নির্যাতনেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন সৌদি ফেরত নারীরা!
নিউজ ডেস্ক: মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের নির্ধারিত ওয়ার্ডের নির্দিষ্ট বেডে গিয়ে দেখা যায়, সেটি ফাঁকা। এই বেডের রোগী কোথায় জানতে চাইতেই পাশের বেডের রোগীর স্বজন বলে উঠলেন, ‘সৌদি থেকে পাগল হয়ে আসছে যে?’ এরপর জানালেন, মনে হয় বাথরুমে গেছে। কিছুটা সময় অপেক্ষা করতেই বোরকায় ঢাকা হ্যাপি (ছদ্মনাম) ওয়ার্ডে ঢুকলেন, সঙ্গে বোন।
কাছে যেতেই শোনা গেল, বিড়বিড় করে কথা বলছেন হ্যাপি। তবে বাংলায় নয়, আরবিতে। ‘তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না বাংলায় বলো’,বোনের এ কথা শুনলেন ঠিকই কিন্তু তাতে ভাষার কোনও পরিবর্তন হলো না। একনাগাড়ে তিনি আরবিতেই কথা বলে যাচ্ছেন।
বোন ছন্দা (ছদ্মনাম) জানালেন, এভাবেই কথা বলতে থাকে হ্যাপি সারাক্ষণ, কিছুই বুঝি না। আকারে ইঙ্গিতে কথা বলতে চাইলেও তাতে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই, আরবিতেই কথা বলে যায়। বোনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে শঙ্কিত ছন্দা।
হ্যাপির অবস্থা নিয়ে শঙ্কিত মা জোবেদা বেগমও। স্বামী মারা যাবার পর চার মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে সংগ্রামী জীবন তার। নারায়ণগঞ্জে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। ২৬ বছরের হ্যাপির বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পর মায়ের সংসারে সচ্ছলতা আনতে সৌদি যায়। মাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘যদি কিছু তোমাদের জন্য করতে পারি।’ ‘কিন্তু সেই মেয়েকে নিয়ে আমি হাসপাতালে পড়ে আছি, মেয়েটা কবে সুস্থ হবে কিছুই জানি না’, বলেন জোবেদা বেগম।
হ্যাপি কবে সৌদি আরব গেল, কীভাবে ফেরত এলো জানতে চাইলে জোবেদা বেগম বলেন, ‘বছর খানেক একবার হ্যাপি সৌদি যায়। সেখানে ১৪ মাস থাকলেও প্রথম ১০ মাস ঠিকমতো বেতন পাঠাতো, ফোনে কথা বলতো। কিন্তু তারপর থেকেই সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সে সময়ে এমন কোনও দিন নেই যে হ্যাপিকে পাঠানো ট্রাভেল এজেন্সিতে যাইনি। তাদের কাছে কত মিনতি করেছি- মেয়েটার একটা সংবাদের জন্য, কিন্তু তারা কিছুই বলতে পারেনি। কত কানছি মেয়ের লাইগ্যা, চার মাস পর আমার মেয়ে পাগলের মতো হইয়া বাংলাদেশে আসে। তারপর তাকে নিয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালেও গেছি, তারা ভর্তি রাখে নাই কিন্তু দিনের পর দিন ওষুধ খেতে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, তারপর সুস্থ হবার পর আবার সেই জেদ- সৌদি যাবে, কারণ-সংসারের অসচ্ছলতা। সংসারের অভাব-অনটন মেয়েটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। আমাদের সবার নিষেধ অমান্য করে মেয়েটা গেল, ফিরে এলো আবার সেই অবস্থা নিয়ে। এখন হাসপাতালে ভর্তি, জানি না কবে সুস্থ হবে, কবে বাড়ি যাবো মেয়েটাকে নিয়ে।’
একই অবস্থা সাতক্ষীরার ছয় বছরের ছেলের মা শারমীন আর ফরিদপুরের তাজমিনের। অভাবের সংসারে কিছুটা সচ্ছলতার আশায় সৌদি যান তারা। পেছনে পরে থাকে বাবা-মা আর সন্তান। কিন্তু ভাগ্য ফেরাতে সৌদি গেলেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তার সৌদি থেকে ফেরত এসেছেন, শূন্য হাতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে, তাদেরও ঠাঁই হয়েছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে।
গত কয়েকমাস ধরেই সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত নারীরা দেশে ফিরছেন। এর মধ্যে গত মে মাসে ২৬০ জন, জুন মাসে ৮৮০ জন এবং গতকাল ১০ জুলাই পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন ৬০ জন। এদের মধ্যে অনন্ত সাতজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরেছেন বলে জানিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম। চিকিৎসা নিয়েছেন মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে, কাউকে কাউকে ভর্তি হয়েও চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ‘‘এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে ভাষাগত এবং কালচারাল সীমাবদ্ধতা, শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের ফলে এসব নারীরা সৌদি আরব গিয়ে ফেরত আসছে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে। আর কোনও কারণ নেই। শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার যারা হয়েছেন তাদের অনেকেই ‘ভালনারেবল’। এদের মানসিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা সবারই বেশি। এরা সবাই আমাদের কাছে আসছে না, বড় সমস্যা হলেই কেবল আসছে। যারা আসে নাই, তাদের অভিভাবকদের সচেতন হওয়া উচিত, যদি সে রকম কিছু হয় তাহলে অতিদ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।’’
প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ নারী বিদেশে গিয়েছেন, যার মধ্যে দুই লাখ গিয়েছেন সৌদি আরবে। এক লাখ ২৯ হাজার জর্ডানে, এক লাখ ২৬ হাজার আরব আমিরাতে, ওমানে ৬৪ হাজার, কাতারে ২৫ হাজার, লেবাননে এক লাখ চার হাজার এবং মরিশাসে গিয়েছেন ১৬ হাজার নারী। তবে এর মধ্যে সৌদি আরব যাওয়া নারীদের অবস্থাই বেশি খারাপ এবং সেখান থেকে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসার সংখ্যাই বেশি।
সৌদি গিয়ে কেন নারীরা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফিরছেন জানতে চাইলে মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রথম কারণ হচ্ছে, অপরিচিত পরিবেশ, ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, কালচারাল সীমাবদ্ধতা-তাদের মনের ওপর চাপ ফেলে। উপরন্তু তাদের ওপর যখন মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন হয় (এমনকি তাদের ওপর যৌন নির্যাতনও হয়) এই বিষয়গুলো তাদের ওপর তীব্র মানসিক চাপ (একিউট স্ট্রেস) তৈরি করে।’
‘এই তীব্র মানসিক চাপ যখন দীর্ঘায়িত হয় তখন তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা, সাইকোসিসসহ অন্যান্য বিষয়গুলো যখন পেয়ে বসে তখন তারা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে (পিটিএসডি) আক্রান্ত হন’, বলেন এই চিকিৎসক।
অনেকের সঙ্গেই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে কিন্তু মানসিক রোগী হলেন চারজন, এমন কেন ঘটে জানতে চাইলে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ঝড়ে তো সব গাছ পরে না। তেমনি কারও কারও ঘাত সহনশীলতা বেশি, কেউ আবার সহনশীলতার মধ্যে দিয়ে যায় কেউবার আবার একটু দুর্বল মানসিকতার। তাদের ওপর নির্যাতন হলে এটা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।’
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘যে সমস্ত নির্যাতনের নমুনা আমরা সৌদি নারীদের থেকে শুনছি বা দেখছি সেসব খুব ভয়াবহ। এসব শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের কারণেই সৌদি ফেরত নারী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, আর কোনও কারণ নেই তাদের।’
অপরদিকে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফারুক আলম বলেন, ‘‘দেশে থাকার সময়ে হ্যাপি মানসিক রোগী ছিল না। আর এখন এলোমেলো কথা, রাগ বেশি, ভাঙচুর, পরিবারের লোকদের মারধর করাসহ নানা ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি থাকা হ্যাপির মধ্যে। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘বাই পোলার মুড ডিজঅর্ডার’ বলা হয়।” ওষুধসহ কাউন্সেলিং, সাইকো এডুকেশন দেওয়া হচ্ছে হ্যাপিকে। ভবিষ্যতে তাকে কাউন্সিলের আওতায় রাখা হবে বলেও জানান তিনি।
সুস্থ হবে কিন্তু সেটি বারবার হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে জানিয়ে ডা. ফারুক আলম বলেন, ‘এর আগে আরও দুইজন সৌদি ফেরত নারী এই হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। সৌদি আরব যাওয়ার পর শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনসহ নানা কারণে এসব নারী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন’, বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সারাবাংলা