বৃহস্পতিবার, ২১শে জুন, ২০১৮ ইং ৭ই আষাঢ়, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

জাল নোটের ৫০ চক্র সক্রিয়

FakeMoney1435228012নিউজ ডেস্ক : সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল নোট তৈরির চক্র। রমজান ও ঈদকে টার্গেটে রেখে ওই চক্র বেপরোয়া। আর ওই চক্রকে জাল টাকা তৈরিতে সহযোগিতা করছে বিদেশি একটি বিশেষ সংস্থা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তথ্যানুযায়ী বর্তমানে ঢাকাকেন্দ্রিক অন্তত ৪০-৫০টি সক্রিয় চক্র রয়েছে। ডিবির সহকারী কমিশনার মাহমুদ নাসের জনি জানান, জাল নোট তৈরির চক্রগুলোর মধ্যে এখন টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা চলে। কারণ যে চক্রের টাকা যত নিখুঁত, তার টাকার দাম তত বেশি, বিক্রিও বেশি। নিখুঁতের মানদ- অনুযায়ী এক লাখ টাকার বান্ডিল ১২ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় ৪৫ থেকে ৫০টি জাল নোট চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি চক্রে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে ওই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কেউ কেউ জামিনে বেরিয়ে ফের একই পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। তিনি জানান, অপরাধী চক্র জাল টাকার ডিজাইন ও ছাপার কাজটি বরাবরই নিখুঁতভাবে করে আসছিল। তবে শুধু বিশেষ ধরণের কাগজ তৈরির ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা ছিল। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা কাগজ প্রায় আসলের মতো দেখতে হলেও তাতে কিছু ত্রুটি ছিল। এবার টাকার আসল কাগজই জাল নোট চক্রের হাতে এসেছে। পাকিস্তান থেকে পাঠানো সেই কাগজে ছাপানো কিছু নোট ইতিমধ্যেই বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এমন কয়েকটি নোট গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে। সেগুলো এতোটাই নিখুঁত যে জাল টাকা হিসেবে শনাক্ত করাই মুশকিল। ওই সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পারে, পাকিস্তানের বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা টাকা তৈরির কাগজ এদেশে পাঠাচ্ছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের দ- কার্যকরের ক্ষেত্রে দেশটির আহ্বান না শোনায় ক্ষিপ্ত হয়েই তারা এই অপতৎপরতা শুরু করেছে বলেও তথ্য মিলেছে।

সূত্র মতে, পাকিস্তানের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে ভারতের জাল রুপি ছাপারও অভিযোগ রয়েছে। আইএস ‘রুপি’ নামে পরিচিত ওই রুপি ছাপা হয় হবহু আসল রুপির কাগজে। তারপর বিভিন্ন রুটে তা ভারতে পাঠানো হয়। সেক্ষেত্রে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এমন জাল রুপি পরিবহনে জড়িতরা বাংলাদেশে ধরাও পড়েছে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হয়। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। এমন পরিস্থিতিতে সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের টাকার হুবহু আসল কাগজ এখানকার জাল নোট চক্রের কাছে পাঠাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা ওই কাগজ আসল টাকার সব বৈশিষ্ট্যই ধারণ করে। এমনকি গোয়েন্দারাও অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হয়েছেন যে নোটটি জাল।

সূত্র জানায়, বিগত পাঁচ-ছয় মাস আগেই এদেশের গোয়েন্দারা পাকিস্তান থেকে টাকার কাগজ আসার বিষয়টি প্রথম জানতে পারে। তবে তখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। পরে এমন কিছু জাল নোট যাচাই এবং সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে সে সম্পর্কে তথ্য মেলে। ঢাকায় জাল টাকার অন্তত ৩৫ জন কোম্পানি রয়েছে। কোম্পানি বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝায় যাদের জাল টাকা ছাপার পুরো ব্যবস্থা রয়েছে। একজন কোম্পানির কমপক্ষে দু’জন হ্যান্ডল বা সহযোগী থাকে। সহযোগীদের কাজ হলো কম্পিউটার প্রিন্টারে কাগজ দেয়া এবং প্রিন্ট বের হলে তা টাকার আকারে কেটে গুছিয়ে বান্ডিল করে রাখা। এবারের ঈদবাজারে ছোট-বড় কোম্পানির টার্গেট ১৫ কোটি টাকার জাল নোট ছেপে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া।

র‌্যাব-পুলিশ সূত্র জানায়, জাল নোট ব্যবসায়ী প্রতিটি চক্রের একজন করে দলনেতা থাকে। শীর্ষ দলনেতাদের মধ্যে রয়েছেন- ছগীর মাস্টার, কামাল মাস্টার, জাকির, জামান, প্রফেসর সেলিম ওরফে কানা সেলিম, হুমায়ুন, মোস্তফা, সালমা, রুবিনা, রশিদ, মনির, আমজাদ, রহিম বাদশা, ইমন, মাহবুব মোল্লা ও পলাশ। তাদের মধ্যে শাহাবুদ্দিন, জাকির ও রহিম বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি এপ্রিল পর্যন্ত জাল নোট বিষয়ে মোট মামলার সংখ্যা পাঁচ হাজার ৯৩৩টি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে জাল নোট বিষয়ে ১৪৫টি মামলা হয়েছে। এ সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৭টি।

উল্লেখ্য, জাল নোটের কারবারিরা ধরা পড়লেও সাক্ষীর অভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। জাল নোট চক্রের হোতাদের নেটওয়ার্কে থাকে খদ্দের ও কামলা বলে দুই শ্রেণীর মানুষ। খদ্দেররা সরাসরি কোম্পানি থেকে পাইকারি দরে জাল নোট কিনে নিজ নিজ এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে তাদের কাছ থেকে অল্প পরিমাণে নোট কিনে নেন কামলা বা খুচরা বিক্রেতারা। তারা সাধারণত এক হাজার টাকার ১০টি নোট অর্থাৎ ১০হাজার টাকা নেনে তিন হাজার টাকায়। অন্যদিকে খদ্দেররা মানভেদে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় কেনে এক হাজার টাকার নোটের ১০০টির এক বান্ডিল। ওই পরিমাণ জাল টাকা উৎপাদনে কোম্পানির খরচ পড়ে মাত্র তিন থেকে চার হাজার টাকা।

সূত্র আরো জানায়, জাল নোট তৈরির ক্ষেত্রে চারটি ভাগে কাজ হয়। এক ভাগের লোকজন শুধু নিরাপত্তা সুতা তৈরি করে। দ্বিতীয় ধাপের লোকজন ওই সুতা কিনে জলছাপসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিশেষ ধরণের কাগজ তৈরি করে। ওই কাগজ কেনে নেয় কোম্পানি বা চক্রের হোতারা। আরেক ধাপের লোকজন টাকার মূল ডিজাইন করে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মাহমুদ নাছের জনি জানান, নিখুঁত জাল নোট তৈরির ক্ষেত্রে চক্রগুলোর মধ্যে সব সময়ই প্রতিযোগিতা চলে। যার টাকা যতো বেশি খুঁতহীন হবে, তার টাকার বিক্রয়মূল্যও ততো বেশি হবে। ওই কারণে তারা নানাভাবে আসলের মতো দেখতে জাল নোট তৈরির জন্য রীতিমতো গবেষণা চালায়। তবে সে বিষয়ে গোয়েন্দারা সতর্ক রয়েছে।

বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন ধরাও পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা এ প্রতিবেদককে বলেন, বিভিন্ন শপিংমলে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিনের পাশাপাশি জনসচেতনতা গড়ে তোলার ফলে জাল নোটের বিস্তার আগের তুলনায় কমেছে। এটি আরও কমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকগুলোকে সচেতনভাবে লেনদেন করতে বলা হয়েছে। আ/সং

Print Friendly, PDF & Email