সোমবার, ১২ই জুন, ২০১৭ ইং ২৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

ঢাকায় ঘরের ভেতরে তিন সন্তানসহ এক নারীর লাশ

AmaderBrahmanbaria.COM
জুন ৯, ২০১৭
news-image

---

প্রতিবেশীদের কাছে খবর পেয়ে শুক্রবার ভোররাতে পুলিশ গিয়ে তুরাগ থানার কামারপাড়ার কালিয়ারটেক এলাকার টিনশেড একটি বাসা থেকে লাশ চারটি উদ্ধার করে।

তুরাগ থানার ওসি মাহবুবে খোদা  বলেছেন, চারটি লাশই ঘরের মেঝেতে পান তারা।

“তবে স্থানীয়রা বলেছে, মায়ের লাশটি ঘরে সিলিং ফ্যানে ঝুলছিল, আর মেঝেতে পড়েছিল শিশু তিনটি।”

রেহেনা পারভীন নামে ওই নারী তিন সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। তবে রেহেনার বাড়ির লোকজনের সন্দেহ, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

নিহতরা হলেন- রেহেনা পারভীন (৪০), তার তিন সন্তান শান্তা (১৩), শেফা (৮) ও সাদ (১)। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে।

রেহেনা তার স্বামী মোস্তফা কামালের সঙ্গে ওই বাড়িতে থাকতেন। ঘটনার সময় কামাল বাইরে ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

স্থানীয়দের উদ্ধৃতি দিয়ে ওসি মাহবুব বলেন, “মোস্তফা কামাল বাসার কাছেই একটি সমিতির অফিসে ছিলেন। সেখান থেকে রাতে ফিরে স্ত্রী ও সন্তানের এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে চিৎকার করলে সবাই ছুটে আসে।”

খবর পেয়ে রাত ২টার দিকে পুলিশ গিয়ে চারজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা জানান, তারা আগেই মারা গেছেন।

পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, তিন সন্তানকে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছে। তবে এ পেছনে অন্য কিছু রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

কী কারণে এই ঘটনা ঘটল, পারিবারিক কোনো অশান্তির খবর পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে ওসি বলেন, “এখনও আশপাশের বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। সবই হাসপাতালে লাশগুলো নিয়ে ব্যস্ত।”

কামাল বলেন, তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একসাথে তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ইফতার করেন। তারপর এলাকায় ‘যুব কল্যাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কো-অপারেটিভ লিমিটেডের’ অফিসে যান।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিয়ে কামাল এই সমিতি গড়ে তুলেছেন এবং নিয়মিত ওই অফিসে বসতেন।

কামাল বলেন, “রাতে বাসায় ফিরে দেখি সামনের ঘরে আলো, কেউ নাই। মাঝের ঘরে বিছানায় তিন সন্তান এবং ভেতরের ঘরে ফ্যানের সঙ্গে রেহেনা ঝুলছে।

“আমি চিৎকার দেই। আশপাশের মানুষও ছুটে আসে। রেহেনাকে নামিয়ে মুখে বাতাস দিয়ে অনেকবার চেষ্টা করেছি বাঁচাতে কিন্তু পারিনি।”

দ্বিতীয় কক্ষে যে তিন সন্তান মৃত, তা প্রথমে বুঝতে পারেননি বলে জানান কামাল।

আত্মহত্যা, না হত্যা?

রেহেনার স্বামী কামাল বলছেন, কিছুদিন ধরে তার সংসারে অর্থ সঙ্কট চলছিল, তা থেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে তার স্ত্রী এই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারেন।

স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যান কামাল, সেখানে জরুরি বিভাগের সামনে তার সঙ্গে কথা হয় ।

কামাল বলেন, তার সংসারে আগে স্বচ্ছলতা থাকলেও সম্প্রতি দুরবস্থা নেমে আসে।

“চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানায় বড় পদে অনেক বেতনে চাকরি করতাম। পরে ফ্ল্যাটের ব্যবসা থেকে শুরু করে অনেক কিছু করেছি। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান দিয়ে কিছুদিন ধরে অনেক কষ্টে চলতে হচ্ছিল।”

শান্তা কামারপাড়ায় পরশমনি ল্যাবরেটরি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত, শেফা পড়ত প্রথম শ্রেণিতে।

“ওদের স্কুলের বেতনও ঠিকমতো দিতে পারতাম না।”

এসব নিয়ে রেহেনা দুর্ভাবনায় ছিলেন জানিয়ে কামাল বলেন, “হয়ত টেনশন থেকে সে এই কাজ করেছে।”

জরুরি বিভাগের যেখানে কামাল ছিলেন, তার অদূরেই থাকা রেহেনার স্বজনরা বলেন ভিন্ন কথা।

রেহেনার বোন রোজিনা সুলতানা বলেন, শাশুড়ি, ননদসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন তদের হত্যা করেছে।

“১৭ বছর তাদের বিবাহিত জীবন। কোনোদিন আমার বোনকে শান্তি দেয়নি তারা।”

হত্যা কেন করবে- প্রশ্ন করা হলে পাশে থাকা আরেক বোনের মেয়ে আসমা আক্তার বলেন, কামারপাড়ার ওই বাসার জমিটি রেহেনার শ্বশুরের। ২০টি টিনশেড ঘর রয়েছে এবং তার ভাড়া তুলতেন রেহেনার শাশুড়ি মাফিয়া বেগম ও ননদ কোহিনুর।

“ভাড়া তোলা নিয়ে খালার (রেহানা) সঙ্গে তারা (শাশুড়ি ও ননদ) অনেক ঝগড়া করত।”

তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তোলার সপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আসমা বলেন, “সেখানে পাশের ঘরে ননদ ও শাশুড়ি থাকে, কিন্তু দেখেন এত বড় ঘটনার পর তারা কেউ হাসপাতালে আসেনি।”

মিরপুর-১ এ নম্বর এলাকায় বসবাসকারী রোজিনা বলেন, “রাতে রেহেনার মৃত্যুর খবর আমাদের অন্য ভাড়াটিয়ারা দিয়েছে, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির কেউ দেয়নি। এটা থেকে আপনারা (সাংবাদিক) বুঝে নেন।”

“এত সুন্দর সন্তানকে কোনো মা এভাবে হত্যা করতে পারে না” বলেন তিনি।

রোজিনা জানান, তারা ৬ বোন ৪ ভাইয়ের মধ্যে রেহেনা ছিলেন পঞ্চম। ২০০০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন তিনি, পরে সমাজ কল্যাণে এমএ ডিগ্রি নেন।

“শাশুড়ি ও ননদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য অনেক চাকরি খুঁজেছে, কিন্তু ভালো কোনো চাকরি পায়নি।”

হত্যার অভিযোগের বিষয়ে রেহেনার স্বামী কামাল বলেন, “দেখুন, আমার মরেছে তিনজন সন্তান আর তাদের মরেছে একজন। কষ্ট তো আমারই বেশি হচ্ছে, তাই না।”

তার দাবি, তার মা (রেহেনার শাশুড়ি) তিন মাস ধরে তাদের বাসায়ই আসেন না।

কামাল জানান, ২০টি ঘরের মধ্যে তিনি তিনটি ঘর নিয়ে থাকেন এবং তার বোন কোহিনুর তিনটি ঘর নিয়ে থাকেন। বাকি ১৪টি ঘর ভাড়া দেওয়া, যার টাকা তার মা নেন।

অন্য কেউ হত্যা করতে পারে কি না- জানতে চাইলে কামাল বলেন, “স্থানীয় দুই প্রভাবশালীকে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলাম ডেসটিনির ব্যবসার জন্য। সেই টাকা তো আর পাইনি, তাদেরও হাত থাকতে পারে।”

তবে দুই ‘প্রভাবশালী ব্যক্তির’ নাম বলেননি কামাল।

তুরাগ থানার ওসি মাহবুব বলেন, “পুলিশ সবকিছু নিয়েই তদন্ত করছে। এর পেছনে কী রয়েছে, তা বের করা হবে।”

এ জাতীয় আরও খবর