বৃহস্পতিবার, ২১শে জুন, ২০১৮ ইং ৭ই আষাঢ়, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

সিঁধেল চুরি নয় সাইবার চুরি

aff51d401ad971010ee93328209a959e-cyber-crimeআন্তর্জাতিক ডেস্ক :তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে চুরির ধরন পাল্টে গেছে। ঘরে ঢুকে চুরি করার চেয়ে চোর এখন স্মার্ট পদ্ধতিতে চুরি করছে। আগের দিনের সিঁধেল চুরির চেয়ে এখন অনলাইনে দুর্বৃত্তপনা বাড়ছে। সাইবার দুর্বৃত্তরাই এখন পুলিশের মাথাব্যথার কারণ। সম্প্রতি সাইবার অপরাধ নিয়ে দ্য ইকোনমিস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নত বিশ্বের তুলনায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই যুক্তরাজ্যে প্রথাগত অপরাধ কমতে শুরু করে। ১৯৯৫ সাল থেকেই গাড়ি চুরি ও সিঁধেল চুরির হার ৭৯ ও ৬৭ শতাংশ কমেছে। এর পেছনে রয়েছে প্রযুক্তির অবদান। গাড়ি ও বাড়িতে উন্নত প্রযুক্তি ও অ্যালার্ম ব্যবহার করার কারণে গাড়ি চুরি কঠিন হয়ে গেছে। এ ছাড়া সিসিটিভি ও ডিএনএ ডেটা বেইসের কারণে চুরি করে ধরা খাওয়ার হারও বেড়েছে। এ ছাড়া প্রযুক্তি পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় বাড়িতে ঢুকে তা চুরির ঝুঁকি নিতে চায় না কোনো চোর। এর বদলে দুর্বৃত্তদের চোখ এখন অনলাইন দুনিয়ায়। 

যুক্তরাজ্যের সাইবার নিরাপত্তা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপার্স (পিডব্লিউসি)-এর বিশেষজ্ঞ চার্লি ম্যাকমারডি এ প্রসঙ্গে বলেন, সাইবার অপরাধের দিক থেকে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য। উন্নত দেশ হিসেবে এখানে অবকাঠামো, অনলাইন লেনদেন ও প্রযুক্তি সুবিধা সবই রয়েছে। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। ৮০ শতাংশ বাড়িতে ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বাড়িতে বসে অনলাইনে কেনাকাটা করেন। পিডব্লিউসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার হার ৬৯ শতাংশ, যেখানে পুরো বিশ্বে সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার হার ৫৯ শতাংশ। 

‘সাইবার অপরাধ’ শব্দটি দিয়ে সরকারি ওয়েবসাইটে সাইবার হামলা থেকে শুরু করে সাধারণ ই-মেইলে ভুয়া পুরস্কার দেওয়ার ই-মেইল প্রতারণাকেও বোঝানো হয়। 

ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ তত্ত্ববিদ ডেভিড ওয়াল মনে করেন, সাইবার অপরাধে ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় ধরলে তা মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু অনেক সময় বড় মাত্রায় ঘটে যায় ছোটখাটো অনেক অপরাধ। কিন্তু ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার ভুয়া আমন্ত্রণ গ্রহণ করার মতো সাইবার দুর্বৃত্তপনার মুখে পড়ার চেয়ে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হওয়ার মধ্যে কারিগরি অনেক পার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাজ্য বা অন্য কোনো দেশেও তাই সাইবার অপরাধের মাত্রা নির্ণয় করাটাও কঠিন। 

২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে গেট সেফ অনলাইন নামের একটি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের অর্ধেক জনগোষ্ঠীই তথ্য চুরি, হ্যাকিং ও অনলাইন নিপীড়নের মতো সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সরকারি সংস্থাগুলোও অনলাইনে ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংক প্রতারণার বিষয়গুলোর কথা স্বীকার করেছে। তাই এটা বলা যায়, গত দশকে যুক্তরাজ্যে সাধারণ অপরাধ কমলেও এর ঠিক উল্টোটাও ঘটেছে অনলাইনে।

অনেক সময় সাইবার অপরাধের বিষয়টি পুলিশের কাছে অভিযোগ হিসেবে আসে না। ২০১৩ সালের অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠানের করা গবেষণায় দেখা গেছে, মোট সাইবার অপরাধের মাত্র ২ শতাংশ পুলিশের কাছে আসে। এ ছাড়া অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, ১০০ জনের মধ্যে মাত্র একজন তাঁর তথ্য চুরির ঘটনা পুলিশকে জানান। অনেকেই তাঁর তথ্য চুরি হওয়ার ঘটনা বুঝতে বা ধরতেই পারেন না। আবার অনেকেই ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাকের শিকার হয়ে বিরক্ত হলেও পুলিশের কাছে যান না, বরং তারা সাহায্যের জন্য ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর কাছে যান। 

কোনো প্রতিষ্ঠান হ্যাকের শিকার হলে তা চেপে যায়, পাছে গ্রাহক ও প্রতিদ্বন্দ্বীরা তা জেনে যায় এবং ব্যবসার ক্ষতি হয়। পিডব্লিউসির বিশেষজ্ঞ ম্যাকমারডি বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক মনে করে, পুলিশের কাছে হ্যাকিং বিষয়ে অভিযোগ দিয়ে ফায়দা কম। এর পরিবর্তে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দেয়। কারণ, ওই সব প্রতিষ্ঠান মনে করে, প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষজ্ঞরা তাঁদের দক্ষতা দিয়ে দ্রুত সমস্যা সমাধান করতে পারবেন। 

অনলাইনে শিশুরাও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। চুরি বা সম্মানহানির চেয়ে অনলাইনের এই নিপীড়ন দুশ্চিন্তা বেশি বাড়াচ্ছে। কারণ, দূর থেকে এ ধরনের নিপীড়ন করা হয়। অনলাইন অপরাধ বিষয়ে দরকারি তথ্যের ঘাটতি থাকায় তা নিয়ে বেশি দূর এগোনো যায় না। সাইবার অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবেও পুলিশ কাজ শুরু করতে পারে না। গত বছরের নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের পুলিশ সাইবার দুর্বৃত্তদের সঙ্গে পেরে না ওঠায় সমালোচনার মুখেও পড়ে। 

সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশকে তাই নিয়ম পরিবর্তন করতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছে পুলিশ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন সাইবার অপরাধবিষয়ক তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করছে। ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাইবার সিকিউরিটি ইনফরমেশন শেয়ারিং পার্টনারশিপ নামের একটি চুক্তিও করেছে। সাইবার দুর্বৃত্তদের মতো পুলিশও এখন গোপনে তাদের ঠেকাতে কাজ করছে। 

নিরাপদ বিনিয়োগ

সাইবার অপরাধকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে যুক্তরাজ্যের পুলিশ। দেশটির সরকারও ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার সাইবার নিরাপত্তা কর্মসূচিতে খরচ করছে। গত বছরের আগস্ট মাসে লন্ডনে সাইবার অপরাধ ও প্রতারণা ঠেকাতে মেট্রোপলিটন পুলিশ ফ্যালকন নামে একটি ইউনিট চালু করেছে। এ ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের সাইবার প্রতারণার বিষয়ে অ্যাকশন ফ্রড নামের জাতীয় তদন্ত সংস্থাকে জানাতে বলা হয়েছে। 

সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ অ্যালান উডইয়ার্ড এ প্রসঙ্গে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনলাইনে সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় যুক্তরাজ্য ভালো করছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ছোটখাটো বিষয়গুলো সামাল দেওয়া গেলেও বড় অপরাধ ঠেকানো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কারণ বেশির ভাগ আক্রমণ হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। যুক্তরাজ্য তাই বৈদেশিক নীতিমালা নিয়ে ইউরোপোলের মতো সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে গেলে তারা বেশি গুরুত্ব দেন না। এর কারণ হচ্ছে তাদের অজ্ঞতা বা এ বিষয়ে ঠিকভাবে তদন্ত করতে না পারার বিষয়টি। এ ছাড়া সহিংসতা ও ক্ষতির বিষয়টি চাক্ষুষ না হওয়ায় তাঁরা এটাকে জরুরি মনে করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়গুলোর গুরুত্ব দিতে গেলে সাইবার অপরাধের গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয় না। এখন প্রশ্ন উঠছে যে অনলাইনের এই প্রতারণা ঠেকাতে পুলিশের কত সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করা উচিত।

গাড়ি চুরিকে অপরাধতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা ‘ডেব্যু ক্রাইম’ বা শুরুর অপরাধ মনে করেন। কারণ গাড়ি চুরি দিয়ে আরও বড় অপরাধের শুরু করতে পারে দুর্বৃত্তরা। গবেষক ওয়াল এ প্রসঙ্গে বলেন, সাইবার অপরাধকে তাই এ ধারায় ফেলা যায় না। সাইবার দুর্বৃত্তদের অর্থ হাতানোর জন্য বা অন্যান্য অপরাধ ঘটানোর জন্য আবার একই ঘটনা ঘটাতে না-ও হতে পারে। তাদের কাজটি তখন আরও জটিল হয়ে যায়।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী রিচার্ড ক্লেটন বলেন, সাইবার অপরাধ ঠেকাতে শুরুতেই দুর্বৃত্তদের রুখে দিতে হবে। কিছু ব্যতিক্রম রেখে নতুন নতুন স্প্যামারদের সবাইকে আটক করতে হবে। 

গবেষক রিচার্ড বলেন, আজকের পশ্চিমা দুনিয়ায় কেউ বিশ্বাস করে না যে আপনার গরু চুরি হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে তা উদ্ধার করে দিয়ে যাবে। তার চেয়ে নিজের গরু নিজেই সামলে রাখা ভালো।

Print Friendly, PDF & Email

এ জাতীয় আরও খবর

নীতিমালা না মেনেই ব্যবসা করছে পাঠাও!

৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগই জলে যাবে!

ইউটিউবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ইনস্টাগ্রামের

মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীদের আরাম শেষ!

সাইকেল চালিয়েই নদী পার!

রেল পণ্য উৎপাদনে ইরান