয়: তাওরাতে বর্ণিত নবী নোয়ার পুত্র ছিল হাম। হামের পুত্র কেনান। কেনানের বংশধররাই হলো কেনানীয়। ইব্রাহিম তাদের দেশে আসার বহু আগেই তারা সে অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তাদের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ফিলিস্তিনে (তাওরাত: ১০: ১৫-২০)।

সিডনীয়: কেনানের বড় ছেলে সিডন। ফিনিশীয় বাণিজ্য কেন্দ্র সিডন শহর ছিল তার বংশধরদের।

যিবুসীয় ও আমোরীয়: এরা কেনানের বংশের শাখা। ইংরেজিতে এদের বলা হয় যিবুসাইট ও আমোরাইট। ব্যাবিলনীয়রা ছিল আমোরীয় জাতির লোক। যিবুসীয়দের কাছ থেকে দাউদ জেরুজালেম দখল করেছিলেন। কেনানীয়দের অন্যান্য শাখা হল- গির্গাশীয়, হিব্বীয়, অর্কীয়, সীনীয়, অর্বদীয়, সমারীয় এবং হমাতীয়রা। সিডন থেকে গাজার দক্ষিণ এলাকা পর্যন্ত ছিল এদের দেশ।

ফিলিস্তিনী: হামের আরেক পুত্র মিসরের বংশধর হল লিডীয়, অলমীয়, লহাবীয়, নপ্তুহীয়, পথ্রোষীয়, কসলূহীয় ও ক্রীট দ্বীপের অধিবাসী ক্রীটীয়রা। এদের মধ্যে কসলূহীয়রা ছিল ফিলিস্তিনীদের পূর্বপুরুষ (তাওরাত: পয়দাদেশ: ১০: ১৩-১৪)।

বিভিন্ন ইবরানী জাতি: নোয়ার বড় ছেলে সাম। সামের বংশেই জন্ম ইব্রাহিমের। ইব্রাহিমের বংশধরদের বলা হয় ইবরানী। ইবরানীদের মধ্যে আছে ইব্রাহিম পুত্র ইসমাঈলের বংশধর আরবরা। অপর পুত্র ইসহাকের পুত্ররা হল ইয়াকুব (ইসরাঈল) ও ইস। ইস এর বংশধররা হল ইদোমীয় (পয়দাদেশ: ২৫:৩০)। ইসরাইলের বংশধররাই হল ইহুদীরা। ইসরাইলের ১২ সন্তানের ঔরশজাত ১২টি শাখায় তারা বিভক্ত ছিল। দাউদ তাদের সবার নেতা। ইসরাইলের ছেলে এহুদার বংশধর ছিলেন দাউদ। আরব ইদোমীয়রা ফিলিস্তিনের বাইরে বাস করত।

মোয়াবীয় ও আমোরীয়: ইব্রাহিমের ভাই হারন। হারনের ছেলে লুত। লুতের দুই পুত্র মেয়াব ও বিন-আমি। এদের বংশধররা হল মেয়াবীয় ও আমোনীয় (পয়দাদেশ: ১৯: ৩৭-৩৮)। এরা ফিলিস্তিন এলাকায় সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ইহুদীদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্ধীতে পরিণত হয়। তাই তাওরাত তথা ওল্ড টেস্টামেন্ট রচনার সময় ইহুদীরা এদের বংশপরিচয়ের গোড়ায় কুৎসিত কলংক ও মিথ্যাচার আরোপ করেছে। তাওরাতের ঊনবিংশ অধ্যায়ের ৩১ থেকে ৩৬ তম আয়াত ইহুদি মিথ্যাচারের ফসল।

হিট্টীয়: আর্যদের যে শাখা তুরস্কে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদেরকে বলা হয় হিট্টীয়। ইংরেজিতে হিট্টাইট। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের পরে এরা আর্যদের অন্য গোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হয়ে ফিলিস্তিন ও সিরিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কেনানীয় গোত্রের শাখা যিবুসাইটসদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে রাজা দাউদ প্রথমবারের মত ইহুদী রাজ্যের একটি ভিত্তি গড়লেন। এটা তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র একারণেই যে তখন আশেপাশে কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলনা। দাউদ  তাবুর জীবন ছেড়ে উঠে এলেন অট্টালিকায়। জেরুজালেমকে করলেন প্রাচীর বেষ্টিত। এই প্রাচীরের একটি ক্ষুদ্র অংশ আজও টিকে আছে যা wailling wall বা ‘অশ্রুর প্রাচীর’ নামে পরিচিত। এর নিচে দাঁড়িয়ে ইহুদীরা এখনও অশ্রু বিসর্জন দেয়। এটি ইহুদীদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় পবিত্রতার প্রতীক।

জেরুজালেমে ইহুদীদের অধিকার এটাই প্রথম। এর আগে প্রায় ৮০০ বছর তারা জেরুজালেমের অধিকার ছাড়াই ইহুদী পরিচয়ে কাটিয়েছে। আবার জেরুজালেমে তাদের কর্তৃত্বও খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। এক সময় তারা জেরুজালেমের কর্তৃত্ব হারায়। এর পরে পেরিয়ে গেছে হাজার হাজার বছর। তারা আর জেরুজালেমের কর্তৃত্ব ফিরে পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। কারণ সভ্য দুনিয়ার সকল জায়গা চলে যায় বিভিন্ন সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রের অধীনে। আর এসব সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেছে বৃহৎ অর্থনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে। বিশাল আয়তনের ভূখন্ডের অর্থনীতি একটি অভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় কেন্দ্রীভূত হয়ে এক একটি সাম্রাজ্যের আকার ধারণ করে যা তার আর্থ-রাজনৈতিক পরিধিকে আরও ব্যাপকতার দিকে নিয়ে যেতে চায়। এসব সাম্রাজ্যের জাতীয়তার ভিত্তি ইহুদীদের মত নয়। ইহুদীরা একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় গন্ডিবদ্ধ জাতীয়তায় আবদ্ধ। এটার ভিত্তিতে স্বাভাবিক রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে পারেনা। সাম্রাজ্যগুলোর জাতীয়তার ভিত্তি ছিল সুবিশাল এলাকা বা ভূখন্ডের অধিবাসীদের জাতীয়তা। যেমন- পারসীয়, রোমান বা মুসলিম সাম্রাজ্য কোন ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ছিলনা। বরং বিশাল অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয়ই এসব সাম্রাজ্যের জাতীয়তার ভিত্তি নির্ধারণ করেছে।

ইহুদীরা সভ্যতার দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে অস্তিত্বশীল হয়ে উঠতে পারেনি একারণেই যে একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় গোষ্ঠীতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র রচনা করা চলেনা। এজন্য প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ইহুদীরা শুধু তাদের ধর্মীয় সংকীর্ণতাকেই আঁকড়ে থেকেছে। কখনও রাষ্ট্রীয় ভিত্তি অর্জন করতে পারেনি। তিন হাজার বছর পরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় যে ইহুদী রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছে তা রাষ্ট্র গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। ইহুদীরা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিশে গিয়েছিল। যেভাবে অনেক জাতির লোকেরাই বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে মিশে গিয়েছে। সেই ইহুদীদেরকে বিভিন্ন দেশ থেকে টেনে এনে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। মূলত জার্মানির ইহুদী নাগরিকরাই ইসরাইলের জনসংখ্যার বড় অংশ। পৃথিবীর বহু জাতির মানুষেরই আলাদা রাষ্ট্রীয় ভিত্তি নেই এবং তার কোন প্রয়োজনও নেই। কারণ জাতি মানেই যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভিত্তিশীল হতে হবে এমন কোন কথা নেই।

তাই স্বাভাবিকভাবেই ইহুদীরাও সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে স্বাধীন রাষ্ট্রবিহীন অবস্থায়ই কাটিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর অধীনতাকেই তাদের মেনে নিতে হয়েছে। যে ফিলিস্তিনে তারা বসতি গড়ে সেটাও এমন একটি জায়গা যে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে এর চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এটা তিনটি মহাদেশের সংযোগস্থল এবং মহাদেশগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক যোগাযোগের কেন্দ্র। বিভিন্ন প্রাচীন সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী উপকুলীয় এই অঞ্চলে ইহুদীদের স্বাধীন রাজ্যের একমাত্র দৃষ্টান্ত হল দাউদের জেরুজালেম দখলের পরবর্তী সময়টুকু। জেরুজালেম দখলের পর দাউদ রাজ্য সীমানার বিস্তার ঘটালেন। ফিলিস্তিনের প্রায় সবটাই চলে আসে তার অধীনে। এ সময়ে অনেক ছোট ছোট জাতি ও অঞ্চল স্বাধীন ছিল।

দাউদ ফিলিস্তিন দখল করে ইহুদী রাজ্য স্থাপন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সভ্যতার বিকাশের স্বাভাবিক ধারাতেই বড় বড় সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে এবং ইহুদী রাজ্য হারিয়ে যায় সেগুলোর মাঝে। এমনকি অন্য সব ছোট রাজ্যগুলোও। ৯৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দাউদের মৃত্যুর পরে ইহুদীদের রাজা হন তাঁর পুত্র সলোমন । এই সলোমন ছিলেন একাধারে ইহুদীদের রাজা ও ধর্মীয়ভাবে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। এই সলোমনই জেরুজালেমে নির্মাণ করেন ইহুদীদের অতি পবিত্র ধর্মগৃহ। সলোমনের সময়কালটাই ইহুদী ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। এ সময়েই তারা সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌছে গিয়েছিল। নিজেদের রাজ্য, নিজেদের রাজধানী এবং নিজেদের ধর্মীয় উপাসনালয় নিয়ে তারা সুখী জীবন কাটিয়েছে।সলোমনের মৃত্যুর পর ইহুদী জাতি দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটি ইসরাইল রাজ্য অপরটি জুডা রাজ্য। ইসরাইলের রাজধানী হয় সামারিয়া আর জুডার রাজধানী হয় জেরুজালেম।

মেসোপটেমিয়ায় সে সময়ে অন্ধকার যুগ কাটিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে উত্তরের অ্যাসিরিয়া। ক্রমে অ্যাসিরিয়রা সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের অধিপতি হয়ে ওঠে। আশপাশের দেশগুলোও তাদের আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। ইহুদীরাও বাদ গেলনা। অ্যাসিরিয়রা এক সময় জুড়ার উত্তরের ইসরাইল রাজ্য কেড়ে নিল । ৭১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরিয়রা ইসরাঈলের রাজধানী সামারিয়া দখল করে ইহুদীদের দশটি গোত্রকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং মানব জাতির ইতিহাস থেকে ইসরাইল নামক এই রাষ্ট্রটি হারিয়ে যায় চিরতরে। থেকে যায় জুডা। জুডা থেকেই ইহুদীদের ধর্মের নাম হয় ‘জুডাইজম’ বা ‘জুডাবাদ’। দাউদ ও সলোমনের সময় থেকে শুরু করে জুডা রাজ্য যতদিন স্বাধীন ছিল সেটাই ছিল ইহুদী জাতির চার হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে সোনালী সময়। এই সময়েই তারা উপভোগ করতে পেরেছিল নিজেদের রাজ্যে স্বাধীন জীবন। কিন্তু এক সময়ে তাদের এই স্বাধীনতা মধ্যপ্রাচ্যে নতুনভাবে জেগে ওঠা শক্তিশালী ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের কাছে শেকলবন্দী হয়ে যায়। এর শুরুটা করেন ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট নেবুচাদনেজার। তাঁর রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০৪ থেকে ৫৬১ অব্দ পর্যন্ত। অ্যাসিরিয়দের পতনের পরে তিনি সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চলকে তাঁর পদানত করেন। ইতিহাসে তাঁর সকল বিজয় অভিযান অন্য আরও দশজন সাম্রাজ্যের অধিপতির মতই বৈচিত্রহীন। কিন্তু একটি নিষ্ঠুর অভিযান তাকে ইতিহাসে তাৎপর্যমন্ডিত করে তুলেছে। এটা হল ইহুদীদের জুডা রাজ্য ও জেরুজালেম ধ্বংসের অভিযান।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সাল! ইহুদী ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায় সূচিত হল এ বছর। জুডার হিব্রু রাজ্যে নেমে এল ধ্বংস আর প্রলয়ের বিভীষিকা। সম্রাট নেবুচাদনেজারের সৈন্যরা ধ্বংস করে দিল ইহুদী রাজ্য। ধ্বংস হল জেরুজালেম। দাউদের প্রাচীর আর সলোমনের ধর্মগৃহ গুড়িয়ে দেয়া হল। প্রায় ৪০/৪৫ হাজার ইহুদী নর-নারীকে শেকলবন্দি করে নিয়ে যাওয়া হল ব্যাবিলনে। সেখানে তারা ভূমিদাসে পরিণত হল। এটাই ইহুদীদের শেকলপরা ইতিহাস। ইতিহাসে এই বন্দিদশার নাম ‘ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা’।

জুডার ইহুদীরা নানাভাবে নেবুচাদনেজারের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যাচ্ছিল। মিসরীয়দের প্ররোচনায় এক পর্যায়ে তারা কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নেবুচাদনেজার জেরুজালেম ধ্বংসের জন্য সৈন্য পাঠান। ইহুদীদের অবাধ্যতাকে চিরতরে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার ইহুদীকে বন্দী করে নিয়ে আসলেন ব্যাবিলনে। ইহুদীদের এই করুণ ইতিহাসকে নিয়ে ‘অভিশপ্ত নগরী’ নামে এক অসাধারণ উপন্যাস রচনা করেছেন প্রয়াত লেখক এবং সাংবাদিক সত্যেন সেন। ব্যাবিলনে তাদের বন্দীজীবন এবং সেখান থেকে তাদের জেরুজালেমে প্রত্যাবর্তনের ঘটনা নিয়ে তিনি আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস রচনা করেন ‘পাপের সন্তান’ নামে।

৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস দখল করে নিলেন ক্যালদিয়ার রাজধানী ব্যাবিলন। এতদিন পরে ব্যাবিলনের বন্দি ইহুদীরা কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেল। সম্রাট সাইরাস কিছুসংখ্যক ইহুদীকে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ৪৮ বছর পর ক্যালদীয় নিপীড়নে জীবনী শক্তিহীন ইহুদীরা জেরুজালেমে ফিরে এসে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞের সূচনা করল। সেটা হল মুসার বাণী লিপিবদ্ধ করার কাজে হাত দেয়া। আর এর মধ্য দিয়েই ইহুদী ইতিহাসে সূচিত হল এক নতুন অধ্যায়। পারস্য সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে ফেপে ওঠা ইহুদি যাজকতন্ত্র তখন চেপে বসতে শুরু করে ইহুদীদের ঘাড়ে। ঢালাওভাবে মিথ্যা যুক্ত করে রচিত হয় ওল্ড টেস্টামেন্ট। একসময় ইহুদীদের ওপর নিরংকুশ আধিপত্য বিস্তারের জন্য যাজকতন্ত্র ওল্ড টেস্টামেন্টে যুক্ত করে জাতিত্বের বিশুদ্ধবাদী অনুশাসন।  আধিপত্য ও ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য ইবরানী ও ইসরাঈলী নবীদের শিক্ষাকে পায়ে মাড়িয়ে ইহুদীদের ঘাড়ে চাপানো হয় বিশুদ্ধবাদী অনুশাসন।

পারস্য সম্রাট সাইরাসের সময় থেকে আর্তাজারেক্সেসের সময় পর্যন্ত ব্যাবিলনের বন্দীদশা থেকে জেরুজালেম ও এহুদায় ফিরে এসেছিল ৪২৩৬০ জন ইহুদি (ওল্ড টেস্টামেন্ট, নবীদের কিতাব, ইষ্রা ২:৬৪)। এ সময়েই ইহুদিদের ধর্ম বিশ্বাসে ভর করে গোঁড়ামী ও রক্ষণশীলতা। মিসর ও মেসোপটেমীয় সাম্রাজ্যগুলোর হাতে ইহুদীরা বারবার পর্যদুস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও আর্য উত্তরসূরি পারসীয়রা তাদেরকে দেয় মুক্তি ও পৃষ্ঠপোষকতা। পারস্য সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতাই ইসরাইলী ধর্মীয় ধারায় জন্ম দেয় যাজকতন্দ্রের যা ভিত্তি স্থাপন করেছিল আজকের যায়নবাদের।

এরপরের পর্বে আমরা যাব সে ইতিহাসের কথায়।

(চলবে)