আমেরিকার তৃতীয় ভাষা বাংলা
আমেরিকানদের জন্য শেখা খুবই জরুরি এমন ১৩টি ভাষার মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে বাংলা। এ জন্য রয়েছে সরকারি বৃত্তিও। চাহিদা আছে, জানা লোকের সংখ্যা কম- এমন হিসাব থেকে তালিকাটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক ব্যুরো (ব্যুরো অব এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল অ্যাফেয়ার্স-ইসিএ)। ভাষা শিক্ষায় অর্থ সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। ক্রিটিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ স্কলারশিপ (সিএলএস) নামের এই কর্মসূচির বৃত্তি নিয়ে ইতিমধ্যেই বাংলা শিখেছেন লিজ টমাস ও পেইজ গিয়ারমোনাসহ কয়েকজন।
বাংলা ভাষার সান্নিধ্যে এসে তাঁরা যে প্রতিক্রিয়া জানান তা যেকোনো বাংলাভাষীকে মুগ্ধ করবে। যুক্তরাষ্ট্রে এই বৃত্তির আরেক নাম ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডুকেশন প্রগ্রাম’ (এনএসইপি)। তালিকায় শেষ অবস্থানটি উর্দুর। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভাষা ১৩টি হচ্ছে-আরবি, আজারবাইজানি, বাংলা, চীনা (ম্যানডারিন), হিন্দি, ইন্দোনেশিয়ান, জাপানি, কোরিয়ান, ফার্সি, পাঞ্জাবি, রুশ, তুর্কি ও উর্দু।
পেইজ গিয়ারমোনা সিএলএস স্কলারশিপ ডট ওআরজি সাইটে লেখেন, মাই ফেভারিট বেঙ্গলি ফ্রেইজ ইজ, ‘মেঘ ডাকছে’, ‘হুইচ মিনস’, ‘রোলিং থান্ডার’ (ঘূর্ণায়মান বজ্র)। গিয়ারমোনা লিখেছেন, মেঘ ডাকছে’র ইংরেজি অনুবাদ করা যায় ‘দ্য ক্লাউড ইজ কলিং’। কিন্তু মেঘ ডাকছে’ কথাটির গভীরতা এই ইংরেজি বাক্যে ধরা পড়ে না। এই ধারণা থেকেই আমি উপলব্ধি করতে শুরু করি যে দ্বিতীয় কোনো সংস্কৃতির ভাষা মানেই হচ্ছে এর ভেতরে জটিলতা থাকবে, গভীরতাও থাকবে।
গিয়ারমোনা আরো লেখেন, এখন বাংলা আমার জীবনের অনেক অংশ জুড়েই আছে। এর সংস্কৃতি, দেশ, মানুষ, ইতিহাস-সবই সুন্দর, সমৃদ্ধ ও মনোলোভা। বাংলা ভাষা বুদ্ধিমত্তা ও আবেগে ঋদ্ধ। এই ভাষা দিয়ে মানবিক অভিজ্ঞতার এমন কিছু অংশ দেখার সুযোগ হয়, যা ইংরেজি বা অন্য কোনো জার্মানিক মৌলের ভাষা দিতে পারে না। একই বৃত্তিতে বাংলা শিখেছেন লিজ টমাস। সিএলএস স্কলারশিপের সাইটে লিজ লেখেন, স্বীকার করছি, প্রথমবার বাংলাদেশে যাওয়ার আগে দেশটির স্বাধীনতার ইতিহাস আমার তেমন জানা ছিল না। তবে তাদের স্বাধীনতা লাভের পেছনে যে ভাষার একটা ভূমিকা রয়েছে এ বিষয়টি একটু জানতাম। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ইতিহাস ও ভাষাকে কী দরদ দিয়ে ভালোবাসে তাও আমার জানা হতো না বাংলাদেশে না গেলে। আসলে বিষয়টি আপনিও বুঝবেন না, যদি না দেশটিতে কিছু সময় কাটান।
নিবন্ধের ‘ইন এ ওয়ার্ড’ অংশে লিজকে বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু কথা লিখতে হয়েছে। লিজ লেখেন, ইংরেজি লাভ শব্দটি বাংলা ভাষায় নানা শব্দেই বোঝানো সম্ভব। তবে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘ভালোবাসা’ কথাটি। এখানে আমি ভালো থাকার সঙ্গে জীবনযাপনের যোগসূত্র খুঁজে পাই। লিজ এখন আমেরিকার ওয়াশিংটনে কর্মস্থলে। আছেন জনস হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক পদে। বাংলা ভাষা শেখার সুফল জানাতে গিয়ে লিজ লেখেন, ‘বাংলাদেশ, লাইবেরিয়া এবং নর্থ ও সাউথ ডাকোটার মানুষের পানি ও স্যানিটেশনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি গবেষণা করি। ব্যক্তিগত ও পেশাগত দুই জীবনেই আমি প্রতিদিন বাংলা ব্যবহার করি।
আমার অনেক দায়িত্বের মধ্যে একটি হচ্ছে প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন লেখা তৈরি। এ ক্ষেত্রে এই নিশ্চয়তাটা দেওয়ার চেষ্টা করি যে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদটি যথার্থ হয়েছে। স্থানীয় জনগণ কথাবার্তায় ব্যবহার করে এমন প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করাটাকে আমি বরাবরই প্রাধান্য দিই।’ সিএলএস বাংলা প্রগ্রামের আওতায় লিজ প্রথম বাংলাদেশে আসেন ২০১৩ সালে। পরের বছরও তাঁকে এই কর্মসূচির জন্য বাছাই করা হয়।
সিএলএস বাংলা প্রগ্রামের আওতায় পেইজ গিয়ারমোনাকে ২০১৬ সালে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। পেইজ লেখেন, বাংলা শেখার অনুপ্রেরণা আমাকে দিয়েছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, যে কি না প্রথম প্রজন্মের একজন আমেরিকান-বাঙালি’। বাংলায় প্রথম স্বচ্ছন্দে কথা বলার অভিজ্ঞতাটিও তার দারুণ। পেইজ লেখেন ‘প্রগ্রামের শেষ দিককার একটি স্মৃতি। বিখ্যাত মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শান্তিনিকেতনে গিয়েছি বন্ধুর সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটিতে। ট্রেনে করে ফিরে আসব হোস্ট নগরীতে। কিন্তু আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছিল। দ্রুত বাক্সপেটরা গুছিয়ে রিকশা ডাকলাম (স্থানীয় বাসিন্দাদের একে বলে টুকটুক)।
পথে রিকশাওয়ালার সঙ্গে একটু ভাববিনিময় করতে গিয়ে আবিষ্কার করি আমি তার সব কথাই বুঝতে পারছি, আমার কথাও তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। পেইজ লেখায় জানিয়েছেন, আমেরিকার পররাষ্ট্র বিভাগে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন তিনি দেখছেন; তাঁর বিশ্বাস এ ক্ষেত্রে তাঁর বাংলা ভাষা জানাটা বড় যোগ্যতা হিসেবে কাজ করবে।