সোমবার, ১৯শে জুন, ২০১৭ ইং ৫ই আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

রাস্তায় বাস কম, ভোগান্তি চলছেই

AmaderBrahmanbaria.COM
এপ্রিল ১৮, ২০১৭

---

যাত্রীদের জিম্মি করলে রুট পারমিট বাতিল করা হবে বলে বিআরটিএ বাস মালিকদের হুঁশিয়ার করলেও ঢাকাবাসীর দুর্ভোগের চিত্র পাল্টায়নি।

সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে বাসের সংখ্যা রোববারের মতই কম। তিনটি পরিবহন কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের হাতে থাকা দেড় শতাধিক বাসের এক তৃতীয়াংশই রাস্তায় নামেনি।

‘সিটিং সার্ভিস’ ব্যবস্থা উঠে গেলেও বিভিন্ন রুটের বাসে এখনও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ শোনা গেছে যাত্রীদের কাছে।

সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, রাজধানীতে ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধের পর দ্বিতীয় দিনেও মালিকরা গাড়ি কম নামিয়ে সড়কে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করায় তাদের ভোগান্তি পড়তে হচ্ছে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমান সোমবার  বলেন, কোনো পরিবহন কোম্পানি তাদের গাড়ি বন্ধ রাখলে রুট পারমিট বাতিল করে দেওয়া হবে।

“তারা গাড়ির রুট পারমিট নিয়েছে যাত্রীদের সেবা দেওয়ার জন্য। এখন যদি কেউ গাড়ি বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি সৃষ্টি করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। তাদের রুট পারমিট বাতিল করা হবে।”

গত ৪ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে ১৫ এপ্রিলের পর থেকে ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধের ঘোষণা দেয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। এরপর শনিবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানায়, ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বন্ধে রোববার থেকে অভিযান চালানো হবে।

রোববার সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন শুরুর পর অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বচসা-মারামারির ঘটনা ঘটে বিভিন্ন স্থানে। অনেক মালিক রাস্তায় গাড়ি না ছাড়ায় যাত্রীরা ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েন।

সোমবারও বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, বাস না পেয়ে বিভ্ন্নি মোড়ে যানবাহনের আশায় দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীরা। নারী যাত্রীদের ভুগতে হচ্ছে অনেক বেশি।

সকালে কালশী মোড়ে এক ঘণ্টা বাসে ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন মালতী রাণী দাশ বলেন, “গাড়িতে উঠতে পারতেছি না। গাড়ি যে কয়টা আসছে পুরুষ যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে উঠল, আমরা আর উঠতে পারি না।”

যমুনা ফিউচার পার্কের দোকান কর্মচারী আনিসুর রহমান জানান, কাজে যাওয়ার জন্য সকালে পূরবী থেকে অছিম পরিবহনের বাসে ওঠেন তিনি। রোববার তার কাছ থেকে ‘সিটিং ভাড়া’ ২৫ টাকা নেওয়া হলেও সোমবার ‘লোকাল ভাড়া’ ১৮ টাকা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস কম থাকায় ভোগান্তি ঠিকই হয়েছে।

বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের কথা-কাটাকাটির ঘটনা চোখে পড়েছে সোমবারও।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কালশী মোড়ে গ্যালাক্সি পরিবহনের চালকের সহকারী যাত্রীদের সঙ্গে বিতণ্ডার পর গাড়ি থেকে নেমে যান। এ অবস্থায় যাত্রীভর্তি বাসের চালকও সহকারী ছাড়া যেতে অস্বীকৃতি জানান।

বাসের চালক রাসেল মিয়া  বলেন, “মিরপুর ১১ নম্বর থেকে কাকলীর ভাড়া ১৮ টাকা। কিন্তু কেউ ১০ টাকা দেয়, কেউ ১৫ টাকা দেয়। হেলপারকে মারার পর হেলপার পালাইছে, আমি কেমনে যাব?”

পরে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট এসে ইসিবি চত্বর থেকে ভাড়ার চার্ট নিয়ে সে অনুযায়ী ভাড়া আদায়ের রফা করলে বাস গন্তব্যে ছেড়ে যায়।

সকাল ৯টার দিকে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় দেখা যায়, মিরপুর থেকে বাস নিয়ে কুড়িল এসে আর যেতে চাইছেন না চালকরা। কারণ জানতে চাইলে আকবর আলী নামে একজন চালক অভিযোগ করেন, যাত্রীরা ভাড়া ‘ঠিকমতো’ দেয় না। উল্টো ‘মারপিট করে’।

“আগে মিরপুর থেকে মহাখালী পর্যন্ত ২৫ টাকা ভাড়া আছিল। অহনও চার্টে ২২ টাকা ভাড়া আছে । কিন্তু যাত্রীরা দিবার চায় না। ১৫ টাকা দ্যায়, আবার অনেকে ১০ নম্বর থাইকা মহাখালী পর্যন্ত ১০ টাকা ভাড়া দেয়। সুপারভাইজার তো ওয়েবিলে ২০ ট্যাকা লেইখা দেয়। বাকি ট্যাকা আমি কইত্থন দিমু?”

কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় কথা হয় খিলক্ষেত থেকে আগারগাঁও রুটের যাত্রী সূর্যদেব সরকারের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “সিটিং ভাড়া আদায় একটু কমেছে। আগে খিলক্ষেত থেকে আগারগাঁও ৩০ টাকা ছিল, আজকে পঁচিশ টাকা নিয়েছে। কিন্তু বাস কম, যাত্রী যেতে পারছে না।”

সড়কে বাস কম থাকার কারণ জানতে চাইলে বসুমতি পরিবহনের পরিচালক খন্দকার মনির আহমেদ বলেন, বিভিন্ন পরিবহনের কর্মীদের সঙ্গে যাত্রীদের ‘ঝামেলা’ হওয়ায় চালকরা গাড়ি চালাতে চাইছেন না।

“গতকাল মারামারির পর অনেক ড্রাইভার আজ বের হয় নাই। সকালেও কয়েকটা বাসে মারধরের ঘটনা ঘটছে। ভাড়া কম পাওয়ায় অনেকে গাড়ি বন্ধ করে দিয়েছে।

“তবে আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে গাড়িতে নিয়ে আসার। যাত্রীদেরকেও বলছি, ভাড়ার চার্ট অনুযায়ী ভাড়া দেন। বেশিও দিয়েন না, কমও দিয়েন না।”

মোহাম্মদপুর-আবদুল্লাহপুর রুটের তেঁতুলিয়া পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ মাসুম জানান, তাদের পরিবহনে ৬৫টি বাসের মধ্যে ৪০টি সোমবার রাস্তায় নেমেছে।

বসিলা থেকে আব্দুল্লাহপুর রুটের প্রজাপতি পরিবহনের ৭০টি গাড়ির মধ্যে ২০টি বন্ধ আছে বলে জানিয়েছেন ওই পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএম রফিকুল ইসলাম।

একই রুটের পরিস্থান পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওয়াজ উদ্দিন জানান, তাদের ৩১টি বাসের মধ্যে ১৭টি এদিন চলাচল করেছে।

বিআরটিএর হিসাবে ঢাকা শহর ও শহরতলী রুটে ২ হাজার ২৮১টি বাস এবং ৩ হাজার ১২৬টি মিনিবাস চলাচল করে। এর মধ্যে ঠিক কতটি বাস সোমবার চলাচল করেছে তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

বাস না পেয়ে রোববার রিকশায় চড়ে ফার্মগেইট থেকে মিরপুরের বাসায় ফেরেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা তাসনিয়া রহমান। সোমবার সকালে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর বাস পেলেও তাকে অফিসে যেতে হয়েছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

তাসনিয়া বলেন, “যা ভিড়, এদিকে বাসও তেমন নেই। উপায় না দেখে দাঁড়িয়েই যেতে হচ্ছে। সিটিং সার্ভিস না থাকায় এখন গাদাগাদি করে যাত্রী তুলছে, গরমের মধ্যে সবাই কষ্ট পাচ্ছে। পৌঁছতেও সময় লাগছে বেশি। এভাবে তো নিয়মিত চলাফেরা করা সম্ভব না।”

রামপুরার একরামুন্নেছা স্কুলের শিক্ষক রাখী রায় বলেন, তার এলাকায় আগের সিটিং বাসগুলোতে লোকালের মত লোক তোলা হলেও সিটিং সার্ভিসের মতই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

“মেরাদিয়া থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত লোকাল ভাড়া ৫ টাকা। আমার কাছ থেকে আজকেও ১০ টাকা নিল।”

সদরঘাট থেকে প্রগতি সরণি হয়ে গাজীপুর চলাচলকারী সুপ্রভাত পরিবহনেও রোববারের তুলনায় ভাড়া কমানো হয়েছে। কিন্তু গাড়ি কম থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রামপুরা উলনের বাসিন্দা মেরাজ উদ্দিন।

“বাসে তো ওঠার জো নাই। গাড়ি ঠাসাঠাসি করে তবেই ছাড়ে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে হেল্পার বলে সামনে নাইমা হাইট্টা যান।”

সাংবাদিক নাদিয়া সারওয়াত জানান, সিটিং সার্ভিস বন্ধ করার পর নতুন ঝামেলা তৈরি হয়েছে। অনেক বাসে আর নারী আসন সংরক্ষণের নিয়ম মানা হচ্ছে না।

“পরিবহন শ্রমিক কিংবা যাত্রীদের বেশিরভাগই নতুন নিয়ম ঠিকমত জানে না। বাসের সংরক্ষিত আসন নিয়ে সবসময়ই ঝামেলা ছিল। কিন্তু এখন হেল্পাররা বলছে, শুনলাম সিটিং সার্ভিস নাই, তাই মহিলা সিটও নাকি নাই।”

বাসে ভাড়ার তালিকা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে যাত্রীদের মধ্যে। অনেক যাত্রী বিআরটিএর ২০১৫ সালের করা তালিকা অনুযায়ী ভাড়া দিতে নারাজ। এ নিয়ে পরিবহন শ্রমিকরদের সঙ্গে তর্কে জড়াচ্ছেন তারা।

বিমানবন্দর থেকে প্রজাপতি পরিবহনের বাসে ওঠা একরামুল হক মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত ১৫ টাকা ভাড়া দিচ্ছিলেন। বিআরটিএর তালিকা অনুযায়ী ওই পথের ভাড়া হয় ২১ টাকা।
বাসের হেলপার ২০ টাকা চাইলে একরামুল বলেন, “এই তালিকা ঠিক না। আগে অনেক বেশি ভাড়া নিছে। এখন কম নিক।”

বাসে ভাড়ার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন করলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৫ সালের পর আর নতুন করে তালিকা হয়নি। ভাড়ার তালিকা নিয়ে যাত্রীদের বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

সোমবারও রাজধানীর পাঁচটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে বিআরটিএ। এ অভিযানে ১১৯টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। জরিমানা করা হয় তিন লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা।

ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় দুজন চালককে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাকিম। এছাড়া একটি বাসের কাগজপত্র জব্দ এবং একটি গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়।

এ জাতীয় আরও খবর