বন্ধ হয়ে গেল রাজশাহীর শেষ সিনেমা হলটিও
বিনোদন প্রতিবেদক : রাজশাহী মহানগরীর একমাত্র ও সবশেষ সিনেমা হল ‘উপহার’ শেষ পর্যন্ত বন্ধই হয়ে গেল। ‘নাকাব’ সিনেমা প্রদর্শনের মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই প্রেক্ষাগৃহের পথচলা। বৃহস্পতিবার (১১ অক্টোবর) রাত ১২টা পর্যন্ত চলে এর শেষ শো।
উপহার সিনেমা হলের ম্যানেজার তপন কুমার দাস বলেন, মালিকের নির্দেশনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এ হলের শেষ শো চলে। এরপর হলটি বন্ধ হয়ে যায়। রাতেই হল বন্ধের নোটিশ দিয়ে দেয়া হবে বলে জানান উপহারের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, মন্দা ব্যবসার কারণেই রাজশাহীর সিনেমা হলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে। এর অংশ হিসেবেই উপহারও বন্ধ হয়েছে।
১৯৯১ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী রাজশাহী নগরীসহ জেলায় সিনেমা হল ছিল ৫৫টি। তবে জেলায় বর্তমানে উপহারসহ চালু ছিল মাত্র পাঁচটি সিনেমা হল। এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল উপহার। চালু থাকছে, পবার নওহাটার বাবুল, মোহরপুরের কেশরহাটের দিনান্ত, তানোরের আনন্দ ও বাগমারার মাদারিগঞ্জে অন্তরা।
রাজশাহী নগরের এক সময় জনপ্রিয় সিনেমা হল স্মৃতি (অলকা), উৎসব, বর্ণালী, লিলি ও উপহার। এসব সিনেমা হলের নামে এখনও এলাকার মোড়গুলোর নামকরণ রয়ে গেছে। নেই শুধু সিনেমা হলগুলোই। একে একে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কিছুটা হলেও শহরের একমাত্র উপহার সিনেমা হলটিতে সারা বছরই দর্শক সমাগম হতো।
নগরীতে প্রেক্ষাগৃহ ছিল ৬টি। এগুলোর মধ্যে অলকা পরবর্তী নাম স্মৃতি, কল্পনা পরবর্তী নাম উৎসব, স্নিগ্ধা পরবর্তী নাম উপহার এবং বর্ণালী ও লিলি। এছাড়াও নগরের উপকণ্ঠে কাটাখালীতে নতুন পরবর্তী নাম রাজতিলক এবং নওহাটায় দুটির একটি নাম ছিল বাবুল ও অপরটি লিলি। এগুলোর মধ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রেক্ষাগৃহটি ছিল রাজশাহীর বর্ণালী সিনেমা হল।
২০০৭ সালে শহরের সবচেয়ে পুরনো প্রেক্ষাগৃহ স্মৃতি সিনেমা হল ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে রাজশাহীর ভিক্টোরিয়া ড্রামাটিক ক্লাবের উদ্যোগে নাট্য আন্দোলন এগিয়ে নিতে নির্মিত হয়েছিল ‘রাজা প্রমথনাথ টাউন হল’। প্রতিষ্ঠা থেকে সেখানে নিয়মিত বাংলা সাহিত্য ও নাট্যচর্চা হতো।
১৯১৯ সালের ২ এপ্রিল ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কাছ থেকে হলটি কিনে নেয় রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন। পরে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে অলকা সিনেমা হল নামে যাত্রা শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে স্মৃতি সিনেমা হল নামে হলটির নামকরণ হয়। পরে ওই হল ভেঙে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন বহুতল ভবণ নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে।
নগরীর আলুপট্টির উৎসব সিনেমা হলে ২০১০ সালের জুলাইয়েও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। পরে তা ভেঙে স্বচ্ছ টাওয়ার নামে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। নগরীর কাদিরগঞ্জ ও আমবাগানের মধ্যবর্তী এলাকায় ছিল বর্ণালী সিনেমা হল। বর্তমানে হলটি না থাকলেও শহরের ওই এলাকার নামকরণ রয়েছে বর্ণালীর মোড় নামেই। শহরের পাশেই মোল্লাপাড়ার লিলি সিনেমা হলটিও আর নেই। সেখানে করা হয়েছে মার্কেট।
উপহার সিনেমা হলের দারোয়ান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হলটি যখন প্রথম চালু হয়, তখন থেকেই এখানে কাজ করছি। হঠাৎ শুনতে পাই, হলটি বন্ধ হয়ে যাবে। তখন থেকেই চিন্তায় আছি। কারণ, অন্য কোনও কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই এবং ব্যবসা করার মতোও অর্থ নেই।
সিনেমা হলটি বন্ধের ঘোষণার পর থেকেই রাজশাহীর চলচ্চিত্র সংসদসহ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মানববন্ধন, অবস্থানসহ বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য, ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ডা. এফ এম এ জাহিদ, রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ও চলচ্চিত্রনির্মাতা আহসান কবীর লিটন, ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক এবং সিনেমাটোগ্রাফার ও অভিনেতা মাহমুদ হোসেন মাসুদসহ অনেক গুণীজন বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি ড. সাজ্জাদ বকুল বলেন, বিভাগীয় একটি শহরে একটি সিনেমা হল থাকবে না, এটা একটি অশনিসংকেত।
ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ডা. এফ এম এ জাহিদ বলেন, এভাবে সব সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হলে, নতুন প্রজন্ম সিনেমা হল আর কখনও চিনবে না, সিনেমার সঙ্গে পরিচয়ও ঘটবে না। তাই ঐতিহ্য হিসেবে হলেও বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে একটি সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এজন্য সমাজের দায়িত্ববান লোকদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি।
অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক এই হলে তাঁর ছবি দেখার স্মৃতিচারণ করে হলটিকে রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
নগরবাসীর বিনোদন নিশ্চিত করতে রাজশাহী সিটি ভবনের জায়গায় নির্মাণাধীন সিটি সেন্টারে হবে আধুনিক সিনেকমপ্লেক্স, যা ৯ বছরেও সম্পূর্ণ হয়নি। তবে আবারও এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন নির্বাচিত হওয়ায় সব কাজেই গতি ফিরে এসেছে। তাই আগামী এক বছরের মধ্যেই এই পুরো প্রকল্পটি শেষ হবে বলে আশা করছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক। আর নগরবাসীর বিনোদনের কথা মাথায় রেখেই চুক্তি অনুযায়ী সিটি সেন্টারের ভবনটিতে সিনেকমপ্লেক্স রাখার কথা জানান তিনিও।
এদিকে, ‘নাকাব’ সিনেমার মধ্যদিয়ে ৪৩ বছরের দীর্ঘ যাত্রার ইতি টানলো উপহার। শেষ প্রদর্শনীও ছিল হাউসফুল। সিনেমা দেখে ফেরার পথে অনেকেই অতীতের স্মৃতিচারণ করে গেছেন। ১৯৭৪ সালে স্নিগ্ধা নামে পর্দা ওঠে উপহারের। মাঝখানে কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৮৫ সালে ‘অন্যায় অবিচার’ নামের সিনেমার প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে উপহার নামে যাত্রা শুরু করে হলটি। হলটি ২০১২ সাল থেকে উপহার সিনেমা হলের ডিজিটাল প্রজেকশন ব্যবস্থাপনায় ছিল চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া। শনিবার দুপুরের পর প্রজেকশন যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে গেছে সংস্থাটি। গত ১১ অক্টোবর রাত ১২টায় শেষ প্রদর্শনী মধ্য দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে রাজশাহী মহানগরীর একমাত্র টিকে থাকা উপহার সিনেমা হলটি। আরটিভি অনলাইন