বিদায় হজের ভাষণে যা বলেছিলেন রাসূল সা.
আমিন মুনশি: ওহি নাজিল ও নবি জীবনের পরিপূর্ণতা সাধিত হয়েছে বিদায় হজের ভাষণে। এটি ছিল রাসূল (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক ভাষণ। যা তিনি ১০ম হিজরি সনের ৯ জিলহজ আরাফার দিনে জাবালে রহমতের ওপর দাঁড়িয়ে উপস্থিত সোয়া লাখ সাহাবির উদ্দেশে এবং পরদিন ১০ জিলহজ ঈদের দিন প্রদান করেছিলেন। এই দুই দিনে দেওয়া তাঁর বক্তব্য বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে পরিচিত।
মহানবি (সা.) তাঁর ঐতিহাসিক এই ভাষণের প্রারম্ভে মহান আল্লাহর হামদ ও প্রশংসা জ্ঞাপন করার পর বলেন, হে লোকসকল! আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদিগকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার।’ (আল-কোরআন, পারা: ২৬, সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
সুতরাং কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে। সব মানুষ আদম (আ.)-এর সন্তান; আর আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট।
হে সভ্যমণ্ডলী! এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই; তোমাদের অধীনদের (দাস-দাসী) প্রতি খেয়াল রাখবে- তোমরা যা খাবে, তাদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরও তা পরাবে। সাবধান! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।
হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, সন্তুষ্টচিত্তে সম্পদের জাকাত প্রদান করবে, স্বীয় প্রভুর ঘরে এসে হজ পালন করবে এবং নেতাদের আনুগত্য করবে; তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।
হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা শোনো। হয়তো আমি এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব না।
হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতো তোমাদের ওপর নিষিদ্ধ ও পবিত্র তোমাদের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত। অচিরেই তোমরা তোমাদের মহান প্রভুর সাক্ষাতে উপনীত হবে। তখন তিনি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। আমি তো তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তোমাদের কারও কাছে যদি কোনো আমানত গচ্ছিত থাকে, তা তার প্রাপকের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো। তবে তোমাদের মূলধন বহাল থাকবে। মহান আল্লাহ ফয়সালা দিয়েছেন যে আর কোনো সুদ নয়। আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সব সুদ রহিত করা হলো। তোমরা কোনো জুলুম করবে না, বরং তোমাদের প্রতিও কোনো জুলুম করা হবে না। জাহিলি যুগের যত রক্তের দাবি, তা সব রহিত করা হলো। প্রথম আমি রিবয়া ইবন হারিস ইবন আবদুল মুত্তালিবের শিশুপুত্রের রক্তের দাবি রহিত করলাম।
হে লোকসকল! নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের এই ভূখণ্ডের উপাস্য হওয়ার ব্যাপারে চিরদিনের জন্য নিরাশ হয়ে গেছে। তবে এ ছাড়া তোমরা যা তুচ্ছ মনে করে থাকো, এমন বহু কাজ রয়েছে, যাতে তার আনুগত্য করলে সে খুশি হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার থেকে সাবধান থেকো।
হে মানবম-লী! নিশ্চয়ই মাসসমূহকে আগ-পিছ করা বস্তুত কুফরিকেই বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফিররা বিভ্রান্ত হয়। অথচ কাল (সময়) তার নিজস্ব নিয়মে প্রকৃতিতে আবর্তিত হয়।
হে মানবম-লী! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক প্রাপকের (উত্তরাধিকারীর) জন্য তার অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নিজের জন্মদাতা ছাড়া অন্যের সঙ্গে নিজের বংশসূত্র স্থাপন করে এবং যে নিজ মনিব ছাড়া অন্যকে মনিব বলে স্বীকার করে, তার ওপর আল্লাহর লানত। সব ঋণ পরিশোধের যোগ্য ও অধিকার, ধারকৃত বস্তু ফেরতযোগ্য, উপঢৌকনেরও বিনিময় প্রদান করা উচিত, জামিনদার জরিমানা আদায় করতে বাধ্য থাকবে। কারো জন্য তার অপর ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে নিজে সন্তুষ্টচিত্তে তা প্রদান না করে। কোনো নারীর জন্য তার স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামীর অর্থ-সম্পদ থেকে কাউকে কিছু দেওয়া বৈধ নয়। তোমরা কখনো একে অন্যের ওপর জুলুম কোরো না। নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে এবং তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার আছে। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হলো তারা তোমাদের বিছানায় কাউকে কখনো স্থান দেবে না, যা তোমাদের সবার অপছন্দনীয় এবং তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, তারা কোনো অশ্লীল বা লজ্জাকর কাজে লিপ্ত হবে না। তোমরা নারীদের প্রতি কল্যাণকামী হও। কারণ, তারা তোমাদের কাছে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তারা তো নিজেদের জন্য কিছু করে না। তোমরা তো তাদের আল্লাহর আমানতস্বরূপ গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বাণীর মাধ্যমে তাদের সতীত্বের ওপর অধিকার লাভ করেছ (বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য অধিকার লাভ করেছ)।
অতএব, হে মানবম-লী! তোমরা আমার কথা অনুধাবন করো। আমি তো পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের মাঝে এমন সুস্পষ্ট দুটি বিষয় (বিধান) রেখে গেলাম, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না- (১) আল্লাহর কিতাব এবং (২) তাঁর নবি (সা.)-এর সুন্নাহ।
হে মানবমণ্ডলী! তোমরা অবশ্যই জেনে রেখো, প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই এবং মুসলিমগণ ভ্রাতৃপ্রতিম। সুতরাং তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না। সবাই শোনো, এখানে উপস্থিত লোকেরা যেন এই বার্তাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়। হয়তো অনেক অনুপস্থিত লোক উপস্থিত শ্রোতা অপেক্ষা অধিক হেফাজতকারী হবে।
শোনো! তোমরা আল্লাহর দরবারে আমার ব্যাপারে যখন জিজ্ঞাসিত হবে, বলো তখন কী উত্তর দেবে? উপস্থিত সাহাবিরা উত্তর দিলেন, আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আপনি যথাযথ পালন করেছেন; ইয়া রাসুলুল্লাহ! (হে আল্লাহর রাসুল!) আপনি রিসালাতের হক পূর্ণরূপে আদায় করেছেন এবং উম্মতকে কল্যাণপথের দিশা দিয়েছেন। তারপর তিনি সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি কি পৌঁছে দিয়েছি?’ উপস্থিত সাহাবিরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি পৌঁছিয়েছেন।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আকাশের দিকে শাহাদাত অঙ্গুলি উত্তোলন করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষি থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষি থাকুন।’ অতঃপর এই আয়াত নাজিল হয়: ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে ইসলাম দিয়ে আমি সন্তুষ্ট হলাম।’ (আল-কোরআন, পারা: ৬, সূরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৩)
সূত্রঃ বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা; সীরাতুন নবী (সা.), ইবনে হিশাম (র.), খ-: ৪, পৃষ্ঠা: ২৭৩-২৭৭; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর (র.), খ-: ৫, পৃষ্ঠা: ১৯৮ ও ৩২০-৩৪২, ই. ফা. বা.