যেমন ছিল নবীজির সংসার
ইসলাম ডেস্ক।। স্ত্রীদের সাথে নবীজির ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা , আবেগ এবং নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক। ওহী নাযিলের পর ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন তিনি। সেই ভয় ও আশংকার কথা, সেই আশ্চর্য ঘটনার কথা সর্বপ্রথম খাদিজা রা. কাছেই খুলে বলেন।
বিদায় হজ্জের সময় সাহাবাদের নিয়ে পেরেশানীর কথা আয়েশার কাছে খুলে বলেন। তিনি আয়েশাকে বলেন ‘সাহাবাদের বললাম যারা কুরবানীর পশু সঙ্গে আনে নি তারা যেন মাথা মুন্ডন করে হালাল হয়ে যায়, অথচ তারা ইতস্তত করছে! এমন হবে জানলে আমি কুরবানীর পশু আনতাম না এবং আমিও হালাল হয়ে যেতাম!’
১. এমন আরো অনেক উদাহরণ আছে। তিনি তার ব্যাপারগুলো শেয়ার করতেন। স্ত্রীরা কখনো তাঁকে পরামর্শ দিতেন, আর কখনো শুধু পেরেশানীর সঙ্গী হতেন।
স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করা, মতামতকে গুরুত্ব দেয়া : মতুলনামূলকভাবে হাদিসে নারীদের নাকিসাতুল আকল বলা হয়েছে। এখানে আকল বলতে ইলমকে বুঝানো হয় নি। বুদ্ধি আর জ্ঞান এক বিষয় নয়। আর বুদ্ধির দিক দিয়ে অপরিপক্ক বলার মানেও এই না যে, সকল পুরুষই সকল নারীর চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। এরমানে এটাও না যে, আপনার স্ত্রীর আপনার চেয়ে বুদ্ধি কম এ কথা মনে করে/বলে আপনি তার কোনো কথাই শুনবেন না!
নবীজির কাছে ওহী আসে, তিনি জ গতের সকল পুরুষের চেয়ে সবদিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ! জ্ঞানের অভাব নেই, বুদ্ধির কমতি নেই। তারপরও নবীজি তাঁর প্রিয়তমাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করেছেন, পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় যখন সাহাবারা বাইতুল্লাহ যেতে না পারার দুঃখে নবীজির মাথা মুন্ডানোর নির্দেশকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না, তখন উম্মে সালামা রা. এর পরামর্শ মতে নবীজি নিজের মাথা মুন্ডন করে হালাল হয়ে যান। উম্মে সালমার পরামর্শ কার্যকর প্রমাণিত হয়। সাহাবারাও দেখাদেখি হালাল হয়ে যান।
২. মক্কা বিজয়ের সময়ও আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া ক্ষমা চাইতে এলে তাদের ক্ষমা করে দেয়ার জন্য উম্মে সালমা পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, একজন আপনার চাচার ছেলে এবং একজন আপনার ফুফুর ছেলে ও শালা।’ নবীজি পরে তাদের ক্ষমা করে দেন।
৩. স্বামী-স্ত্রীর মতামত সবসময় মিলবে এমনটা সাধারণত না হওয়ারই কথা। নবীজিরও কখনো কখনো স্ত্রীদের সাথে মতের অমিল হতো। নবীজি কখনো কখনো এ নিয়ে রাগও করতেন। কখনো স্ত্রীরা রাগ করতেন। কিন্তু এ কারণে নবীজি স্ত্রীদের সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার রহিত করে দেন নি। বরং তাদের বক্তব্য বলার অধিকার জারি রেখেছেন, তাদের কথা শুনেছেন, এবং তাদের পরামর্শের ওপর আমল করেছেন।
স্ত্রীর গোপনীয়তা রক্ষা করা : সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো স্ত্রীর গোপনীয়তারতা রক্ষা করা। নবীজি বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি সে, যে নিজের স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় অতঃপর সে এর গোপনীয়তা প্রকাশ করে বেড়ায়।৪.
স্ত্রীকে সম্মান করা : নবীজি তাঁর স্ত্রীদের সম্মান করতেন। সাফিয়া রা. আল্লাহর রাসূল বিয়েই করেছিলেন তাঁর সম্মান অক্ষুন্ন রাখার জন্য। সাফিয়া ছিলেন ইহুদিদের সরদারকন্যা।যুদ্ধবন্দী। সাহাবী দাহিয়া কালবি সাফিয়াকে বাদী হিসেবে পছন্দ করলে নবীজি অন্য একজন বাদীর বিনিময়ে তাঁকে মুক্ত করেন। এরপর আল্লাহর রাসূল চাইলেই ইহুদিদের সরদারকন্যাকে বাদী হিসেবে রেখে দিতে পারতেন। সে সময় মানুষের কত শত বাদী থাকতো! কিন্তু নবীজি তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদায় সম্মানিত করেন।
৫. একবার নবীজি স্ত্রীদের সাথে হজ্জের সফরে ছিলেন। পথে সাফিয়া রা. এর উট বসে পড়ে। যায়নাব রা. কাছে উট ছিল সবচেয়ে বেশি। নবীজি তাকে বললেন, ‘তোমার বোন সাফিয়াকে একটা উট ধার দাও।’ যায়নাব বললেন, ‘আমি দেবো একজন ইহুদিকে উট ধার?’
এ কথা শুনে নবীজি অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। মক্কায় পৌঁছেও যায়নাব রা. এর সাথে কথা বলেননি। মদীনায় ফিরে এসেও না। দু’মাস চলে যায় তিনি তার কাছে আসেননি এবং তার জন্য দিনও ভাগ করেননি। অবশেষে রবিউল আউয়াল মাসে আয়েশার মধ্যস্থতায় নবীজি তার কাছে যান। ইসলামের গ্রহণের পর কাউকে কাফের বলা মহাপাপ। এ কারণে যায়নাব রা. শাস্তির উপযুক্ত হয়েছিলেন।
৬. আরেকবারের কথা। আয়েশা রা. বলেন, ‘একবার আমি রাসূল সা. সাফিয়া সম্পর্কে বললাম যে, সে খাটো। তিনি বললেন ‘তুমি এমন মন্দ কথা বলেছো! তোমার এ কথা সমুদ্রের পানিতে মেশানো হলে সব ময়লা হয়ে যাবে।’
৭. আরেকবার আয়েশা রা. ও হাফসা রা. সাফিয়া রা. কে বললেন, ‘আমরা তোমার চেয়ে মর্যাদার অধিকারী, আমরা নবীজির স্ত্রী, তারউপর তার চাচাতো বোন।’ সাফিয়া রা. এতে ভীষণ দুঃখ পান। নবীজি সা. পরে এটা জেনে তার সম্মানের জায়গা তাঁকে বুঝিয়ে দেন। নবীজি সা. বলেন, ‘তুমি কেন তাদেরকে একথা বললে না যে, তোমরা আমার চেয়ে মর্যাদার অধিকারী হতে পারো না, কারণ আমার স্বামী মুহাম্মাদ, আমার পিতা হারুণ এবং চাচা মূসা।’
৮. স্ত্রীর আবেগ-অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রাখা। নবীজি স্ত্রীদের রাগ-খুশির প্রতি লক্ষ রাখতেন। স্ত্রীর মনকে বুঝার চেষ্টা করা এবং আবেগ-অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রাখাও সংসারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। একবার নবীজি আয়েশাকে বলেন, ‘আয়েশা, আমি বুঝতে পারি, তুমি কখন আমার ওপর খুশি থাকো আর কখন আমার ওপর রেগে থাকো!’ আয়েশা বললেন, ‘কীভাবে বুঝেন?’
নবীজি বললেন, ‘তুমি আমার ওপর খুশি থাকলে বলো ‘মুহাম্মদের রবের কসম’
আর আমার ওপর নারাজ থাকলে বলো ‘ইবরাহীমের রবের কসম!’ আয়েশা বললেন, ঠিক বলেছেন, কিন্তু আল্লাহর শপথ আমি শুধু মুখেই আপনার নাম ত্যাগ করি। অন্তরে সবসময় আপনি থাকেন।
৯. আমাদের পথপ্রদর্শক রাসূল সা. অন্যান্য বিষয়ের মতো তাঁর উম্মাহকে সংসারের প্রতিটি ক্ষেত্রেও সফল ও সুখী হওয়ার পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। (সূত্র: [১. মুসলিম— ১৩০] [২. বুখারী : ১/৩৮০] [৩. ইবনে হিশাম : ২/৪০০] [৪. মুসলিম : ২৫৯৭] [৫. মুসলিম : ১/৫৬৪, আবু দাউদ : ৩৯৩১] [৬. মুসনাদ : ৬/৩৩৭,৩৩৮। ফতহুর রাব্বানি : ২২/১৪৩] [৭. আবু দাউদ : ৪৮৬৫] [৮. মুসনাদ : ৩/১৩৫,১৩৬। তিরমিযী : ৩৮৯৪] [৯. মুসলিম : ২৪৩৯)