সেহরি খেতে উঠে বেশিরভাগ লোককে আগুন থেকে বাঁচিয়ে দেয় মুসলিমরা
---
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারে মঙ্গলবার রাতে যখন আগুন লাগে, তখন সময় সোয়া একটা। এরপর আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে আগুন। কিছুক্ষণ পরই সেহরি খেতে উঠেছিলেন ভবনে বাস করা মুসলিমরা। তারাই বাঁচিয়ে দিতে পেরেছিলেন ভবনটির অসংখ্য বাসিন্দাকে। অন্যথায় আরও বেশি প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি মেইল জানিয়েছে, জীবন রক্ষাকারী সেসব মুসলিমকে স্থানীয়রা আখ্যায়িত করছেন ‘বীর’ হিসেবে। সেহরি খেতে উঠে তারাই জাগিয়ে দিয়েছিল তাদের প্রতিবেশীদের।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোজা রাখার জন্য প্রতিদিন ভবনটির মুসলিমরা রাত ১ টা থেকে ২টার মধ্যে সেহরি খেতে ওঠে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ওই সময়টা আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল ভবনটিতে। ধোঁয়া দেখে তারা চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করে প্রতিটি ফ্ল্যাটের দরজায় জোরে জোরে আওয়াজ করছিল। সেই আওয়াজ পেয়েই অনেকে দ্রুত জেগে উঠে ভবন থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছিল।
ওই ঘটনার পর লন্ডনের জনগণ মুসলিমদের আখ্যায়িত করছে ‘লাইফলাইন’ (জীবনরক্ষাকারী) হিসেবে। এমনই এক ‘বীর’ খালিদ সুলেমান আহমেদ (২০)। গ্রেনফেল টাওয়ারের ৮ম তলায় বাস করতেন খালিদ। প্রতিদিন দেরি করে উঠলেও মঙ্গলবার রাতে একটু আগেই জেগে গিয়েছিলেন তিনি। অপেক্ষা করছিলেন সেহরির জন্য।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম হাফিংটন পোস্টকে খালিদ বলেন, ‘কোনও সতর্ক ঘণ্টা বাজানো হয়নি। কোনও ধরনের সতর্কতা দেয়া হয়নি। আমি গেমস খেলে সময় পার করছিলাম। এরই মধ্যে ধোঁয়া দেখতে পাই। আমি দ্রুত উঠে যাই এবং জানালা খুলে তাকাই। দেখি, সপ্তম তলা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি দ্রুত আমার আন্টিকে ডেকে তুলি। এরপর পোশাক পরে নিয়ে প্রতিবেশীদের দরজায় শব্দ করতে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুইজন ছাড়া সবাই দরজা খুলেছিল। এরপর আমি অন্যদের দরজায় গিয়েও শব্দ করতে থাকি।’
স্থানীয় বাসিন্দা রাশিদা স্কাই নিউজকে বলেন, ‘রোজার মাসে অনেক মুসলিমই রাত জেগে নামাজ পড়ে। তারা একবারে সেহরি খেয়ে ঘুমায়। দুইটা-আড়াইটার দিকে তারা জেগে থাকে।’
নাদিয়া ইউসুফ নামের এক নারী জানান, সেহরি খেতে উঠে মুসলিম বাসিন্দারাই প্রথম আগুনের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করতে থাকে। তিনি বলেন, ‘সেহরি খেতে উঠে তারাই প্রথম এটা দেখতে পায়।’ এদিকে ঘটনার পরপরই স্থানীয় আল মানার মসজিদসহ অন্য মসজিদগুলো ভুক্তভোগীদের আশ্রয়ের জন্য তাদের দরজা খুলে দিয়েছিল।
পুড়ে যাওয়া গ্রেনফেল টাওয়ারের বাসিন্দারা জানান, আগুনের সময় কোনও ধরনের অ্যালার্ম বাজানো হয়নি, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলোও কাজ করছিল না, লিফটে নামা যাচ্ছিল না। শুধু সিড়ি ব্যবহার করা যাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী বলেন, ‘সাহায্যের জন্য মসজিদ থেকে যদি মুসলিম ছেলেরা ছুটে না আসতো, আরও অনেক লোক মারা যেতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারাই প্রথম পানির ব্যাগ নিয়ে ছুটে এসেছিল। দৌড়াদৌড়ি করে লোকদের সতর্ক করছিল। আমি যাদের দেখলাম, তাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম। পরে তারা খাবার এবং কাপড়ও দিচ্ছিল।’
লন্ডনের পশ্চিমাঞ্চলীয় লাটিমার রোডের ল্যানচেস্টারে ‘গ্রেনফেল টাওয়ার’ নামের ওই আবাসিক ভবনটিতে স্থানীয় সময় মঙ্গলবারের আগুনে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা জানা গেছে ১২ জন। তবে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশ। আগুন তিনতলা থেকে ২৪ তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটি পুড়ে ভষ্ম হয়ে গেছে।
লন্ডনের উত্তর কেনসিংটনের ওই আবাসিক ভবন থেকে এ পর্যন্ত ৬৫ জনকে উদ্ধার করেছে অগ্নিনির্বাপক দলের কর্মীরা। অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত চালানো হবে বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। তিনি বলেন, ওই ঘটনা থেকে কী শিক্ষণীয় আছে, তাও দেখা হবে।
বিবিসি জানিয়েছে, ভবনটিতে যখন আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই ঘুমাচ্ছিলেন। গ্রেনফেল টাওয়ারে মোট ফ্ল্যাট সংখ্যা ১২০। তবে আগুন লাগার কারণ এখনও জানা যায়নি।
ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিখোঁজ আছে অনেকে। হাসপাতালে ভর্তি ৭৮ জনের মধ্যে ২০ জনের অবস্থা গুরুতর। ধারণা করা হচ্ছে, প্রথম তিনতলার কেউই বেঁচে নেই।’
আইয়ুব আসিফ নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি সিএনএনকে জানান, তার পরিবার ওই ভবনেই বাস করে। তিনি ভবনের অনেককে লাফিয়ে পড়তে দেখেছেন। আইয়ুব বলেন, ‘আমার ভাতিজা সেখানে ছিল, আমার চাচাতো ভাইবোনেরা সেখানে ছিল।’ ভেতর থেকে আহতদের বের করে আনতে অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের সহায়তা করেছেন তিনি। আইয়ুব বলেন, ‘আমি লোকজনকে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে দেখেছি।’
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী ওমর চৌধুরি জানান, আগুন থেকে বাঁচতে ভবনের মাঝামাঝি জায়গার ফ্লোর থেকে তিনি অনেককে লাফিয়ে পড়তে দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি যে কেউ লাফিয়ে পড়ছে।’
প্রত্যক্ষদর্শী জোডি মার্টিন বলেন, ‘একজন লোককে আমি উপর থেকে পড়ে যেতে দেখেছি। এক নারীকে দেখেছি তার বাচ্চাকে নিয়ে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে। অনেক চিৎকার শুনেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি অনেককেই বলেছি, নেমে আসুন। তারা বলছিল, আমরা ভবন ত্যাগ করতে পারছি না। প্রচুর ধোঁয়া।’
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, কীভাবে ‘আমার বাচ্চাকে বাঁচাও’ বলে ভবনের ভেতরে আটকে পড়া লোকজন তাদের সন্তানদের ছুড়ে মেরেছেন অন্যের কাছে। তিনি বলেন, ‘অনেকে নিজে বের হতে না পেরে শুধু তাদের সন্তানকে ছুড়ে দিচ্ছেন।’
এক নারী জানিয়েছেন, ২১ তলা থেকে ছয় সন্তানকে নিয়ে নেমে আসছিলেন তিনি। নিচতলা পর্যন্ত আসতে আসতে চারজনকে অক্ষত পেয়েছেন। বাকি দুইজনের কোনও খোঁজ পাচ্ছেন না।