তারকাদের বৈশাখ স্মৃতিচারণ
বিনোদন প্রতিবেদক : বছর ঘুরে আবারও আসছে বৈশাখ। চৈত্রসংক্রান্তি, হালখাতা ও বর্ষবরণ উপলক্ষে নানা আয়োজন নিয়ে আগামীকাল থেকেই বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য উৎসবে মেতে উঠবে সারা দেশের মানুষ! টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া- সর্বত্রই থাকবে বর্ষবরণ উৎসবের আমেজ! বর্ষবরণের প্রস্তুতি নিয়ে গত কয়েক দিন থেকেই ব্যস্ত সময় পার করেছেন দেশের মানুষ।
তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কেনাকাটার ধুম পড়েছে। সংবাদপত্রের পাশাপাশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও বর্ষবরণের নানা আয়োজন নিয়ে হাজির হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিতে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার প্রথা ও পদ্ধতিতে এসেছে পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন অনেকেই।
এখন পহেলা বৈশাখ মানেই যেন পান্তা-ইলিশ। নতুন পাঞ্জাবি ও লালপেড়ে সাদা শাড়ি যেন খাঁটি বাঙালিয়ানা প্রকাশের একটি দিন। অনেকে আবার এটি মানতে নারাজ। বৈশাখ মানেই অনেকের কাছে নিজের, নিজস্ব সংস্কৃতির একটি দিন। যে দিনটি বাঙালি সংস্কৃতি লালন করেন হৃদয়ে।
তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন আমেজে বৈশাখ পালন করা বাঙালির সংখ্যাও কম নয়। অপরিবর্তিত বা পরিবর্তিত বৈশাখী রঙে গা ভাসান শোবিজ তারকারাও। বৈশাখ নিয়ে তারকারা কী ভাবছেন? বৈশাখ এলেই কী তারাও স্মৃতিকাতর হয়ে যাচ্ছেন?
ফিরে যাচ্ছেন শৈশবের পালন করা বাধাহীন আনন্দের ফল্গুধারায়? তারকাদের তারকা হয়ে ওঠার আগের বৈশাখ এবং ইট-পাথর আর যান্ত্রিক শহরে বর্তমানের পহেলা বৈশাখ পালনের নানা স্মৃতিকাতরতা নিয়ে এ আয়োজন। গ্রন্থনা করেছেন অনিন্দ্য মামুন
অপু বিশ্বাস, চিত্রনায়িকা: ছোটবেলার সব অনুষ্ঠানই নানা রঙের আনন্দে কেটেছে। সে সময়ের বৈশাখ পালনও ঈদের মতো আনন্দে কেটেছে। পহেলা বৈশাখেও ঈদের মতো সালামি বা উপহার পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। ইলিশ মাছ খাওয়ার সংস্কৃতিটাও উপস্থিত ছিল।
গ্রামে বৈশাখ উপলক্ষে মেলা বসলেও আমার কখনও মেলায় যাওয়া হয়নি। কারণ ভিড় ঠেলে মেলায় যাওয়াটা একদমই পছন্দ করতাম না। মেলা থেকে যে মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলো আনা হতো তা খাওয়া কখনই মিস করতাম না। কিন্তু এখন শহুরের যান্ত্রিক জীবনযাপন আর ব্যস্ততার আড়ালে গ্রাম্য পহেলা বৈশাখের সবকিছুই যেন হারিয়ে ফেলেছি। এখন বৈশাখ তো আমার জয়ের সঙ্গেই পালন করব।
পরীমনি, চিত্রনায়িকা: সিনেমায় কাজ করার আগে সব উৎসবই বেশ আয়োজন করে পালন করা হতো। কিন্তু নায়িকা হওয়ার পর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ফলে আগের মতো আর উৎসবগুলো পালন করা হয় না। নববর্ষও আহামরি আয়োজন করে পালন করতে পারি না।
অনেক নববর্ষ তো শুটিং স্পটেই পালন করতে হয়েছে। এবারের নববর্ষে শুটিং নেই। তাই নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করব। শুধু জন্মসূত্রেই নয় আমি মনে প্রাণে বাঙালি। বাঙালিয়ানা নিজের ভেতরে ধারণ করি। অনেকেই বলে থাকেন পান্তা-ইলিশ না খেলে নাকি বৈশাখ পালন হয় না।
আমি এ ধারণার বিপক্ষে। বাঙালিয়ানা আমাদের ধারণ করার বিষয়। নববর্ষ উপলক্ষে যতটা পারি অন্যকে সহায়তা করব। গরিব অসহায়কে উৎসব পালনে সহায়তা করব। অন্যের সুখের মাঝেই সুখ খুঁজে নেব। শুধু বৈশাখেই নয়, প্রতিটি উৎসবেই আমি গরিব-দুঃখীদের নিয়ে পালন করার চেষ্টা করি।
শাকিব খান, চিত্রনায়ক: শুরুতেই আমার ভক্ত এবং বাংলা ছবির দর্শকদের নববর্ষের শুভেচ্ছা। প্রায় উৎসবেই দর্শকদের জন্য নতুন ছবি নিয়ে হাজির হই। উৎসবগুলোতে আমার পক্ষ থেকে দর্শক ও ভক্তদের জন্য উপহার এটি।
গত বৈশাখে দেশে থাকতে পারলেও এবার মনে হয় পহেলা বৈশাখ দেশে পালন করতে পারছি না। ‘ভাইজান এলো রে’ ছবির শুটিং নিয়ে লন্ডনে রয়েছি। তবে এখানেও যতটা সম্ভব বৈশাখ উদযাপন করব। এখানে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে দেশের সবাইকে খুব মিস করব। পহেলা বৈশাখ দেশে পালন করার মতো আনন্দ এখানে কখনই পাব না। বিদেশে থাকলেও আমার ভক্ত ও শুভাকাক্সক্ষীদের ভালোবাসার টান আমি কখনই ভুলব না। বিশেষ করে উৎসব-পার্বণে তো নতুন ছবি দিয়ে তাদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি। এবারের বৈশাখে সেটা না পারলেও আসছে ঈদে কিন্তু মিস হবে না। নতুন ছবি নিয়ে হাজির হব।
বাপ্পি চৌধুরী, চিত্রনায়ক: নায়ক হওয়ার আগে দিনটি বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ উল্লাস করে কাটাতাম। বৈশাখ এলে আমার নতুন পাঞ্জাবি চাই-ই চাই। এমন জিদ থাকত বাবার কাছে। এ দিন সকাল থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম।
বাইক নিয়ে শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়াতাম। এখন তো আর তেমনটি হয় না। এখন আড্ডা হয়, ঘোরাঘুরি হয়। তবে সেটা একটা শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে। অনেক জায়গায় ইচ্ছা থাকলেও যাওয়া হয় না। যেখানে যাই ভিড় হয়। আমি দেখতে যাব বৈশাখী মেলা বা আয়োজন। আর ভক্তরা দেখতে আসেন আমাকে।
সেখানে অনেক হুলুস্থুল কাণ্ড হয়। তবে ভক্তদের প্রতি আমার ভালোবাসা অনেক। তাদের ভালোবাসা নিয়েই তো এগিয়ে যাই আমরা। এবারের বৈশাখে কয়েকটি টিভি শোতে অংশ নেব। পাশাপাশি মায়ের হাতের মজার মজার খাবার খাওয়া তো রয়েছেই। বিকালে দিকে বন্ধুদের সঙ্গে বের হব।
বুবলী, চিত্রনায়িকা: বিশেষ অনুষ্ঠাগুলোতে খুব একটা বাইরে বের হই না আমি। বাসাতেই থাকি। পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দ করেই কাটাই। বাসায় আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা আসে। তাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই সময় কাটাই। পহেলা বৈশাখেও এমনটি হয়। বৈশাখী জামাকাপড় পরে ঘরেই বসে থাকি। চলচ্চিত্রে কাজ করার আগে থেকেই এমন অভ্যাস আমার। তবে বৈশাখসহ সব উৎসবই আনন্দের সঙ্গে পালন করি। এখন উৎসবে ছবি মুক্তি পেলে বেশি আনন্দ লাগে। প্রেক্ষাগৃহে যাই দর্শকদের সঙ্গে ছবি দেখি।
নিরব, চিত্রনায়ক: পহেলা বৈশাখ মানেই আমার কাছে আনন্দে ভরপুর একটি দিন। সকাল সকাল পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মাধ্যমে দিন শুরু হয়। এ দিন অনেক দাওয়াত থাকে। তবে আমি বাসায় সবার সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করি। এরপরই বের হই।
বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাই। ঘোরাঘুরি করি। অনেক সময় শো থাকে। যে বৈশাখে শো থাকে সে বৈশাখ কাটে দর্শকদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে বৈশাখ কাটানোর অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। এবার দেশের বাইরে একটা শো করার কথা রয়েছে।
যদি ফাইনাল হয় তবে এবারের পহেলা বৈশাখ হয়তো কানাডাতেই কাটবে। ওখানকার প্রবাসী বাঙালিত্বের সঙ্গে আনন্দ করব। এখনকার চেয়ে ছোটবেলার বৈশাখ অনেক মজার। নিজের মতো করে দিন কাটাতাম। আনন্দ আর উচ্ছ্বাস করতে করতে কখন যে পুরো দিন চলে যেত টেরই পেতাম না।
আঁখি আলমগীর, সঙ্গীতশিল্পী: সময় বের করে, নিজের মতো করে বৈশাখের আনন্দ শেষ কবে উপভোগ করেছি ঠিক মনে নেই। আমি কখনই অনেক ভিড়ে আনন্দ করতে পারি না। তাই পহেলা বৈশাখে তেমন পরিকল্পনা করা হতো না।
ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালন আমাদের গ্রামে দেখিনি। মনে আছে, আম্মু এদিন লাল পাড় সাদা শাড়ি পরত। কত রকমের ভর্তা যে হতো বলে শেষ করা যাবে না! গ্রামে মেলা বসত। আম্মু মেলা থেকে তালের পাখা কিনে দিত। তবে সে দিনগুলো সত্যি খুব মনে পড়ে। এখন ভক্তদের সঙ্গে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখের আনন্দ ভাগাভাগি করে সময় কাটে। নিজের জন্য সেভাবে সময় দেয়া হয় না। বিভিন্ন জায়গায় শো থাকে। দিনের কোনো অংশে সময় পেলে মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে বের হই। এ ছাড়া অন্য আর কোনো পরিকল্পনা থাকে না।
সাইমন সাদিক, চিত্রনায়ক: গ্রামের বৈশাখ দেখে দেখে বড় হয়েছি। গ্রামে নানারকম আয়োজন নিয়ে বৈশাখ পালন হতো। এখনও হয়। সবার সঙ্গে দিনটি উদযাপন করতাম। গ্রামে আমার অনেক বন্ধু। মেলায় যেতাম। গ্রামের মেলা মানেই তো পুতুল নাচ, নাগরদোলা আরও কত কী! সেসব এখন খুব মিস করি।
বড় হয়ে যাওয়ার পর অনেক কিছুতে যাওয়া হয় না। বিশেষ করে এখন তো গ্রামে গিয়েও আর শৈশবের মতো সময় কাটাতে পারি না। মানুষের ভিড় হয় খুব। এখন অনেক বৈশাখ শুটিং করেই কাটিয়ে দিতে হয়। তবে বৈশাখ আমার অন্যরকম আয়োজন ভরপুর একদিন। এখনও মজা হয়। সেটা অন্যরকম মজা। পান্তা-ইলিশের মধ্যে আমার বৈশাখ আবদ্ধ নয়। বৈশাখের খাঁটি আনন্দ সেই ছোটবেলা থেকেই পেয়ে আসছি। বৈশাখ তো আমাদের উৎসব। তাই দিনটি পালনে একটু অন্যরকম স্পেশালিটি থাকে।
মাহিয়া মাহি, চিত্রনায়িকা: পহেলা বৈশাখের দিন মনে হয় শুটিং রয়েছে। তবে শুটিং থাকলেও দিনটি শ্বশুরবাড়ি আর নিজের বাড়ির লোকজনের সঙ্গেই কাটানোর ইচ্ছা। ছোটবেলা থেকেই পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মাধ্যমে নববর্ষ পালন করে আসছি। এখনও তার ব্যতিক্রম হয় না। তবে এ পান্তা-ইলিশ খাওয়াকে কিন্তু আমি বাঙালিয়ানা মনে করি না। এটা আমার কাছে নববর্ষ পালনের একটা অংশ। বাঙালিত্ব তো আমাদের মনে ধারণ করতে হবে। একেক দেশের নববর্ষ একেক আয়োজনে পালিত হয়।
কোনো দেশ সারা রাত আতশবাজি করে পালন করে, কোনো দেশ আবার নেচে গেয়ে পালন করে। আমরা বাঙালিরা করি পান্তা-ইলিশ খাওয়া আর বাঙালি পোশাক পরে ঘুরে বেড়িয়ে। এটা প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতির বিষয়। কীভাবে পালন হল সেটি মুখ্য নয়, আমার কাছে উৎসবটাই মুখ্য। আনন্দ করাটাই আসল। তবে যারা বলে পান্তা-ইলিশ না হলে নববর্ষ পালন হয় না, আমার কাছে তাদের কখনই বাঙালি মনে হয়নি। তারা হচ্ছেন মৌসুমি বাঙালি।
বাঙালিয়ানা পান্তা-ইলিশ নয়, মনে প্রাণে বাংলা সংস্কৃতি ধারণ করার বিষয়। আরও একটি বিষয়, যারা নববর্ষের উৎসবের সমালোচনা করেন তারা নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে দেয়ার জন্য সেটা করতেই পারেন। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি। বিষয়টি আমাদের ভুলে গেলে হবে না। আমরা আমেরিকান, ইউরোপিয়ান কিংবা অ্যারাবিয়ান নই। সুতরাং আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি যদি আমরা পালন করি সেটা দোষের বলে আমি মনে করি না।