সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ তায়ালার যিনি নিখিল বিশ্বের একমাত্র মালিক। যনি অসীম জ্ঞান, অনুগ্রহ ও ক্ষমতা বলে এই বিশ্বজাহান পরিচালনা করছেন। যিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করে তাকে দান করেছেন জ্ঞান ও বিবেক বুদ্ধির ন্যায় অমূল্য শক্তি আর সমাসীন করেছেন দুনিয়ায় তাঁর খিলাফতের মর্যাদায়। যিনি মানুষের পথ প্রদর্শনের নিমিত্ত যুগে যুগে নবীদের মারফত নাযিল করেছেন কিতাব সমূহ।
তাক্বওয়া শব্দটি আরবী বিকায়া থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থÑ বেঁচে থাকা, বিরত থাকা, দুরে থাকা ও ভয় করা ইত্যাদি বোঝায়। সাধারণ অর্থে আল্লাহ ভীতিকে তাক্বওয়া বলে, ফারসী ভাষায় তাক্বওয়াকে ফরহেজগারী বলা হয়। ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় তাক্বওয়া অর্থ হল- ইসলাম যে সব বিষয়ে চিন্তা করতে, বলতে ও করতে নিষেধ করেছে, কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার ভয়ে সে সব চিন্তা-ভাবনা, কথা-বার্তা ও কাজ-কর্ম করা থেকে বিরত থেকে দ্বীন ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা তদবীর করাকেই তাক্বওয়া বলা হয়। যারা এ গুনের অধিকারী হন তাদেরকে মুত্তাকীন বা ফরহেজগার বলা হয়।
তাক্বওয়া বা খোদাভীতি সম্পর্কে আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলেছেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত যিনি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু। সুরা (হুজরাত আয়াত-১৩)। অন্য আয়াতে তাক্বওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেন লক্ষ্য করে যে, সে আগামী দিনের জন্য কি সামগ্রীর ব্যবস্থা করে রেখেছে, আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের সে সব আমল সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা কর।” (সুরা হাশর, আয়াত-১৮)।
তাক্বওয়া সম্পর্কে আমাদের সমাজে অধিকাংশের মধ্যে ইসলামের সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে তাক্বওয়া বা ফরহেজগারী সম্পর্কে ধারনা হলো বাহ্যিক বেশ-ভূষা। যার মুখে লম্বা দাঁড়ি, মাথায় পাগড়ি, হাতে তাছবীহ্ এবং গায়ে লম্বা জামা থাকে তাকেই মুত্তাকী বা ফরহেজগার বলে মনে করে। অথচ শরীয়ত তাক্বওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাহ্যিক দিকের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়নি। প্রকৃত পক্ষে তাক্বওয়া হল-মনের মধ্যে আল্লাহর ভয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের সামনে তাক্বওয়া সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে তাঁর নিজের বুকের (কলবের) দিকে হাতের ইশারা দিয়ে তিন তিনবার বললেন তাক্বওয়া হলো এখানে (বুকের মধ্যে)।
অর্থাৎ অন্তরে যদি আল্লাহর ভয় পয়দা হয়ে যায় তাহলে তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে এবং আমলে তার প্রভাব পড়ে। এ সম্পর্কে রাসুল্লাল্রাহ (সা:) বলেনঃ হযরত আসমা বিনতে ইয়াজীদ (রা:) থেকে বর্ণিত ‘আমি কি তোমাদের উত্তম লোকদের সম্পর্কে বলবো? সাহাবীরা বললেন, জ্বি হাঁ বলুন হে আল্লাহর রাসুল (সা:) তিনি বললেন- তোমাদের মধ্যে তাঁরাই উত্তম যাদের (আমল) দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয় (ইবনে মাজাহ)। অর্থাৎ অন্তরের তাক্বওয়ার কারণে বাহ্যিক দিকও তাক্বওয়ার প্রভাবে ফুটে উঠে।
আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় কর, তাকে যে রূপ ভয় করা উচিত। আর তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সুরা আলে- ইমারান- ১০২)। অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন- আর সফলকাম হবে ঐ সমস্ত লোক যারা আল্লাহ ও রাসুলের হুকুম পালন করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তার নাফরমানী থেকে দুরে থাকে (সুরা নূর- ৫২)। ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, আল্লাহর নির্ধারিত রিযিক পূর্ণ মাত্রায় লাভ না করা পর্যন্ত কোন লোকই মারা যাবেনা, সাবধান আল্লাহ কে ভয় কর এবং বৈধ পন্থায় আয় উপার্জনের চেষ্টা কর। রিযিক প্রাপ্তিতে বিলম্ব যেন তোমাদেরকে অবৈধ পন্থা অবলম্বনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা কিছু রয়েছে তা কেবল আনুগত্যের মাধ্যমে লাভ করা য়ায় (ইবনে মাজাহ)।
তাক্বওয়ার একটি বাস্তব নমুনাঃ- তাক্বওয়া সম্পর্কে প্রচলিত একটি ঘটনা আছ্ েতা হলো একজন আলেম ওস্তাদ তাঁর কতিপয় ছাত্রের হাতে একটি চাকু ও একটি করে মুরগী দিয়ে বললেন: তোমরা মাঠের এক নির্জন স্থান থেকে একে জবাই করে নিয়ে আসবে যেখানে কেউ দেখবেনা। সকল ছাত্ররা ওস্তাদের কথা মতো হাতে চাকু এবং মুরগী নিয়ে নির্জন মাঠের মধ্যে গিয়ে জবাই করে নিয়ে আসলো। কিন্তু একজন ছাত্র আস্ত মুরগী এবং চাকুটি হুজুরকে ফেরত দিলো।
এতে উস্তাদ সেই ছাত্রটিকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি মুরগী জবাই করোনি কেন? প্রতি উত্তরে ছাত্রটি বললেন হুজুর আপনি মুরগী জবাই করার সাথে একটি শর্ত দিয়েছিলেন, তাহলো কেউ যেন না দেখে। কিন্তু আমি মাঠের নির্জন থেকে নির্জন স্থানে যেখানেই জবাই করতে যাই সেখানেই কোন মানুষ না দেখলেও মহা শক্তিধর আল্লাহ পাক আমার এই কাজটি দেখছেন। তাই আমি জবাই না করে আপনার শর্ত অনুযায়ী আস্ত মুরগী ফেরত নিয়ে এসেছি। এটাই হলো তাক্বওয়া বা খোদাভীতির বাস্তব উদাহরণ। তার কারণ মানুষ যে অবস্থায় যেখানেই থাকুক না কেন, সব কিছুই পরখ করছেন মহান সেই আল্লাহ তায়ালা।
সুতরাং তাক্বওয়া হচ্ছে এমন একটি মৌলিক গুন যার উপর গোটা মসলিস জামায়াত টিকে আছে এবং তাদের প্রতিদিনের কর্তব্য পালন করে যাচ্ছে। তাক্বওয়ার এই গুনটির অভাবে একটি সমাজ জাহেলী সমাজে পরিনত হয়। মানুষের মধ্যে কোনো সৎ নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারেনা। এই গুনটি যদি নেতৃত্বের মধ্যে না থাকে তাহলে নেতৃত্ব যতই বলিষ্ট নেতৃত্ব হোক না কেন, তা হবে জাহেলী নেতৃত্ব, যা সাধারণ মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমাদের জন্য যা শিক্ষনীয় রয়েছে তা হলো: আমাদেরকে খাঁটি এবং নিষ্ঠাবান ঈমানদার হতে হবে।
ঈমানের ক্ষেত্রে কোথাও কোনো দুর্বলতা ও সংশয় রাখা যাবে না। খোদাভীতি এমনভাবে অর্জন করতে হবে যাতে শয়নে-বসনে, চলনে-বলনে প্রতিটি অবস্থায় এবং প্রতিটি মুহুর্তে আল্লাহর ভয় মনের মধ্যে জাগরুক থাকে। দেহের প্রতিটি অংগে খোদাভীতি ফুটে উঠে। এছাড়াও সদা সর্বদা ইসলামের উপর কায়েম থাকতে হবে। ইসলামের প্রতিটি আহকাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পালন করে যেতে হবে। কুফরী বা গুনাহর কাজে জড়িত হবার সাথে সাথে আল্লাহর ভয় এবং মরনের কথা স্মরণ করে সেই সব কাজ হতে দুরে সরে যেতে হবে।
আল্লাহ পাক আমাদেরকে একজন পূর্নাঙ্গঁ তাক্বওয়াবান হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।