বিশ্বকাপ ২০১৮ : ফাইনাল পুনরাবৃত্তি নাকি নয়া ইতিহাস
নব্বই মিনিট, অথবা আরও আধা ঘণ্টা যোগ হয়ে একশ’ বিশ মিনিট… তবু না হলে খুব বড়জোর পাঁচ দফার পেনাল্টি শুট- এই তো! এটুকুই আজ বিশ্বসেরা হওয়া-না হওয়ার ব্যবধান। এটুকুই সময় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির, নয়তো নতুন ইতিহাস রচনার। দেড় অথবা দুই-সোয়া দুই ঘণ্টায় লেখা হবে স্বপ্নপূরণ আর স্বপ্নভঙ্গের গল্প; কারও জন্য জন্ম হবে জীবনের সবচেয়ে সোনালি মুহূর্তের, কারও বা এক জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপের।
প্রতিষ্ঠিত ফুটবলশক্তি ফ্রান্স নাকি নতুন শক্তি ক্রোয়েশিয়া- কার শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চায়ন হবে আজকের মস্কোর লুঝনিকিতে? তারুণ্যের গতি আর উত্তরাধিকার সূত্রের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে ফরাসিরাই হয়তো এগিয়ে। কিন্তু অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর একঝাঁক ক্ষুধার্ত, মরিয়া ক্রোয়াটরাও কি খুব বেশি পিছিয়ে? প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের দুই দশকপূর্তির বছরে ফ্রান্স যেমন দ্বিতীয় শিরোপার জন্য ব্যাকুল, তেমনি অবিস্মরণীয় বিশ্বকাপযাত্রার পূর্ণতা দিয়ে প্রথম শিরোপার আকুলতা কম নয় ক্রোয়েশিয়ারও তো। যুদ্ধ ময়দানে জয়ী হয় একজনই, লড়তে লড়তে টিকে থাকা শেষ দু’জনের একজনকে। তাই প্রাণ হারাতেই হয়! কে হারাবে প্রাণ, কে জিতবে বিশ্বজয়ের হাসি- সেই কৌতূহল নিয়েই আজ টিভি সেটের সামনে বসবে বিশ্বের প্রায় এক বিলিয়ন দর্শক। বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় শুরু বিশ্বকাপ ফাইনাল নামের সেই যুদ্ধে প্রস্তুত ইউরোপের দুই দেশ ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়া।
প্রস্তুত আসলে তারা অনেক আগে থেকেই। ফ্রান্সকে নিয়ে ক্রোয়েশিয়া আর ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে ফ্রান্সের প্রস্তুতি বুধবার রাতের দ্বিতীয় সেমির পর শুরু হয়নি। শুরুটা গত বছর। গ্রুপ পর্বে ফরাসিরা ছিল ‘সি’ গ্রুপে, ক্রোয়াটরা ‘ডি’ গ্রুপে। বিশ্বকাপ শুরুর আগের যে বাস্তবতা, সে অনুসারে ফ্রান্স গ্রুপসেরা আর ক্রোয়েশিয়া গ্রুপ রানার্সআপ হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে দুই দলের দেখা হয়ে যেত দ্বিতীয় রাউন্ডেই। গত বছরের শেষ দিকে গ্রুপিং হওয়ার পরপরই তাই ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া একে অপরকে নিয়ে ‘হোমওয়ার্ক’ সেরে রাখতে শুরু করে। কিন্তু ‘ডি’ গ্রুপে আর্জেন্টিনা রানার্সআপ আর ক্রোয়েশিয়া চ্যাম্পিয়ন হলে সব গড়বড় হয়ে যায়। যে লড়াই হওয়ার কথা শেষ ষোলোয়, শেষ পর্যন্ত তা এখন শিরোপা নির্ধারণী ফাইনালে। তবে একে অপরকে নিয়ে ‘জানাশোনা’ তাদের পুরনো হলেও এ পর্যায়ে সেসবের প্রাসঙ্গিকতা স্বল্পই। ‘এভারেজ’ থেকে ক্রোয়েশিয়ার ‘বেস্ট টু টিমে’র একটি হয়ে ওঠাই যার মোক্ষম প্রমাণ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেই নিজেদের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জনটি পেয়ে গেছে লুকা মডরিচের দল।
গতকাল ফাইনাল-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে এসে কোচ জল্গাটতো দালিচও সে রকমই বলে গেলেন, ‘আগামীকাল (আজ) জিতি বা হারি, ক্রোয়েশিয়ায় ভূকম্পনের মতো আলোড়ন উঠবে। একজন খেলোয়াড় বা কোচের জীবনে বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো দিন তো আর হতে পারে না। যাই ঘটুক, আমরা খুশি থাকব। গর্বিত হবো।’ ক্রোয়েশিয়া হয়তো রানার্সআপ হলেও খুশি, কিন্তু ফ্রান্সের ব্যাপারটা আলাদা। ১৯৯৮ সালে প্রথমবার ফাইনালে উঠে ব্রাজিলকে হারিয়েছিল সেবারের স্বাগতিকরা। এরপর ২০০৬ বিশ্বকাপেও ফাইনালে ওঠে জিনেদিন জিদানের ফ্রান্স। কিন্তু জিদানের ঢুঁশ-কাণ্ডের বহুল আলোচিত সেই ফাইনালে টাইব্রেকারে গিয়ে হারতে হয় ইতালির কাছে। কেবল বিগত ফাইনাল নয়, ফ্রান্সের আক্ষেপের আরেক কারণ ২০১৬-এর ইউরো।
দুই বছর আগের সেই টুর্নামেন্টে ফাইনালে উঠলেও পর্তুগালের কাছে হেরে গিয়েছিলেন গ্রিজম্যানরা। রাশিয়ায় এবার ফাইনাল নিশ্চিতের পর গ্রিজম্যান, পগবা, মাতুইদিরা একাধিকবার বলেছেন, আত্মতুষ্টিতে ভোগাই ছিল সেই হারের মূল কারণ। এবার তারা ভুল করতে চান না। প্রতিপক্ষ যেমনই হোক, বিশ্বকাপটা তারা ঘরে নিয়েই ফিরতে চান। ফ্রান্স এবার রাশিয়ায় পা রেখেছিল ফেভারিটের তকমা গায়ে দিয়েই। গ্রুপপর্ব মনমতো না হলেও নকআউট থেকে স্বরূপে দেখা দেয় দিদিয়ের দেশমের দল। দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনা, কোয়ার্টারে উরুগুয়ে আর সেমিফাইনালে বেলজিয়ামকে হারায় তারা। বিপরীতে ক্রোয়েশিয়ার যাত্রাপথ তুলনামূলক সহজ ছিল। আর্জেন্টিনা, আইসল্যান্ডের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দ্বিতীয় রাউন্ডে ডেনমার্ক, কোয়ার্টারে রাশিয়া আর সেমিতে ইংল্যান্ড। এর মধ্যে তিনটি ম্যাচই গড়িয়েছে অতিরিক্ত আধা ঘণ্টায়।
ডেনমার্ক ও রাশিয়ার বিপক্ষে জয়ের মীমাংসা হয় তারও পরে- টাইব্রেকার শুটে। তিন নকআউট ম্যাচ মিলিয়ে ফ্রান্সের চেয়ে ৯০ মিনিট বেশি খেলতে হয়েছে ক্রোয়াটদের। বেশি খেলার ক্লান্তির সঙ্গে আছে স্বল্প বিশ্রামও। ফ্রান্স ফাইনাল নিশ্চিত করে মঙ্গলবার রাতে, ক্রোয়েশিয়া বুধবারে। সব মিলিয়ে ফাইনালে নামার আগে ফ্রান্সের চেয়ে ক্রোয়াটরাই খানিকটা পিছিয়ে। দালিচ খুব ভালো করেই জানেন, মডরিচ, রাকিটিচ, পেরিসিচ, মানজুকিচদের মরিয়া চেষ্টার ফসলেই ক্রোয়েশিয়ার ফাইনালে আগমন। অধিক পরিশ্রম আর শারীরিক ধকলের জন্য ছোটখাটো চোটও পেয়েছেন কেউ কেউ। ক্রোয়েশিয়া কোচ অবশ্য কারও নাম বলেননি। তবে খেলোয়াড়রা তাকে ‘ফিট না থাকলে বদলে ফেলা’র অনুরোধ করেছেন বলে জানিয়েছেন দালিচ। ফ্রান্সের অবশ্য এ ধরনের কোনো সমস্যা নেই।
গ্রিজম্যান, এমবাপ্পে, পগবা, মাতুইদি, কান্তেরা সবাই শতভাগ ফিট। দেশম-জিদান-অঁরিদের দল-পরবর্তী এই স্কোয়াডটিকে বলা হচ্ছে ফ্রান্সের সেরা দল। লুঝনিকিতে আজ সেই শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ করতে হবে এমবাপ্পেদের। পাশাপাশি অনন্য এক অর্জন হাতছানি দিচ্ছে কোচ দেশমকেও। ‘৯৮-এ শিরোপা হাতে তোলার সময় তিনি ছিলেন অধিনায়ক। এবার সুযোগ কোচ হয়ে হাতে তোলার। ফুটবল ইতিহাসে খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতার কৃতিত্ব আছে কেবল মারিও জাগালো আর ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের। তবে শনিবার কোচ হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসা দেশম জানিয়ে দিয়েছেন, তার তৃতীয় ব্যক্তি হওয়া নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই। মনোযোগ তার ফ্রান্সের দ্বিতীয় শিরোপায়।
শেষ পর্যন্ত আসলে কী ঘটবে? ফ্রান্স দ্বিতীয় শিরোপা জিতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে, নাকি প্রথমবার ফাইনালে উঠেই ইতিহাস তৈরি করবে ক্রোয়েশিয়া?