নাসিরনগরের হামলা : চেয়ারম্যান আঁখিই ১৩টি ট্রাক ভাড়া করে লোক এনে হিন্দুদের উপর হামলা চালায়
ডেস্ক রির্পোট : একে একে থলের বেড়াল বেরোতে শুরু করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা। ঘটনার পর থেকেই সন্দেহের তীর ছিল হরিপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আতিকুর রহমান আঁখির দিকে। কিন্তু সে বিভিন্ন অজুহাত দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি প্রতিমন্ত্রী সায়েদুল হকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথাও অস্বীকার করে যাচ্ছেন। অবশেষে নাসিরনগরের আল-আমিন সাইবার পয়েন্ট ও স্টুডিওর মালিক জাহাঙ্গীর ও ট্রাক মালিক মো. নুরুল ইসলাম, চালক আহাদ মিয়া আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সব বের হতে শুরু করে। তারা আদালতে বলেছেন, হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখির নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর, রুবেল ও সৃজন নামে তিন ব্যক্তি ওই দিন ১৩টি ট্রাক লোক আনার জন্য ভাড়া করেন। তারাই আবার ট্রাকের ভাড়া পরিশোধ করে।
একটি সূত্র জানায়, গত বছরের ১৩ নভেম্বর বিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বিজয়নগরের আলীনগর গ্রামের পারভেজ খান বলেন, ‘৩০ অক্টোবর সকাল ৯টায় আমি সাতবর্গ টার্মিনালে ছিলাম। ওই সময় তিনজন লোক মোটরসাইকেলে সেখানে আসেন। তারা ট্রাকচালক আহাদ মিয়ার কাছে নাসিরনগরে সমাবেশ আছে বলে পাঁচটি ট্রাক চায়। ৫টি ট্রাক ১৫ হাজার টাকায় ঠিক করে তারা। এ সময় আমি সেখানে
উপস্থিত ছিলাম। ওই তিনজনকে আমি চিনতাম না। পরে জানতে পারি তাদের নাম জাহাঙ্গীর, রুবেল ও সৃজন।’ তিনি বলেন, ‘আমি একটি ট্রাক চালিয়ে যাই। আরও ছয়টি ট্রাকে লোকজন নিয়ে নাসিরনগর সদরে যাই। বিকালে ফেরার পর আল-আমিন সাইবার পয়েন্টের সামনে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক জাহাঙ্গীর আলম ভাড়া পরিশোধ করেন। ট্রাক মালিক নুরুল ইসলাম তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘ট্রাক্টর ও ট্রাকসহ চারটি গাড়ি লাগবে বলে মুঠোফোনে আঁখি চেয়ারম্যান জানান। ৩০ অক্টোবর সকালে আমার ও হীরা মোল্লার মালিকানাধীন দুটি ট্রাকে লোকজন নিয়ে নাসিরনগরে যাই। ট্রাকের চালক কামরুল মোল্লাকে দুটি গাড়ির জন্য চেয়ারম্যান চার হাজার টাকা দেন। আমি হীরা মোল্লার কাছ থেকে ভাড়া বুঝে নেই।’ এ ঘটনা জানাজানির পরই চেয়ারম্যান আঁখি গা ঢাকা দেন। গত ৫ জানুয়ারি রাজধানী থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ট্রাকের ভাড়া দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মফিজ উদ্দিন ভুইয়া জানান, গ্রেফতারের পর ট্রাকের ভাড়া পরিশোধ করা প্রসঙ্গে আঁখি স্বীকার করেছেন, ঘটনার দিন সকালে তিনি হরিণবেড় বাজারে আসার পথে উত্তেজিত জনতা তার গাড়ি আটকে তাকে তাদের আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। অন্যথায় তাকে নাস্তিক বলে অভিহিত করার হুমকি দেন। এ সময় তিনি সঙ্গে যোগ দেন। পরে তাদের চাপেই গাড়ি ভাড়া পরিশোধ করেন।
এদিকে, নাসিরনগরে হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তি হিসেবে আঁখির নাম সামনে আসায় এলাকায় নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, তিনি এলাকায় কখনও আওয়ামী লীগ কিংবা এর কোনো অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। অথচ গত বছরের মে মাসে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’র মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান বনে যান আঁখি। হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ফারুক মিয়াকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনীত করা হলেও কৌশলে দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি মনোনয়ন বাগিয়ে নেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেন। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে আঁখি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তোয়াক্কা করেননি। হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি মনগড়া একজনকে নির্বাচিত করেছেন। এ নিয়ে পরিষদের নারী ও পুরুষ সদস্যদের মধ্যেও দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। তার দাপটে এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষ কেউই মুখ খোলার সাহস পায়নি। হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের দুই নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দ্বীন ইসলাম, সংরক্ষিত নারী সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শাহান আরা বেগম অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচিত হওয়ার আগে কিংবা পরে কোনো সময়েই চেয়ারম্যান আঁখি এলাকায় বসবাস করতেন না। তিনি সপ্তাহে একদিন কিংবা দুদিন এলাকায় আসতেন। নানা প্রয়োজনে চেয়ারম্যানকে খুঁজে পেতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাসায় যোগাযোগ করতে হতো এলাকার মানুষদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রিমান্ডে আঁখি ট্রাক ভাড়ার কথা স্বীকার করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছেন। স্থানীয়দের অনুরোধে ট্রাক ভাড়া দিতে বাধ্য হন বলেও পুলিশকে জানায় চেয়ারম্যান আঁখি। এদিকে হরিপুরে বাজারে স্থাপিত অস্থায়ী ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, চেয়ারম্যান আঁখি গ্রেফতার থেকে এলাকার নিরাপত্তা জোরদারে পুলিশের আটটি টিম কাজ করছেন। এলাকার সার্বিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
আমাদের অর্থনীতি