এত অভিযোগ থাকা সত্বেও পার পেয়ে যাচ্ছে বদি ও পুলিশ!
সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে সারাদেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে এই অভিযান। বিশেষ করে মাদক গডফাদারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়া, পুলিশ পাহারায় মাদকের হাট, টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যা। এই বিষয়গুলো এখন সারাদেশের সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথমেই আলোচনায় অাসে কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া আসনের ইয়ারা সম্রাট এমপি আবদুর রহমান বদি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকা সত্বেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যানা গেছে- এখন সৌদি আরবে রয়েছেন বদি। ওমরা হজ পালনের উদ্দেশে সৌদি আরব গেলেও একটি সূত্র বলছে, মাদকবিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করে বহুল আলোচিত এই এমপি দেশ ত্যাগ করেছেন। শেষ পর্যন্ত এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাহিরেই রয়েছেন এই মাদক সম্রাট।
এছাড়াও দেশের অধিকাংশ বড় বড় গডফাদাররা পুলিশের সহায়তায় আড়াল হয়ে গেছেন।
অন্যদিকে মাদক ব্যবসায়ীদের শেলটার ও টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার তথ্য মতে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ পাহারায় চলছে মাদক ব্যবসা।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের এক শ্রেণির কর্মকর্তা মাদক নির্মূল অভিযানে যাওয়ার আগে সোর্সের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে এ তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে। এ কারণে অধিকাংশ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী গা-ঢাকা দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে তারা ধরাছোয়ার বাইরেই থাকছেন। আর যারা ধরা পড়ছে তাদের বেশিরভাগ সেবনকারী ও খুচরা বিক্রেতা।
খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে পুলিশের এক শ্রেণির কর্মকর্তার কাছে তারা পৌঁছে দেয়। এসব মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঘুষের টাকা পেয়ে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বড়লোক হয়েছেন, তারা এখন অভিযানের আগাম তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছেন।
তবে বড় মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। নিয়মিত তারা বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকেন। যাই হোক মাদকের গডফাদাররা গ্রেফতার না হওয়ার মূলে রয়েছে অভিযানের আগাম তথ্য ফাঁস হওয়া।
এদিকে পুলিশের বিরুদ্ধে ভয়ানক অভিযোগ উঠেছে কক্সবাজারের টেকনাফেের কাউন্সিলর একরামুল হক নিহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মাদক বিরোধী এই অভিযানে গত ২৬শে মে একরামুল নিহত হন। তার পরিবার অভিযোগ, একরামুলকে বাসা থেকে র্যাব এবং ডিজিএফআই এর স্থানীয় দু’জন কর্মকর্তা ডেকে নেওয়ার পর হত্যা করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, একরামুল হকের বিরুদ্ধে যথাযথ অভিযোগ আছে। সে মাদকের সাথে জড়িত ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, অপরাধী যেই হক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ সবের মধ্যে গতকাল ডেইলি স্টার পত্রিকার অনলাইনে একরামের হত্যার একটি অডিও প্রকাশ করা হয়। ১৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের এই অডিও ক্লিপে শোনা গিয়েছিল- “হ্যালো! আমি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি।… আমি উনার মিসেস বলতেছি… হ্যালো! হ্যালো!…”- উৎকণ্ঠায় উচ্চস্বরে এমনিভাবে কথা বলছেন মোবাইল ফোনের একপ্রান্ত থেকে। অপর প্রান্তের কথার স্বর অনুচ্চ। এর খানিক পর গুলির শব্দ… উহ্… গোঙানি… । এরপর আরেকটি গুলির শব্দ। এপাশে চিৎকার- “ও আল্লা…!”
আরও : জোড়া ব্রেনের রাবেয়া-রোকেয়া: দ্বিতীয় অপারেশনে ৩০-৫০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি লাগবে
এমনি কিছু রক্ত ঠান্ডা করা কথোপকথনের পৃথক চারটি ক্লিপ মিলিয়ে প্রকাশ করেছে দ্য ডেইলি স্টার। অডিও ক্লিপটি সরবরাহ করেছেন নিহত পৌর কমিশনার একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম।
এনিয়ে তোলপাড় সারাদেশে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল বলেছেন, অডিও তিনি শোনেননি। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর গুলিবর্ষণের অন্যান্য ঘটনা যেভাবে তদন্ত হয়, এটিও সেভাবে তদন্ত হবে।
“দেখুন ঐ অডিও আমি শুনিনি।আমি না দেখেতো বলতে পারবনা যে, কি অডিও বের হয়েছে। এটা আমরা সবসময় বলছি, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অন্যায়ভাবে কিছু করে থাকে, তারতো একটা ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল এনকোয়ারি হচ্ছে এবং হবে। সেখানে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তারও বিচার হবে। সেটা আমরা সবসময় বলে আসছি। কিন্তু এটা অডিও না দেখে আমি বলতে পারবোনা।”
র্যাব বলেছে, প্রকাশ হওয়া অডিও খতিয়ে দেখছে বাহিনীটির সদর দপ্তর।
এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশিষ্ট জনরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে হত্যা করা হয়েছে দু-সন্তানের পিতা একরামুলকে। অডিও টেপ পাওয়া গেছে বলে আমরা জেনেছি এই পাশবিক খুনের বিবরণ। বন্ধুকযুদ্ধের নামে সবার অলক্ষ্যে না জানি এমন কত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে নিরীহ নিরপরাধ মানুষ!
এসব জঘন্যতম অপরাধের বিচার হয় না এদেশে। হবেও না হয়ত কখনো। অসহায়ের মতো আমিও আজকাল ভাবি, আল্লাহর গজব পড়ে না কেন এসব খুনীর উপর!
জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও নাট্যনির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লিখেছেন, এইরকম আরো কতো আকুতি রেকর্ডিং মেশিনের বাইরে থেকে গেছে, ভাবেন। ভাবেন স্বাধীনতার পর থেকে এইরকম কতো বিচার বহির্ভুত হত্যা হইছে। ভাবেন, রাষ্ট্ররে যে নাগরিক তার হেফাজতের দায়িত্ব দিছে, তার জানই কেমনে কবজ করে বসলো রাষ্ট্র। ভাবেন, কবে কোথায় কোন ভুলে লখিন্দররে দংশাইলো সুতানলী সাপে?
একটা খারাপ লোককেও নির্মূল করার জন্য যখন আপনি বিচার বহির্ভুত হত্যা সমর্থন করেন, তখনই আপনি নিজের অজান্তেই একজন ভালো লোককে হত্যার লাইসেন্সও তুলে দেন। আপনিই এই রাষ্ট্র বানিয়েছেন। আপনাকে ধন্যবাদ।
লেখক ও ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্য বলেছেন, গুলিবিদ্ধ মানুষের অন্তিম আর্তনাদ কেমন হয় জানা ছিল না। একরামের অন্তিম আর্তনাদ তো আমাকে ঘুমাতে দেবেনা।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উর্দি পরা খুনেরা ঘুমায় কীভাবে? এরা হাজার হাজার মানুষকে এভাবেই পয়েন্ট ব্লাংকে খুন করে। তারপরে বন্দুকযুদ্ধের গল্প সাজায়।
সব ক্রস ফায়ারের পিছনেই এমন একটা অডিও ক্লিপ আছে। যা কোনদিন সামনে আসেনা। এই জল্লাদদের দিয়ে আমরা দেশে শান্তি আনবো?