নেপালে আহত ৬ বাংলাদেশি দুর্ঘটনা নিয়ে যা বললেন
নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত ৬ বাংলাদেশি হাসপাতালে কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। ঠিক কী ঘটতে দেখেছিলেন চোখের সামনে, কোন মুহূর্তে বুঝলেন তারা মৃত্যুপথযাত্রী–বর্ণনা দিয়েছেন তারা। এসব অনুভূতি জানাতে গিয়ে কেউ নিথর কণ্ঠে কথা বলেছেন, কেউ ট্রমায় চঞ্চলতার প্রকাশ ঘটিয়ে তাড়াতাড়ি দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন। ৬ জনের মধ্যে শাহরিন আহমেদ মুমু বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার দিন থেকে ঘুরে ঘুরে এই আহতদের সঙ্গে কথা বলেছেন নেপাল প্রবাসী বাংলাদেশি আশিক কাঞ্চন। তিনি বৃহস্পতিবার ৬ জন আহতের সঙ্গে কথা বলে তাদের খোঁজ-খবর নেন এবং সেদিনের ঘটনা জানতে চান।
একই পরিবারের ফারুক আহমেদ, তার স্ত্রী আলমুন নাহার এ্যানি, তাদের তিন বছর বয়সী সন্তান বেড়াতে গিয়েছিলেন নেপাল। সঙ্গে ভাই মেহেদী হাসান ও তার স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা আক্তারও ছিলেন। বিধ্বস্ত বিমানে নিহত হন ফারুক ও তার তিন বছরের মেয়ে। এ্যানি এখনও জানেন না সে খবর। তিনি বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, আমার সন্তান ও স্বামী পুড়ে গেছে। ওদের সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছে আজ। আমি ভালো আছি, ওরা ভালো নেই।
সেদিন কী ঘটেছিল বলতে গিয়ে এ্যানি বলেন, বিমান যখন নিচে নামছিল ভাবছিলাম ল্যান্ড করছে। এরপর আর কোনও সংকেত পাইনি। আমি প্রথম বিমানে উঠেছি। ভাবিনি এরকম ক্রাশ হবে। জানলে আমি আমার মেয়েকে অনেক জোরে ধরে রাখতাম। ল্যান্ড করার পর বিমান পেছন দিক দিয়ে ভেঙে গেছে। আমি কেবল ধোঁয়া দেখেছি। আমার পাশে যারা ছিল তাদের সবকিছু ভেঙে পড়েছে। আমার মেয়ে আমার হাজব্যান্ডের হাতে ধরা ছিল, সে বিমানের পাশের দিকে ছিল বলে হাত থেকে ছুটে গেছে। আমি দেখেছি সে তাকে খোঁজার জন্য চারপাশে তাকাচ্ছে। কিন্তু সে বের হতে পারেনি। আমি ফিরে ওদের আনতে যেতে চেয়েছি, কিন্তু ওরা আমাকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। আমাকে মেহেদী ভাই টেনে বের করেছেন। আগুন ধরে গিয়েছিল, তাই আমাকে আর যেতে দেয়নি। ওখান দিয়ে অনেকে বের হতে তখনও চেষ্টা করছিল।
নিহত ফারুকের ভাই আহত মেহেদী তার ভাবী এ্যানি ও স্ত্রী স্বর্ণাকে বাঁচিয়েছেন। মেহেদী বলেন, ‘প্রথম তো ল্যান্ডিংটা বুঝতে পারিনি। ল্যান্ডিংয়ের কয়েক সেকেন্ড পরে মনে হলো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেল। ল্যান্ডিংয়ের আগে পাইলট কিছু বলেছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্রাশের আগে বাম দিকে কাত হয়ে ছিল বিমান। আমি পা দিয়ে জানালা ভাঙতে চেয়েছি, পারিনি। তাকিয়ে দেখলাম বিমান ভেঙে যাওয়ায় ফাঁকা জায়গা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। সামনে ভেঙে গিয়েছিল, আমি সেদিক দিয়ে বের হয়েছি। তারপর আবারও ঢুকেছি। কারণ, ভেতরে আমার পরিবারের আরও চারজন ছিল। কিছু দূর যাওয়ার পর কাজিনের বউকে (এ্যানি) পেলাম। তাকে বের করেছি। নেক্সট টাইম ঢুকে স্ত্রীকে বের করেছি। তৃতীয়বার আর ঢোকার সুযোগ ছিল না।
মেহেদীর স্ত্রী স্বর্ণা দ্রুত বাড়ি ফিরতে চান। তিনি বলেন, ফিরব কিন্তু কোনোভাবেই বিমানে নয়। তিনি বলেন, ক্রাশ যখন করেছে তখন বুঝতে পেরেছি। দেখেছি প্লেনটা বাঁকা হয়ে ছিল। তখনই ক্রাশ করবে কে জানতো। এক মিনিট ভালোভাবে চললে পৌঁছে যেতাম। ঝাঁকি দিলো আর সামনের চার পাঁচটা গ্লাস ভেঙে গেল। আমার পায়ের নিচে মাথার ডানপাশে আগুন জ্বলছিল। কীভাবে বেঁচে গেলাম জানি না।
বৃহস্পতিবার দেশে ফিরে আসা আহত শাহরিন আহমেদ মুমু স্মৃতি হাতড়ে বলেন, আমার পাশে ছিল সদ্যবিবাহিত এক দম্পতি (নিহত মিনহাজ ও আঁখিমনি)। তারা কী বেঁচে আছেন? তারা দুজনেই বেঁচে নেই জানানো হলে মুমু বলেন, আমরা যে কীভাবে বেঁচে ফিরলাম। আমার সেন্স ছিল, আমি এখানে এসে আগে কল করতে চেয়েছি। একজন ফোনটা এগিয়ে দিলে আমি ভাইয়ের নম্বরে কথা বলেছি। আমি ক্রাশের সময় আমার হ্যান্ডব্যাগ সেভ করতে পেরেছি। কোনোভাবে ব্যাগ ছাড়িনি। কারণ, এখানে আমার পাসপোর্ট, টাকা-পয়সা ছিল। ভাইয়া ভেবেছিল আমি মারা গেছি। আমার ফোন পেয়ে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো আমার হাত-পা ভেঙেছে কিনা। আমি বলেছি, আমার পা পুড়ে গেছে। তখনও জানি না আমার পা ভেঙেছে। আর বলেছি, ভাইয়া তুমি একটা ভালো প্লেনে এসে আমাকে নিয়ে যাও, ইউএস বাংলাতে না।
আহত শাহীন ব্যাপারীর স্বজনদের কেউ এখনও নেপালে যাননি। দেশে ফিরতে চান জানিয়ে শাহীন বলেন, দেশে গিয়ে চিকিৎসা করলে ভালো, আত্মীয়-স্বজন পাশে থাকবে। চিকিৎসকরা বলছেন আমার পুড়ে যাওয়ার সমস্যা। তারা বলেছেন, আমার ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। আহত কবীর হাসান সেদিনের কথা স্মরণ করতে চান না। কেবল বলেন, ভাগ্যে ছিল, ঘটেছে। কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।