বনানীর ধর্ষণের সেই রাতের কথা : ফেসবুকে নিঝুম মজুমদার
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্টুরেন্টে বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ধর্ষণের ঘটনা এখন দেশজুড়ে আলোচিত। দুই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে ফেসবুকে সেই ভয়াবহ রাতের ঘটনা তুলে ধরেছেন নিঝুম মজুমদার। নিঝুম মজুমদার একজন লন্ডনপ্রবাসী ব্যারিস্টার। যাঁর সাথে ভিটকিমদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে এবং ভিকটিমদের মুখ থেকে সে রাতের বর্ণনা শুনে তিনি তা ফেসবুক স্টেটাসে তুলে ধরেছেন। পাঠকদের জন্য নিঝুমের ফেসবুক স্টেটাসটি তুলে ধরা হলো …
বনানীর ধর্ষক সাফাত পিস্তল তাক করে ছিল প্রথম ভিকটিমের দিকে। হিস হিস করে বলে, ‘কিরে চিনস এইটা?’ সেই সাথে চলছিল ভয়ংকর রকমের গালি। বেশ্যা, মাগি আর অকথ্য সব শব্দ। নাঈম আশরাফ নামের ধর্ষকটি লাফিয়ে লাফিয়ে কিল ঘুষি চড় দিচ্ছিল ভিকটিমদের। তাদের একটাই কথা, ওদের সাথে ‘সেক্স’ করতে হবে।
তিনজন মেয়ে ছিল আর একটি ছেলে। তারা এসেছিল সাফাতের জন্মদিনের পার্টিতে। ওদের চারজনকে বলা হয়েছিল প্রায় ১০০ জনের মতো মানুষের এক জন্মদিনের পার্টি। কিন্তু এসে দেখে কেউ নেই…কিছু নেই…
যেই মা ১০ মাস ধরে গর্ভধারণ করলেন সাফাতকে, সেই মা’র পুত্র তার ২৬তম জন্মদিন পালন করবে দুটি নারীকে ধর্ষণ করে। এই ছিল সাফাত, নাঈম আর শাদমানের পরিকল্পনা। পুরো ঘটনায় দালালের ভূমিকায় ছিল শাদমান।
এরা ছাড়াও ছিল ধর্ষক শাফাত, ধর্ষক নাঈম আশরাফ, ধর্ষক শাদমান সাকিফ। ওই তিনজন মেয়ের সাথে যে ছেলেটি জন্মদিনের পার্টিতে এসেছিল সেই ছেলেটি অনেকবার কাকুতি-মিনতে করেছে ছেড়ে দিতে। নাঈমের পা ধরে রেখেছে। চিৎকার করে কেঁদেছে।
ধর্ষকরা ছেড়ে দেয়নি বরং ছেলেটিকে নিয়ে মজা করেছে। পা দিয়ে লাথি দিয়েছে, চড় দিয়েছে।
অভিযোগকারী দুজন ভিকটিম ছাড়াও বাকি যে মেয়েটি ছিল, ধর্ষকরা সেই মেয়েটিকে চেঁচিয়ে বলছিল জামা-কাপড় খুলতে। তারা তার অনাবৃত শরীরের নাচ দেখবে। নাঈম বলে, ‘না না, নাচ না, গ্যাং রেইপ হবে আজ। ‘
বাদিনী দ্বয়ের একজন সাফাত আর নাঈমের পায়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ভাইয়া প্লিজ এই মেয়েটাকে ছেড়ে দেন বলে।
ধর্ষক নাঈম কি ভেবে ছেড়ে দেয়। বলে উঠে, ‘তাহলে তুই আয়’। এই বলে মেয়েটিকে ৭০২ নম্বর রুমে গিয়ে নির্যাতন করতে থাকে। এদিকে সাফাত টেনে নেয় আরেকজনকে। সারারাত ধরে নির্যাতন করে দুটি মেয়েকে। একটা পর্যায়ে দুটি পা চেপে ধরে সাফাতের। ‘ভাইয়া প্লিজ মাফ চাই আপনাদের কাছে…প্লিজ’
সাফাত গোংরাতে গোংরাতে পশুর মতো চিল্লাতে থাকে। ‘কুত্তার বাচ্চা, খানকি মাগি, বেশ্যা তোরা না বলছিলি শুবি না, আসবি না!!! দেখ কি করেছি তোদের’
সাফাত এরই আগে বলে রাখে তার ড্রাইভার বিল্লালকে। বিল্লাল ঘুরে ঘুরে দুটি রূমে ভিডিও করতে থাকে।
রেইন ট্রি’র দুজন কর্মকর্তা, বেয়ারা এসে খোঁজ নিয়ে যায় সব ঠিকমতো চলছে কিনা। বাইরে দাঁড়ানো সাফাতের বডিগার্ড আবুল কালাম আজাদ। ইগলের মতো সে সব পাহারা দিতে থাকে।
ওদিকে শাফাত চিল্লাতেই থাকে, ‘আমার বাপ কি বাল ফালায়? সোনা বেচে…সোনা। এই দেশের এয়ারপোর্টের সব সোনা কই যায়? কইত্থেইকা আসে? সব আমার বাপের আন্ডারে। তোগো মতো এমন দু-একটারে কাইটা ভাসায়া দিলে কেউ টের পাইব না’।
অন্য রুম থেকে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। নাঈম আশরাফ পেটাচ্ছে আরেক ভিকটিমকে। চিৎকার…কান্না…আর্তনাদ। পুরো ঘটনার তদারকি করতে থাকে শাদমান সাকিফ।
ধর্ষণ শেষ হয়ে ক্লান্ত ধর্ষক এবার ওদের সাথে আশা ছেলেটিকে ইচ্ছেমতো লাথি দেয়। বলে, ‘যা তুইও ওই ঘরে গিয়ে করে আয়’। ছেলেটি অপমানে আর কষ্টে ঘরের একটি কোণে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
মেয়েটি আমাকে বলে, ‘ভাইয়া এই ঘটনার পর কতবার মনে হয়েছে মরে যাই। কতবার ভেবেছি সব কিছু ছেড়ে পালাই। কিন্তু পারিনি ভাইয়া। ভাইয়া একটা সময় মনে হয়েছে হলি আর্টিজানের জঙ্গিরাও ওদের থেকে ভালো। সেসব জঙ্গিরা তো জানে মেরে ফেলেছে। আর এরা অপমান আর লাঞ্ছনায় আমাদের জীবন মৃত করে ফেলেছে। আমরা বেঁচে থেকেও মৃত। আমি প্রতিটি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি আর কাঁদি। কাউকে বলতে পারি না। দুই বান্ধবী মিলে ফোনে কথা বলি আর কাঁদি’।
‘এর মধ্যে আমাদের সে দিনের ভিডিও ওরা ছেড়ে দিয়েছে বলে আমাদের ফোন করে জানায়’, বলে, ‘তোরা হইলি এখন আমাদের কেনা মাগি। যখন ডাকমু আসবি’।
একদিন এক ভিকটিমের বাসায় সাফাতের দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ যায়। ভয় পেয়ে যায় বাসার সবাই। আস্তে আস্তে জানাজানি হতে থাকে। হয় নাঈম আর সাফাতের শয্যাসঙ্গী হও, তা না হয় ভিডিও ভাইরাল।
একটা পর্যায়ে ওরা সিদ্ধান্ত নেউ ধর্ষকদের সাথে সমোঝোতা করবে। সেই কথামতো ধর্ষক নাঈম আর সাফাতের দুই বড় ভাইকে ধরে ভিকটিম মেয়েরা। দুই বড় ভাই বোঝায় ধর্ষকদের। ধর্ষক নাঈম আর সাফাত দাঁত বের করে হাসে। সাফাত বলে, ‘তাইলে বেইবি আমাদের বিয়া করবা?’ এই বলে হাসতে থাকে সেই বড় ভাইদের সামনেই। কোনো সমঝোতা-ই হয় না আর।
দুই ভিকটিমদের একজন হঠাৎ করে সমস্ত ক্রোধ নিয়ে জ্বলে ওঠে। আরেক ভিকটিমকে বলে, আমরা পুলিশের কাছে যাব। যা থাকে কপালে। সব বলব। এইভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
পুলিশে জানাবার আগে একজন ভিকটিম জানতে পারে সাফাতের ওয়াইফ আছে। সিদ্ধান্ত নেয় তাঁকে জানাবে সব প্রথমে। সাফাতের প্রথম স্ত্রী পিয়াসা কে খুঁজে বের করে একজন কিন্তু জানা যায় পিয়াসার সাথে ৮ মার্চ শাফাতের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
পিয়াসার কাছে অনুনয় বিনয় করে ভিকটিমদের একজন। বলে, আপু প্লিজ আমাদের সাথে একটু থানায় চলেন। পিয়াসা প্রথম দিন যায় অসহায় দুটি মেয়েকে দেখে কিন্তু তিনি বার বার সতর্ক করে দেন যে এই ছেলেদের যতটা খারাপ সে দেখেছে তার থেকেও দিগুণ খারাপ তাদের বাবা। বিশেষ করে সাফাতের বাবা দিলদার। নগরের সবচাইতে বড় সোনা চোরাচালানকারী।
পিয়াসা শুধু প্রথম দিন তাঁদের সাথে থানায় যায়।
এর পর গুনে গুনে তিন দিন থানার ওসি ফরমান আলী আর তদন্ত কর্মকর্তা মতিন তাদের ঘুরায়। এইসব কইরা কি হইব, বাসায় যাওগা, জানাজানি হইলে বিয়া হইব না, এরা প্রভাবশালী, এই বয়সে বিপদে পড়লে কিন্তু আর উঠতে পারবা না…এইসব বলতে থাকে ওসি ফরমান।
একটা পর্যায়ে নাছোড়বান্দার মতো থানায় পড়ে থাকে ভিকটিম আর তাঁদের মা’রা। থানা মামলা নেয়। ফরমান আর তদন্ত কর্মকর্তা মতিন যথাসাধ্য চেষ্টা করে মামলাটা শেষ করে দিতে।
এখন লন্ডনে রাত বাজে ৪টা। আমি ঘুমাইনি। ঘুমাতে পারিনি। আমার স্মৃতিতে, মজ্জায় শুধু মিশে আছে মেয়েটার হু হু কান্নার শব্দ। ভাই…প্লিজ…প্রধানমন্ত্রীকে একটু বলবেন। উনিতো মেয়ে…উনি বুঝবেন…
আমার চোখ ভেসে যায়…আমি বুঝতে দেই না। ভাইয়ের চোখের জলে বোন যদি আরো ভেঙে পড়ে…
আমি সন্তর্পণে কান্না লুকাই…
নিঝুম মজুমদার