কলকাতায় নিপাহ আক্রান্ত বাংলাদেশি ছাত্র
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কলকাতায় অধ্যয়নরত এক বাংলাদেশি ছাত্র নিপাহ ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য কেরলে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণে আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে রাজ্যটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৬। কলকাতাতেও কেরলের এক জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে কয়েকদিন আগে। মনে করা হচ্ছে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
কেরলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কেকে শৈলজা জানিয়েছেন, কোজিকোডে নতুন করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাসিন নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এক আইনজীবীর। তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে সরকার। আগামী ৫ জুন পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে স্কুল-কলেজ। এই রোগের সংক্রমণে ভর্তি বা যাদের মধ্যে এই ভাইরাস লক্ষণ দেখা গেছে, তাদের আলাদা করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
নিপাহ ভাইরাস আতঙ্কে এবার নতুন ব্যবস্থা নিল দক্ষিণ-পূর্ব রেল। দূরপাল্লার ট্রেনগুলিতে বন্ধ করা হল ফল বিক্রি। প্রিমিয়াম ট্রেনগুলিতেও খাবারের সঙ্গে আপাতত ফল দেওয়া বন্ধ করা হলো।
শুধু কেরলেই নয়, নিপাহ ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। রাজ্যের বাজারে লিচু, কালোজাম বিক্রি প্রায় বন্ধ। কলকাতার বেলেঘাটা আইডি হালপাতালে বাড়ছে নিপা সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা। পূর্ব মেদিনীপুরের ঘাটালের বাসিন্দা উত্তম ভৌমিক। বছর ছত্রিশের উত্তম মঙ্গলবারই কেরল থেকে ফিরেছিলেন। তারপর ধূম জ্বর। রক্তে প্লেটলেটের সংখ্যা কমেছে। ঝুঁকি না নিয়ে বুধবারই বেলেঘাটা আইডিতে ভর্তি করা হয় উত্তমকে। নিপা সন্দেহে আইসোলেশন ওয়ার্ডেই রাখা হয়েছে তাকে।
এদিকে কলকাতায় কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশুনার জন্য এসেছেন বাংলাদেশের ফুয়াদ বিন জাফর। বুধবার সকালে তাকেও বেলেঘাটা আইডিতে ভর্তি করা হয়েছে। ফুয়াদের শরীরেও নিপাহ সংক্রমণের উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
জ্বর-গা হাতপা ব্যথা নিয়ে আলিপুরের কম্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সেনাজওয়ান শিনুপ্রসাদ। বাড়ি কেরলের। ফোর্ট উইলিয়ামে কর্মরত ছিলেন। একমাসের ছুটিতে কেরলে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। ১৩ মে কলকাতায় ফিরে কাজে যোগ দেনশিনুপ্রসাদ। ২০ তারিখ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সেনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৫ মে মৃত্যু হয় শিনুর। মৃত্যুর পর দেহের ফ্লুইড পাঠানো হয়েছে পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভায়রোলজিতে।
নিপাহ ভাইরাস কী?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী নিপাহ বা নিভ প্রধানত বাদুর জাতীয় প্রাণীর থেকেই ছড়ায়। নিপাহ অপেক্ষাকৃত নতুন ভাইরাস যা অতি সহজেই বাদুর জাতীয় তৃণভোজী প্রাণীর থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। শুধুমাত্র বাদুর নয়, শুকরের বর্জ্য থেকেও ছড়ায় এ ভাইরাস।
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার নিপাতে প্রথম এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়। সেখানে বাড়ির পোষ্য কুকুর, বেড়াল, ঘোড়া, ছাগলের দেহে এই ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ওই অঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতেই শুকর প্রতিপালন হয়। গবেষণার পর দেখা যায়, ওই শুকরদের থেকেই নিপাহর প্রভাব ছড়িয়েছে পোষ্যদের দেহে। এরপর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
২০০৪ সালে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশেও ৩৩ জনের মৃত্যু হয়। যদিও এরপর বাংলাদেশে এই ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি।
আরও : জোড়া ব্রেনের রাবেয়া-রোকেয়া: দ্বিতীয় অপারেশনে ৩০-৫০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি লাগবে
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিপার প্রভাবে ৪৭৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৫২ জনের।
যেভাবে ছড়ায়
নিপাহ ভাইরাস বাদুড় থেকে পশুপাখি ও মানুষের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। আক্রান্ত রোগীর কফ ও থুথু থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে ছড়িয়ে পড়ে রোগটি। এই ভাইরাস মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ শক্তিকে একেবারেই শেষ করে দেয়।
সংক্রমণের লক্ষণ
নিপাহ ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ৩–১৪ দিনের মধ্যে উপসর্গ শুরু হয়৷ প্রথমে জ্বর মাথাব্যথার মতো সাধারণ কষ্ট থাকে। আস্তে আস্তে রোগী আচ্ছন্ন হয়ে যায়, ভুল বকা শুরু হয়, কাউকে চিনতে পারেন না। এমনটি হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। নাহলে এর ২৪–৪৮ ঘণ্ঢার মধ্যে রোগী কোমা স্টেজে চলে যেতে পারে৷ ব্রেনে প্রদাহ (এনসেফেলাইটিস) হলে অবস্থা গুরুতর হয়ে ওঠে৷ রোগের প্রথম দিকে অনেকের শ্বাসকষ্ট হয়৷ শ্বাসকষ্টের মাধ্যমেই রোগ ছড়ায় বেশি৷ তবে রোগীকে আলাদা করে রাখলে এবং সতর্ক থাকলে সংক্রমণের মাত্রা কম থাকে।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
সাধারণ পরীক্ষায় এ রোগ ধরা পড়ে না৷ থ্রোট সোয়াব অর্থাৎ গলা থেকে তরল নিয়ে রিয়েল টাইম পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন নামের পরীক্ষা করা হয়৷ শিরদাঁড়ার তরল, ইউরিন ও রক্ত পরীক্ষাও করতে হয়৷ সেরে ওঠার পর রোগটা নিপাহ ভাইরাস থেকেই হয়েছিল কিনা জানতে আইজিজি ও আইজিএম অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে দেখা হয়৷
চিকিৎসা বলতে মূলত সাপোর্টিভ কেয়ার অর্থাৎ রোগীর কষ্টের উপশম করার চেষ্টা করা হয়৷ জটিল অবস্থায় ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিটে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হয়৷ কারণ নিপাহ ভাইরাসের এখন পর্যন্ত কার্যকরী প্রতিষেধক তৈরি করতে পারেনি বিজ্ঞানীরা।
নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়
খেজুরের কাচা রস পান করা উচিত নয়। এছাড়া গাছ থেকে যে-কোন ধরনের আংশিক ফল ভক্ষণ করা ঠিক না। ফলমূল খাওয়ার আগে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসলে সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধৌত করা উচিত।