জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা
---
নিউজ ডেস্ক : একের পর এক দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা কৌশল পরিবর্তন করে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে জামিন পেয়ে কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে ১২ জঙ্গি মুক্ত হয়েছে। তাদের সবার বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা রয়েছে। চলতি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গোপন প্রতিবেদনে জঙ্গিদের জামিন পাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি উঠে এসেছে। জঙ্গিরা জামিন পেলে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড বাড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের চারটি ইউনিটের মধ্যে হাইসিকিউরিটি ইউনিটে দেড় শতাধিক জঙ্গি বন্দি রয়েছে। একই ভবনের বিভিন্ন সেলে ৪ থেকে ৬ জন করে তাদের রাখা হয়েছে। বিশেষ করে বিকেল বেলা আসামিদের হাঁটাহাঁটি ও চলাফেরায় কিছুটা শৈথিল্য থাকায় প্রতিনিয়ত জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে সাক্ষাতের সুযোগ পায়। এ সময় তাদের মধ্যে তথ্য বিনিময় হয়। দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা তাদের পরিকল্পনা কম গুরুত্বপূর্ণ আসামির সাক্ষাৎকারীদের মাধ্যমে বাইরে পাঠায়।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, জঙ্গিদের জামিন লাভের বিষয়টি নিয়ে তারাও উদ্বিগ্ন। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দীর্ঘদিনের চেষ্টায় তারা জঙ্গিদের গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেন। এরপর কিছুদিন পরই জামিনে বেরিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে একটি ফরম সরবরাহ করেছে পুলিশ। সেখানে জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অন্তত ২০ ধরনের তথ্য লিখে রাখা হয়। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, জঙ্গিরা জামিন পেয়ে বেরিয়ে আবারও বড় ধরনের নাশকতায় জড়িয়েছে। ২০১৪ সালে ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গি ছিনতাইয়ে অংশগ্রহণকারী জেএমবি নেতা জামাই ফারুক জামিনে বেরিয়ে ওই অপারেশনে অংশ নেয়। পরে ভারতে পালিয়ে যায়। গত বছরের শেষ দিকে ফারুক ভারতে গ্রেফতার হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ১২ জঙ্গির জামিন পাওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি জেএমবি সদস্য চায়নুল রহমান বাবুল জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে। তার গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারীর ফকিরপাড়ায়। বাবুলের বাবার নাম রুহুল আমিন। তার বিরুদ্ধে সাভার থানায় বিস্ফোরক ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দুটি মামলা রয়েছে। ১৪ জানুয়ারি জামিনে বেরিয়ে গেছে হিযবুত তাহ্রীরের সদস্য ইউসুফ নূরানী। তার বিরুদ্ধে রমনা থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা রয়েছে। উত্তরা পূর্ব থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের মামলার আসামি জাফর ইকবালও জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে। এ ছাড়া জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে কেরানীগঞ্জের আলীপুরের আজিজুর রহমান, মিরপুরের বড়বাগের মিনহাজ আবেদীন, সূত্রাপুরের সায়েমুন হোসেন, খিলক্ষেতের আবিদ হাসান কাদির, খুলনার ডুমুরিয়ার ইসতিসনা আক্তার ঐশী, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের আকরাম হোসেন, পাবনার রাধানগরের আশরাফ আলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের মহিউদ্দিন ও কোতোয়ালি এলাকার গাজী মো. বাবুল। তাদের সবার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা রয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আগে থেকে যেমনি জঙ্গিদের জামিনের প্রবণতা বেড়েছে, তেমনি জামিন লাভের ক্ষেত্রে কৌশলগত পরিবর্তন হয়েছে। আগে জামিন পাওয়ার সময় জঙ্গিরা কোন উগ্রপন্থি সংগঠনের সদস্য তা জানা যেত। এখন জঙ্গি সদস্যদের কেবল সন্ত্রাসবিরোধী বা বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে অভিযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। আরও বলা হয়েছে, জঙ্গিরা নানা কৌশলে কারাগারের বাইরে তথ্য পাচার করছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও দশ ট্রাক হামলার আসামি আবদুল হান্নান সাবি্বরের সঙ্গে তার ভাই পরিচয়ে মেহের আলী নামে এক ব্যক্তি সাক্ষাৎ করেন। আলীর গ্রামের বাড়ি বগুড়ার শাহজাহানপুরে। তার মাধ্যমে বন্দি জঙ্গিরা বিভিন্ন তথ্য বাইরে পাচার করত।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, জেএমবির শীর্ষ ২৬ নেতা বর্তমানে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। এসব জঙ্গি তাদের স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, আদালত ও হাসপাতালে গমনাগমন ও প্রিজনভ্যানে থাকাকালে বিভিন্ন অনিয়ম ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকে। বর্তমান বাস্তবতায় জঙ্গিদের আদালতে গমনাগমন, প্রটেকশন, এস্কর্টসহ নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়গুলো তদারক করার কথা বলা হয়েছে।
আরও বলা হয়, আসামিদের কারাগারে পাঠানো ও আদালতে হাজিরা প্রদানের সময় পুলিশের এস্কর্টে রিকুইজিশন করা কম গতিসম্পন্ন গাড়ি, ফিটনেসবিহীন লেগুনা ও মাইক্রোবাস ব্যবহার করা হয়। যা জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা তৈরি করবে। এছাড়া দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের সঙ্গে সাক্ষাতের বিধিনিষেধ আরোপের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। কাশিমপুর কারাগার থেকে জঙ্গিদের আদালত ও হাসপাতালে স্থানান্তরের সময় প্রিজনভ্যানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা কারা অভ্যন্তরে, প্রিজনভ্যান কিংবা আদালতে যাতায়াতের সময় যাতে কারও সঙ্গে কথা বলতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে।
সিটিটিসির এডিসি আবদুল মান্নান বলেন, জামিন পাওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গিদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি রাখা হয়। আবার অনেক সময় জামিন পাওয়ার পর তাদের ডেকে এনে ভালো পথে ফেরার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। তবে সবার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না।
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মিজানুর রহমান বলেন, কারাগারে ২৪ ঘণ্টা একই ধরনের নিরাপত্তা থাকে। বৈকালিক নিরাপত্তার শৈথিল্যের সুযোগে জঙ্গিদের পরস্পর শলাপরামর্শের সুযোগ নেই।সমকাল