গণহত্যার শিকার ১০ রোহিঙ্গা পরিবার যেভাবে পালিয়েছিল
নিউজ ডেস্ক : রেহেনা খাতুন স্বপ্ন দেখছিলেন তার স্বামী বাড়িতে ফিরে এসেছেন। কোনো কথাবার্তা না বলেই তিনি হঠাৎ করে ঘরে ঢুকেছেন। কিন্তু আমগাছের ডালপালায় ছায়া সুদৃশ্য কাঠের ঘরে প্রবেশের পর তিনি কোনো কথা বলেননি।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড অবস্থান করে তাড়াহুড়ো করে চলে গেছেন।
এর মধ্যে রেহেনার ঘুম ভেঙে গেছে। কক্সবাজারের পাহাড়ের পাদদেশে একটি নোংরা ত্রিপলের ভেতরে তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠলেন।
স্বপ্নে যাই দেখুক না কেন, প্রাণের স্বামী নূর মোহাম্মদ আর কোনো দিন তার কাছে ফিরে আসবেন না। সবুজ গাছপালায় ঢাকা বাড়িটিতে এসে তাকে কোনোদিন ডাকবেন না।
রেহানার স্বামী হলেন সেই হতভাগা ১০ রোহিঙ্গার একজন, যাদের গত বছরের সেপ্টেম্বরে উপকূলীয় গ্রাম ইন দিনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল।
তাদের সেই সুশ্রী কাঠের ঘরটিও ভস্মীভূত করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের সারা জীবনের অর্জন ছিল ওই ঘরটির ভেতরেই।
ইন দিনের অধিকাংশ বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরে বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ কিছু দিন আগেও সেখানে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বসবাস করত, যাদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের বুনট ছিল অসাধারণ। তার পরস্পরের সহায়তায় এগিয়ে আসতেন, দুঃখকষ্টে সহানুভূতি জানাতেন।
তাদের কয়েক প্রজন্মের ইতিহাস কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী তাদের ধরে এনে রশি দিয়ে বেঁধে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে সামনেই কবর খোঁড়ে। ওই সময় স্থানীয় বৌদ্ধরা সেনাদের সহায়তা করেন। পর দিন সকালে তাদের গুলি ও কচুকাটা করে হত্যা করা হয়েছে।
এর পর আধা খোঁড়া কবরে তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়। অনেকের প্রাণবায়ু বের হওয়ার আগেই তাদের ধরে ধরে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছিল।
এই বিভৎস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কয়েক মাস চলে গেলেও পরিবার ও স্বজনরা তাদের খোঁজ জানতেন না। রেহেনা খাতুনের মতো তারা অপেক্ষায় ছিলেন একদিন হয়তো তাদের প্রাণের স্বামী কিংবা সন্তানরা ফিরে আসবেন।
ওই দিন মিয়ানমারের জাতিগত নির্মূল অভিযান থেকে বেঁচে যাওয়া স্বজনরা দুশ্চিন্তা ও আতঙ্ক নিয়ে সমুদ্রতীরে তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু দিন ফুরিয়ে সূর্য ডুবে গেলেও তারা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেননি।
সেদিনের ঘটনাটি ছিল এমনই বিভৎসতায় ভরা। ইন দিন থেকে পালিয়ে আসা তিন নারী ছিলেন গর্ভবতী।
মৌসুমি বৃষ্টির মধ্যে বন, জঙ্গল ও দীর্ঘ ফসলের ক্ষেত পাড়ি দিয়ে একসময় তারা নাফ নদীর তীরে পৌঁছান।
হাঁটতে হাঁটতে তারা ভিজে জবুথবু হয়ে গিয়েছিলেন। প্রাণে ভর করছিল আতঙ্ক ও অমানিষার অন্ধকার। তারা যখন টহলরত সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলেন, তখন দেখছিলেন তাদের গ্রাম, সোনার ফসল ও বসতবাড়ি আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে।
এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে বহু লাশ তাদের সামনে পড়েছিল। সামান্য খাবার ও পানি নিয়ে দিনের পর দিন হাঁটতে হয়েছে তাদের।
তবে তারা কেবল একা ছিলেন না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
মিয়ারমার অস্বীকার করলেও জাতিসংঘের ভাষায়- এটি ছিল জাতিগত নিধনের জ্বলন্ত উদহারণ, যা পাঠ্য বইয়ে জায়গা পেতে পারে।
দেশটির সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জো হেটাই বুধবার বলেছেন, ওই গণহত্যার দায়ে তারা সাত সেনাসদস্যকে কারাদণ্ড দিয়েছেন।
তিনি বলেন, এটি খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ। এতে বোঝা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে যারা আইন লঙ্ঘন করেছে, তাদের দায়মু্ক্তি দেয়া হয়নি। মিয়ানমারে পরিকল্পিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ নেই।
গত বছরের আগস্টের পর থেকে নাফ নদীর তীর পর্যন্ত ছিল রোহিঙ্গা ঢল। নদীর ওপারেই বাংলাদেশ ও তাদের নিরাপদ আশ্রয়।
নৌকার মাঝিদের নিজেদের সোনা গহনা দিয়ে তারা নদী পার হয়েছেন।
ওই রাতে নদী পার হতে তাদের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। ভয়, আতঙ্ক ও অসুস্থতায় তারা বমি করছিলেন।
কক্সবাজারে এসে এখন তারা স্বামী, বাবা, ভাই ও সন্তান ছাড়াই জীবনযুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন।
ওই গণহত্যার পর সাত মাস চলে গেছে। কিন্তু তারা তাদের দুঃখ ভুলতে পারেননি। দুর্ভোগের কথা বলতে গিয়ে এক রোহিঙ্গা মা মূর্ছা গিয়েছেন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন অনেকেই।
রেহেনা খাতুনের মতো তাদের সবাই হারানো স্বজনদের নিয়ে বিভিন্ন স্বপ্ন দেখে বেড়ান। যেমন তাদের স্বামীরা ফিরে এসেছেন, সন্তানরা মসজিদে নামাজ আদায়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন তো রয়েছেই।
এক নারী স্বপ্ন দেখছেন, তার স্বামী পেটে জখমের ওপর দুই হাত চেপে রেখেছেন। সেই জখম থেকে তাদের আঙুল চুইয়ে রক্ত ঝরছে।
রাতে তাদের ওপর যেমন দুঃস্বপ্ন এসে ভর করে, তেমনি দিনেও তাদের সামান্যতম স্বস্তি থাকে না। সবসময় তাদের চোখে ভেসে উঠছে, সেনাবাহিনী তাদের সামনে দিয়ে লোকজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হত্যা করছে।
আব্দুল আমিন কীভাবে যে বেঁচে আছে, তা নিয়ে তাদের ঘোর এখনও যেন কাটছে না।
গত বছরের ২৭ আগস্ট সেনাবাহিনী ইন দিন গ্রামে ঢুকে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে শুরু করে। স্থানীয় বৌদ্ধ প্রতিবেশী ও পুলিশ তাদের সহায়তা করে।
১৯ বছর বয়সী আমিন বলল, সেনাবাহিনী প্রবেশের পর শতাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে তাদের পরিবারও পাশের জঙ্গলে পালিয়ে ছিলেন।
চার দিন পর ইন দিন যখন ভস্মীভূত হয়ে যায় ও ঘনজঙ্গলভেদ করে গুলির শব্দ আসা বন্ধ হয়, তখন তারা সমুদ্র উপকূলের দিকে পালাতে শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ধরপাকড় থেকে বাঁচতে সেখানে আগে থেকেই কয়েক হাজার গ্রামবাসী জড়ো হয়েছিলেন। এ সময়ে সেনাসদস্যরা এসে উপস্থিত হয় এবং তাদের মাথা নুইয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ার নির্দেশ দেয়।
আমিন তার মা নুরুশার পাশেই গুটিশুটি মেরে ছিলেন। তার মা নিজের ওড়না দিয়ে তার মাথা ঢেকে রাখেন। সেনাবাহিনী তাকে খেয়ালই করল না, হয়তো নারী ভেবেছিল। কিন্তু তার ভাই শাকের আহমেদকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল।
আমিন জানান, আমি জানি না, ওরা কেন আমার ভাইকে নিয়ে গেল, কেন আমাকে চোখে পড়ল না। আসলে আল্লাহই আমাকে বাঁচিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সেনাসদস্যরা পুরুষদের ধরে ধরে একটা গোপন স্থানে নিয়ে যেত। তাদের পরিবারগুলো সমুদ্রতীরে সারা রাত হতাশা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। রাত শেষ হয়ে গেলে তারা আবার সেই জঙ্গলে ফিরে আসেন। এর পর নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচাতে আটক পুরুষদের রেখেই একসময় বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
আবদু শাকুর তার ১৮ বছর বয়সী কিশোর ছেলে রাশিদ আহমেদের অপেক্ষায় পাঁচ দিন জঙ্গলে ছিলেন। এর মধ্যে বাকি রোহিঙ্গারা চলে গেছেন। শাকুর বনের ভেতরে একাকীত্ব বোধ করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ও বুকে দানা বাধছে।
কিন্তু তিনি পালিয়ে আসতে চাইলেও তার স্ত্রী সাবিহা হাতু বাধা দিচ্ছেন। স্বামীকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ছেলেকে ছাড়া তিনি বাংলাদেশে আসবেন না।
সাবিহা বলেন, আমি সন্তানকে না নিয়ে কোনোভাবেই যাব না।
কিন্তু শাকুর বলেন, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। তুমি যদি এখানে থাকতে চাও, তবে তারা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে।
অনেক তর্কের পর তিনি স্ত্রীকে বলেন, আমাদের অন্য তিন সন্তানকে তো বাঁচাতে হবে।
রাশিদ ছিলেন তাদের বড় সন্তান। এক উজ্জ্বল কর্মঠ কিশোর, যে সারাক্ষণ বই পড়তে ভালোবাসত।
তিনি ভেবেছিলেন, নিশ্চিতভাবে তারা রাশিদকে ছেড়ে দেবে।
কিন্তু তাদের বড় ছেলে আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। ইন দিনের ১০ রোহিঙ্গার সঙ্গে তাকেও কচুকাটা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বসে রয়টার্স সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয় আব্দু শাকুরের। তিনি বলেন, সেদিন আমরা ঠিক কাজটিই করেছিলাম। আমি প্রচণ্ড আতঙ্কিত ছিলাম। আমাকে ওই জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে।
তার সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন তার স্ত্রী পেছনে বসে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন।
সময়টা এমন যে বাংলাদেশে পালাতে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছিল। দলবদ্ধ হয়ে তারা হাঁটছিলেন। কখনও কখনও কয়েক হাজার একসঙ্গে ছিলেন। এতে করে সমুদ্র উপকূলে রাখাইনের বনে বিশাল পথরেখা পড়ে গিয়েছিল।
রাতে ছেঁড়াখোঁড়া ত্রিপলের নিচে যখন নারী ও শিশুরা ঘুমাচ্ছিলেন, পুরুষরা তখন জেগে পাহারা দিতেন। মৌসুমি বৃষ্টিতে কখনও তারা একেবারেই ঘুমাতে পারতেন না।
এই বেপরোয়া রোহিঙ্গা ঢলে শাকির আহমেদের স্ত্রী রাহামা খাতুনও ছিলেন। তখন তার গর্ভে সাত মাসের সন্তান। এ ছাড়া তার আরও আট সন্তান রয়েছে। যাদের বয়স এক থেকে ১৮ বছর।
অন্য রোহিঙ্গাদের মতো তাদেরও ইন দিন থেকে পালাতে হয়েছিল। তাদের পরনে শরীর ঢাকার মতো যথেষ্ট কাপড়ও ছিল না।
তিনি বলেন, ঘর থেকে আমরা কিছু নিয়ে বের হতে পারিনি। এমনকি একটা খাবার প্লেটও না।
তারা ডোবা থেকে পানি ও অন্য শরণার্থীদের কাছ থেকে খাবার নিয়ে জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
রাহামা বলেন, পিচ্ছল পথ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তিনি পা টেনে টেনে চলছিলেন। পেটের অনাগত সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে ভয়ে ছিলেন তিনি। আবার অন্যদের থেকে পেছনে পড়ে যাওয়ারও দুর্ভাবনা ছিল।
রাহামার পা মারাত্মকভাবে ফুলে গিয়েছিল। তার পা আর চলছিল না। তিনি বলেন, তখন আমার সন্তানেরা আমাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটা শুরু করে।
তারা বলল, আমরা বাবাকে হারিয়েছি। তোমাকে কোনোভাবেই হারাতে চাই না।
সমুদ্রতীরে পৌঁছার পর তাদের নতুন অগ্নিপরীক্ষায় পড়তে হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের মৎস্যজীবীদের অনেক নৌকা ছিল। কিন্তু অর্থ ও মূল্যবান কোনো বস্তুর বিনিময়েই কেবল সেই নৌকায় পার হওয়া যেত।
যে জন্য বহু রোহিঙ্গাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ওই সুমদ্রের তীরে অপেক্ষা করতে হয়েছে।
সৈকতটি ছিল অসুস্থ, ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত মানুষে টইটুম্বুর। সেখানে নুরজানও ছিলেন। তার সন্তান নূর মোহাম্মদ গণহত্যার শিকার ওই ১০ রোহিঙ্গার মধ্যে একজন ছিলেন।
নুরজান বলেন, আমি কেয়ামতে আল্লাহর বিচারের অপেক্ষায় আছি।
নদী মোহনার শান্ত জলে নৌকায় দুই ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছানো সম্ভব। মাঝিরা চাইতেন, তারা যেন নৌবাহিনী ও বিজিবির টহলরত কোনো নৌযানের চোখে না পড়েন।
কাজেই তারা রাতের বেলায় নৌকা ছাড়তেন। উন্মুক্ত সমুদ্রের বুকে অনেক ঘোরানো পেঁচানো পথ হয়ে মাঝিরা নৌকা পাড়ি দিতেন। অধিকাংশ নৌকায় থাকত অতিরিক্ত যাত্রী।
ক্রমাগত এলোমেলো ঢেউয়ে কখনও সেই নৌকা ডুবে যেত। তাতে কয়েক ডজন রোহিঙ্গার সলীল সমাধি হতো।
মাঝিরা নদী পার হতে জনপ্রতি আট হাজার টাকা নিতেন। নারীরা তাদের গহনার বিনিময়ে নৌকায় ওঠার সুযোগ পেতেন।
আব্দু শাকুরের কাছে কোনো অর্থ ছিল না। তিনি মাঝিদের প্রতিশ্রুতি দেন, বাংলাদেশে পৌঁছে আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার করে ভাড়া পরিশোধ করবেন।
তারা যেটায় উঠছিলেন, সেটার পাশঘেঁষে আরও একটা নৌকা চলছিল। দুটো নৌকায় ছিল অতিরিক্ত যাত্রী। যাদের অধিকাংশই ছিল শিশু।
মাঝ নদীতে এসে দেখতে পান অপর নৌকাটি উল্টে গেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে যাত্রীরা ভেসে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি, লোকজন সাহায্য চেয়ে আর্তনাদ করছে। কিন্তু তাদের উদ্ধার করা ছিল প্রচণ্ড কঠিন কাজ। সামর্থ্যের বাইরে। আমাদের নৌকাও ডুবে যেতে পারত।
ইন দিনের গণহত্যায় স্বজন হারানো অন্য পরিবারগুলোর মতো আব্দু শাকুরও নিরাপদে বাংলাদেশে পৌঁছান।
নদী পার হওয়ার সময় তাদের মনে হতো, ওপারে যে স্বজনদের রেখে এসেছেন, তাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিংবা আর কোনোদিন তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবে না।
সৌনা খাতুন নৌকায় চড়ে কাঁদতে ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, সেনাবাহিনী তার স্বামীর সঙ্গে কী করেছে, তা তিনি জেনে গেছেন। তখন তার তৃতীয় সন্তান তার পেটে রয়েছে।
সৌনা খাতুন বলেন, তারা আমাদের গ্রাম ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি জানি, সেখানে আর কোনোদিন ফিরতে পারব না।
দুই মাস পর বাংলাদেশে একটা আস্ত শহরের সমপরিমাণ শরণার্থী শিবিরে সৌনা খাতুন একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখেন মোহাম্মদ সাদেক।
সন্তানের কাঁধে চড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রাহামা খাতুনেরও একটি ছেলেসন্তান হয়। নবাগত সন্তানের নাম রেখেছেন সাদিকুর রহমান।
ইন দিনে ওই দুই নারী প্রতিবেশী ছিলেন। বর্তমানে তারা কুতুপালং ও বালুখালীতে থাকেন।
গণহত্যার শিকার ১০ রোহিঙ্গা পরিবার যেভাবে পালিয়েছিল
নিউজ ডেস্ক : রেহেনা খাতুন স্বপ্ন দেখছিলেন তার স্বামী বাড়িতে ফিরে এসেছেন। কোনো কথাবার্তা না বলেই তিনি হঠাৎ করে ঘরে ঢুকেছেন। কিন্তু আমগাছের ডালপালায় ছায়া সুদৃশ্য কাঠের ঘরে প্রবেশের পর তিনি কোনো কথা বলেননি।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড অবস্থান করে তাড়াহুড়ো করে চলে গেছেন।
এর মধ্যে রেহেনার ঘুম ভেঙে গেছে। কক্সবাজারের পাহাড়ের পাদদেশে একটি নোংরা ত্রিপলের ভেতরে তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠলেন।
স্বপ্নে যাই দেখুক না কেন, প্রাণের স্বামী নূর মোহাম্মদ আর কোনো দিন তার কাছে ফিরে আসবেন না। সবুজ গাছপালায় ঢাকা বাড়িটিতে এসে তাকে কোনোদিন ডাকবেন না।
রেহানার স্বামী হলেন সেই হতভাগা ১০ রোহিঙ্গার একজন, যাদের গত বছরের সেপ্টেম্বরে উপকূলীয় গ্রাম ইন দিনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল।
তাদের সেই সুশ্রী কাঠের ঘরটিও ভস্মীভূত করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের সারা জীবনের অর্জন ছিল ওই ঘরটির ভেতরেই।
ইন দিনের অধিকাংশ বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরে বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ কিছু দিন আগেও সেখানে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বসবাস করত, যাদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের বুনট ছিল অসাধারণ। তার পরস্পরের সহায়তায় এগিয়ে আসতেন, দুঃখকষ্টে সহানুভূতি জানাতেন।
তাদের কয়েক প্রজন্মের ইতিহাস কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী তাদের ধরে এনে রশি দিয়ে বেঁধে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে সামনেই কবর খোঁড়ে। ওই সময় স্থানীয় বৌদ্ধরা সেনাদের সহায়তা করেন। পর দিন সকালে তাদের গুলি ও কচুকাটা করে হত্যা করা হয়েছে।
এর পর আধা খোঁড়া কবরে তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়। অনেকের প্রাণবায়ু বের হওয়ার আগেই তাদের ধরে ধরে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছিল।
এই বিভৎস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কয়েক মাস চলে গেলেও পরিবার ও স্বজনরা তাদের খোঁজ জানতেন না। রেহেনা খাতুনের মতো তারা অপেক্ষায় ছিলেন একদিন হয়তো তাদের প্রাণের স্বামী কিংবা সন্তানরা ফিরে আসবেন।
ওই দিন মিয়ানমারের জাতিগত নির্মূল অভিযান থেকে বেঁচে যাওয়া স্বজনরা দুশ্চিন্তা ও আতঙ্ক নিয়ে সমুদ্রতীরে তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু দিন ফুরিয়ে সূর্য ডুবে গেলেও তারা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেননি।
সেদিনের ঘটনাটি ছিল এমনই বিভৎসতায় ভরা। ইন দিন থেকে পালিয়ে আসা তিন নারী ছিলেন গর্ভবতী।
মৌসুমি বৃষ্টির মধ্যে বন, জঙ্গল ও দীর্ঘ ফসলের ক্ষেত পাড়ি দিয়ে একসময় তারা নাফ নদীর তীরে পৌঁছান।
হাঁটতে হাঁটতে তারা ভিজে জবুথবু হয়ে গিয়েছিলেন। প্রাণে ভর করছিল আতঙ্ক ও অমানিষার অন্ধকার। তারা যখন টহলরত সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলেন, তখন দেখছিলেন তাদের গ্রাম, সোনার ফসল ও বসতবাড়ি আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে।
এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে বহু লাশ তাদের সামনে পড়েছিল। সামান্য খাবার ও পানি নিয়ে দিনের পর দিন হাঁটতে হয়েছে তাদের।
তবে তারা কেবল একা ছিলেন না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
মিয়ারমার অস্বীকার করলেও জাতিসংঘের ভাষায়- এটি ছিল জাতিগত নিধনের জ্বলন্ত উদহারণ, যা পাঠ্য বইয়ে জায়গা পেতে পারে।
দেশটির সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জো হেটাই বুধবার বলেছেন, ওই গণহত্যার দায়ে তারা সাত সেনাসদস্যকে কারাদণ্ড দিয়েছেন।
তিনি বলেন, এটি খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ। এতে বোঝা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে যারা আইন লঙ্ঘন করেছে, তাদের দায়মু্ক্তি দেয়া হয়নি। মিয়ানমারে পরিকল্পিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ নেই।
গত বছরের আগস্টের পর থেকে নাফ নদীর তীর পর্যন্ত ছিল রোহিঙ্গা ঢল। নদীর ওপারেই বাংলাদেশ ও তাদের নিরাপদ আশ্রয়।
নৌকার মাঝিদের নিজেদের সোনা গহনা দিয়ে তারা নদী পার হয়েছেন।
ওই রাতে নদী পার হতে তাদের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। ভয়, আতঙ্ক ও অসুস্থতায় তারা বমি করছিলেন।
কক্সবাজারে এসে এখন তারা স্বামী, বাবা, ভাই ও সন্তান ছাড়াই জীবনযুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন।
ওই গণহত্যার পর সাত মাস চলে গেছে। কিন্তু তারা তাদের দুঃখ ভুলতে পারেননি। দুর্ভোগের কথা বলতে গিয়ে এক রোহিঙ্গা মা মূর্ছা গিয়েছেন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন অনেকেই।
রেহেনা খাতুনের মতো তাদের সবাই হারানো স্বজনদের নিয়ে বিভিন্ন স্বপ্ন দেখে বেড়ান। যেমন তাদের স্বামীরা ফিরে এসেছেন, সন্তানরা মসজিদে নামাজ আদায়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন তো রয়েছেই।
এক নারী স্বপ্ন দেখছেন, তার স্বামী পেটে জখমের ওপর দুই হাত চেপে রেখেছেন। সেই জখম থেকে তাদের আঙুল চুইয়ে রক্ত ঝরছে।
রাতে তাদের ওপর যেমন দুঃস্বপ্ন এসে ভর করে, তেমনি দিনেও তাদের সামান্যতম স্বস্তি থাকে না। সবসময় তাদের চোখে ভেসে উঠছে, সেনাবাহিনী তাদের সামনে দিয়ে লোকজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হত্যা করছে।
আব্দুল আমিন কীভাবে যে বেঁচে আছে, তা নিয়ে তাদের ঘোর এখনও যেন কাটছে না।
গত বছরের ২৭ আগস্ট সেনাবাহিনী ইন দিন গ্রামে ঢুকে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে শুরু করে। স্থানীয় বৌদ্ধ প্রতিবেশী ও পুলিশ তাদের সহায়তা করে।
১৯ বছর বয়সী আমিন বলল, সেনাবাহিনী প্রবেশের পর শতাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে তাদের পরিবারও পাশের জঙ্গলে পালিয়ে ছিলেন।
চার দিন পর ইন দিন যখন ভস্মীভূত হয়ে যায় ও ঘনজঙ্গলভেদ করে গুলির শব্দ আসা বন্ধ হয়, তখন তারা সমুদ্র উপকূলের দিকে পালাতে শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ধরপাকড় থেকে বাঁচতে সেখানে আগে থেকেই কয়েক হাজার গ্রামবাসী জড়ো হয়েছিলেন। এ সময়ে সেনাসদস্যরা এসে উপস্থিত হয় এবং তাদের মাথা নুইয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ার নির্দেশ দেয়।
আমিন তার মা নুরুশার পাশেই গুটিশুটি মেরে ছিলেন। তার মা নিজের ওড়না দিয়ে তার মাথা ঢেকে রাখেন। সেনাবাহিনী তাকে খেয়ালই করল না, হয়তো নারী ভেবেছিল। কিন্তু তার ভাই শাকের আহমেদকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল।
আমিন জানান, আমি জানি না, ওরা কেন আমার ভাইকে নিয়ে গেল, কেন আমাকে চোখে পড়ল না। আসলে আল্লাহই আমাকে বাঁচিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সেনাসদস্যরা পুরুষদের ধরে ধরে একটা গোপন স্থানে নিয়ে যেত। তাদের পরিবারগুলো সমুদ্রতীরে সারা রাত হতাশা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। রাত শেষ হয়ে গেলে তারা আবার সেই জঙ্গলে ফিরে আসেন। এর পর নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচাতে আটক পুরুষদের রেখেই একসময় বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
আবদু শাকুর তার ১৮ বছর বয়সী কিশোর ছেলে রাশিদ আহমেদের অপেক্ষায় পাঁচ দিন জঙ্গলে ছিলেন। এর মধ্যে বাকি রোহিঙ্গারা চলে গেছেন। শাকুর বনের ভেতরে একাকীত্ব বোধ করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ও বুকে দানা বাধছে।
কিন্তু তিনি পালিয়ে আসতে চাইলেও তার স্ত্রী সাবিহা হাতু বাধা দিচ্ছেন। স্বামীকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ছেলেকে ছাড়া তিনি বাংলাদেশে আসবেন না।
সাবিহা বলেন, আমি সন্তানকে না নিয়ে কোনোভাবেই যাব না।
কিন্তু শাকুর বলেন, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। তুমি যদি এখানে থাকতে চাও, তবে তারা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে।
অনেক তর্কের পর তিনি স্ত্রীকে বলেন, আমাদের অন্য তিন সন্তানকে তো বাঁচাতে হবে।
রাশিদ ছিলেন তাদের বড় সন্তান। এক উজ্জ্বল কর্মঠ কিশোর, যে সারাক্ষণ বই পড়তে ভালোবাসত।
তিনি ভেবেছিলেন, নিশ্চিতভাবে তারা রাশিদকে ছেড়ে দেবে।
কিন্তু তাদের বড় ছেলে আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। ইন দিনের ১০ রোহিঙ্গার সঙ্গে তাকেও কচুকাটা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বসে রয়টার্স সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয় আব্দু শাকুরের। তিনি বলেন, সেদিন আমরা ঠিক কাজটিই করেছিলাম। আমি প্রচণ্ড আতঙ্কিত ছিলাম। আমাকে ওই জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে।
তার সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন তার স্ত্রী পেছনে বসে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন।
সময়টা এমন যে বাংলাদেশে পালাতে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছিল। দলবদ্ধ হয়ে তারা হাঁটছিলেন। কখনও কখনও কয়েক হাজার একসঙ্গে ছিলেন। এতে করে সমুদ্র উপকূলে রাখাইনের বনে বিশাল পথরেখা পড়ে গিয়েছিল।
রাতে ছেঁড়াখোঁড়া ত্রিপলের নিচে যখন নারী ও শিশুরা ঘুমাচ্ছিলেন, পুরুষরা তখন জেগে পাহারা দিতেন। মৌসুমি বৃষ্টিতে কখনও তারা একেবারেই ঘুমাতে পারতেন না।
এই বেপরোয়া রোহিঙ্গা ঢলে শাকির আহমেদের স্ত্রী রাহামা খাতুনও ছিলেন। তখন তার গর্ভে সাত মাসের সন্তান। এ ছাড়া তার আরও আট সন্তান রয়েছে। যাদের বয়স এক থেকে ১৮ বছর।
অন্য রোহিঙ্গাদের মতো তাদেরও ইন দিন থেকে পালাতে হয়েছিল। তাদের পরনে শরীর ঢাকার মতো যথেষ্ট কাপড়ও ছিল না।
তিনি বলেন, ঘর থেকে আমরা কিছু নিয়ে বের হতে পারিনি। এমনকি একটা খাবার প্লেটও না।
তারা ডোবা থেকে পানি ও অন্য শরণার্থীদের কাছ থেকে খাবার নিয়ে জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
রাহামা বলেন, পিচ্ছল পথ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তিনি পা টেনে টেনে চলছিলেন। পেটের অনাগত সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে ভয়ে ছিলেন তিনি। আবার অন্যদের থেকে পেছনে পড়ে যাওয়ারও দুর্ভাবনা ছিল।
রাহামার পা মারাত্মকভাবে ফুলে গিয়েছিল। তার পা আর চলছিল না। তিনি বলেন, তখন আমার সন্তানেরা আমাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটা শুরু করে।
তারা বলল, আমরা বাবাকে হারিয়েছি। তোমাকে কোনোভাবেই হারাতে চাই না।
সমুদ্রতীরে পৌঁছার পর তাদের নতুন অগ্নিপরীক্ষায় পড়তে হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের মৎস্যজীবীদের অনেক নৌকা ছিল। কিন্তু অর্থ ও মূল্যবান কোনো বস্তুর বিনিময়েই কেবল সেই নৌকায় পার হওয়া যেত।
যে জন্য বহু রোহিঙ্গাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ওই সুমদ্রের তীরে অপেক্ষা করতে হয়েছে।
সৈকতটি ছিল অসুস্থ, ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত মানুষে টইটুম্বুর। সেখানে নুরজানও ছিলেন। তার সন্তান নূর মোহাম্মদ গণহত্যার শিকার ওই ১০ রোহিঙ্গার মধ্যে একজন ছিলেন।
নুরজান বলেন, আমি কেয়ামতে আল্লাহর বিচারের অপেক্ষায় আছি।
নদী মোহনার শান্ত জলে নৌকায় দুই ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছানো সম্ভব। মাঝিরা চাইতেন, তারা যেন নৌবাহিনী ও বিজিবির টহলরত কোনো নৌযানের চোখে না পড়েন।
কাজেই তারা রাতের বেলায় নৌকা ছাড়তেন। উন্মুক্ত সমুদ্রের বুকে অনেক ঘোরানো পেঁচানো পথ হয়ে মাঝিরা নৌকা পাড়ি দিতেন। অধিকাংশ নৌকায় থাকত অতিরিক্ত যাত্রী।
ক্রমাগত এলোমেলো ঢেউয়ে কখনও সেই নৌকা ডুবে যেত। তাতে কয়েক ডজন রোহিঙ্গার সলীল সমাধি হতো।
মাঝিরা নদী পার হতে জনপ্রতি আট হাজার টাকা নিতেন। নারীরা তাদের গহনার বিনিময়ে নৌকায় ওঠার সুযোগ পেতেন।
আব্দু শাকুরের কাছে কোনো অর্থ ছিল না। তিনি মাঝিদের প্রতিশ্রুতি দেন, বাংলাদেশে পৌঁছে আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার করে ভাড়া পরিশোধ করবেন।
তারা যেটায় উঠছিলেন, সেটার পাশঘেঁষে আরও একটা নৌকা চলছিল। দুটো নৌকায় ছিল অতিরিক্ত যাত্রী। যাদের অধিকাংশই ছিল শিশু।
মাঝ নদীতে এসে দেখতে পান অপর নৌকাটি উল্টে গেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে যাত্রীরা ভেসে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি, লোকজন সাহায্য চেয়ে আর্তনাদ করছে। কিন্তু তাদের উদ্ধার করা ছিল প্রচণ্ড কঠিন কাজ। সামর্থ্যের বাইরে। আমাদের নৌকাও ডুবে যেতে পারত।
ইন দিনের গণহত্যায় স্বজন হারানো অন্য পরিবারগুলোর মতো আব্দু শাকুরও নিরাপদে বাংলাদেশে পৌঁছান।
নদী পার হওয়ার সময় তাদের মনে হতো, ওপারে যে স্বজনদের রেখে এসেছেন, তাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিংবা আর কোনোদিন তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবে না।
সৌনা খাতুন নৌকায় চড়ে কাঁদতে ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, সেনাবাহিনী তার স্বামীর সঙ্গে কী করেছে, তা তিনি জেনে গেছেন। তখন তার তৃতীয় সন্তান তার পেটে রয়েছে।
সৌনা খাতুন বলেন, তারা আমাদের গ্রাম ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি জানি, সেখানে আর কোনোদিন ফিরতে পারব না।
দুই মাস পর বাংলাদেশে একটা আস্ত শহরের সমপরিমাণ শরণার্থী শিবিরে সৌনা খাতুন একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখেন মোহাম্মদ সাদেক।
সন্তানের কাঁধে চড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রাহামা খাতুনেরও একটি ছেলেসন্তান হয়। নবাগত সন্তানের নাম রেখেছেন সাদিকুর রহমান।
ইন দিনে ওই দুই নারী প্রতিবেশী ছিলেন। বর্তমানে তারা কুতুপালং ও বালুখালীতে থাকেন।