সোমবার, ৯ই এপ্রিল, ২০১৮ ইং ২৬শে চৈত্র, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

কাটা পড়া হাত খুঁজছেন রাজীব

নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘ওর জ্ঞান ফেরেনি। একটু নড়াচড়া করছে। এর মধ্যেই বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতটা খুঁজছে। আর হাত দিয়া কম্পিউটারে কাজ করত পারবে না…।’ বলে হাসপাতালেই কেঁদে ওঠেন রাজীবের খালা জাহানারা বেগম। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই হাতই ছিল অসহায় রাজীব শুধু নয়, তাঁর ছোট দুই শিশু ভাইয়েরও একমাত্র সহায়; যা কেড়ে নিয়েছে বেপরোয়াভাবে প্রতিযোগিতায় নামা দুই বাস। স্বজনরা জানায়, অভিযুক্ত বাস মালিক কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে থানায় মামলা দায়ের এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কারণে আইনগতভাবে এর সুরাহা চায় স্বজনরা। গতকাল বুধবার বিকেলে শমরিতা হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় রাজীবকে। তাঁর অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল হলেও আশঙ্কামুক্ত নয়। তাই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

রাজীবের খালা জাহানারা জানান, মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ওষুধের দামসহ দেড় লাখ টাকা বিল হয়েছে। এত ব্যয়বহুল চিকিৎসা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাঁরা রাজীবকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে রাজীবের চিকিৎসার খরচ স্বজন পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং বিআরটিসিকে বহনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তাঁকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক কোটি টাকা দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। এ ছাড়া সাধারণ যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে কার্যকর করতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না এবং প্রয়োজনে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আইন সংশোধন বা নতুন করে বিধিমালা প্রণয়নের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্রসচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, পুলিশপ্রধান, ডিএমপি কমিশনারসহ আট বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ আদেশ দেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলের করা এক রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে আদালত আদেশ দেন। রিট আবেদনকারী নিজেই শুনানি করেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায়।

গতকাল শমরিতা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রাজীবের নিকটাত্মীয়রা চোখের পানি ফেলছে। চাচা আল-আমিন পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত। উপস্থিত আছেন মামা জাহিদুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘আমরা সহায়তা করলেও সে নিজেই ভালো কিছু করতে চাইছিল। ছেলেটা কম্পিউটারের কাজে ভালো। কিভাবে কী হয়ে গেল…।’

মালিকপক্ষ যোগাযোগ করেছিল জানিয়ে চাচা আল-আমিন বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতেই শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। এখন আইনগত প্রক্রিয়ায় সব হবে।’ গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শমরিতা হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে রাজীবকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে শমরিতা হাসপাতালের আইসিইউর চিকিৎসক মো. হোসেন বলেন, রাজীবের জ্ঞান আছে, কিন্তু একটা ঘোরের মধ্য আছেন। তাঁর সারা শরীরে ব্যথা। তাঁর বাহুর নিচ থেকে পুরোটাই কাটা পড়েছে। ক্ষতগুলো ঠিক করা হয়েছে। এখন তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল। এই আঘাত ছাড়া আর কোনো বড় আঘাত নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শামছুজামান শাহীন বলেন, ‘তাঁর অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল, তবে আশঙ্কামুক্ত নয়। শমরিতা থেকে রাজীবকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছে। এসব রোগী অনেক সময় আবার খারাপ হয়েও যেতে পারে। আমার চিকিৎসকরা তাঁর সার্বক্ষণিক খবর রাখছে।’

শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, দুই বাসের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। এক চালককে মঙ্গলবারই গ্রেপ্তার করা হয়। পরে স্বজন পরিবহনের চালক খোরশেদকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজীবের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার দাসপাড়ায়। তাঁর বাবা হেলালউদ্দিন ছিলেন একটি ওষুধ কম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। ছয় বছর আগে তিনি মারা যান। মা নাসিমা বেগমের মৃত্যু হয় ১০ বছর আগে। ভাই মেহেদী হাসান (১৩) ও আব্দুল্লাহকে (১১) রাজীবই পড়ালেখা করাচ্ছেন। মা-বাবার ইচ্ছা ছিল, তাই ভাইদের রাজীব ঢাকার একটি মাদরাসায় দিয়েছেন।

স্বজনরা জানায়, রাজীব যাত্রাবাড়ীর মিরহাজীরবাগের একটি মেসে থেকে তিতুমীর কলেজে পড়ছেন। মেসের কাছেই একটি কম্পিউটারের দোকানে খণ্ডকালীন কাজ করেন। এতে তাঁর লেখাপড়া ও থাকার খরচের কিছুটা জোগাড় হতো। চাচা ও মামা জানান, সম্প্রতি কম্পিউটারের কাজে আরো পারদর্শী হতে রাজীব তাঁর কলেজের কাছে একটি প্রতিষ্ঠানে গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের কোর্সে ভর্তি হন। মঙ্গলবার দুপুরে বাসা থেকে বের হয়ে সেখানেই যাচ্ছিলেন। বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন। ডান হাতটি বেরিয়ে ছিল সামান্য বাইরে। কারওয়ান বাজারের কাছে পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১১-৯১১৯) বিআরটিসি বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই-তিনজন পথচারী দ্রুত তাঁকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকরা বিচ্ছিন্ন হাতটি রাজীবের শরীরে আর জুড়ে দিতে পারেননি। মঙ্গলবারই অস্ত্রোপচার শেষে তাঁকে শমরিতা হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়।

Print Friendly, PDF & Email