গানের দানে জীবন চলে যাদের
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পৌর মুক্তমঞ্চ ময়দানে ছয়জন মানুষকে ঘিরে ছোটখাটো জটলা। দলগতভাবে গান গাইছেন তারা। গান গাইতে গাইতে একজন বাজাচ্ছেন হারমোনিয়াম, অন্য একজন ঢোল, আরও একজন করতাল। গান শুনে জড়ো হওয়া লোকজন তাদের টাকা দিচ্ছেন।
ছয় জনের দলটি প্রথমে গাইলেন ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’। একে একে গাইলেন আরও কয়েকটি গান। তাদের গানের সঙ্গে তালি দিচ্ছিলেন জড়ো হওয়া লোকজন। শুধু তালি নয়; গান চলাকালীন তারা ওই দলটিকে দিচ্ছিলেন টাকাও।
একপর্যায়ে থামলো গান। কথা বলার সুযোগ হলো ওই দলের অভিভাবক ও মূল গায়ক মো. হেলাল মিয়ার সঙ্গে। জানা গেল, ওই দলের সবাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। একেবারে জন্ম থেকেই অন্ধ। দলের বাকি পাঁচ সদস্য হেলাল মিয়ারই ছেলেমেয়ে। তারা হলো, সাদেমিয়া, ফারুক, তারেক, বারেক ও খাইরুল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় গান করেন তারা। প্রায়ই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাইরেও যান। আর এভাবে গান গেয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন।
তিনি জানান, স্ত্রীসহ ১০ জনের পরিবার তার। থাকেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরতলীর রাজঘর গ্রামে। জন্ম থেকেই তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তার পাঁচ ছেলেও জন্মান্ধ। অন্ধ হওয়ার কারণে একটা সময় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছিলেন তিনি। এরপরই গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন।
তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের খ্যতিমান আধ্যাত্মিক গানের শিল্পী ওস্তাদ শাহনূর শাহ্ এর কাছ থেকে তিনি তালিম নেন। এরপর আর গান ছাড়তে পারেননি। এক পর্যায়ে ছেলেমেয়েদেরও গান শেখান। শুধু গান নয়; ছেলেমেয়েদের হারমোনিয়াম, করতাল, তবলা, ঢোল বাজাতেও শেখান। এখন তার ছেলেমেয়েরা গান-বাজনায় পটু হয়ে উঠেছে।
তিনি আরও জানান, সব ধরণের গানই তারা করেন। তবে আধ্যাত্মিক গান বেশি করেন। মাঝে মাঝে শ্রোতাদের অনুরোধে হিন্দি গানও করেন। এতে লোকজন মুগ্ধ হয়ে হাততালি দেয়। এটা তার খুব ভালো লাগে।
হেলাল মিয়ার ভাষ্য, গান গেয়ে মানুষের মন জয় করে যা পান তা দিয়েই মূলত তার সংসার চলে। সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু টাকা পান তিনি, তবে তা যৎসামান্য।
কথায় কথায় তিনি জানান, ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি তাদের ফরিদপুর ডেকে নিয়ে যান হানিফ সংকেত। তার পর সেখানে তার পরিবার নিয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র জন্য একটি পর্ব রেকর্ড করা হয়, যা ২৯ জানুয়ারি প্রচার হয়। ওই সময় অনুষ্ঠানে হানিফ সংকেত তার হাতে দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন। সেই স্মৃতি এখনও তিনি ভুলতে পারেননি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘পরিবারটি সম্পর্কে আমি অবগত। তাদের সাহায্যের জন্য কার্যকরী কিছু করবো বলে ভেবে রেখেছি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোস্তফা মাহমুদ সারোয়ার বলেন, ‘দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এ পরিবারের সদস্যদের আমি চিনি। পরিবারটির ছয় সদস্যের পাঁচ জনকে প্রতি মাসে ৬শ’ টাকা করে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। বাকি একজন সদস্যকে ভাতা দেওয়া হবে। এতে এ পরিবার প্রতি মাসে কেবল জেলা সমাজসেবা অধিদফতর থেকে তিন হাজার ৬শ’ টাকা পাবে।’