পরমাণু চুক্তি বাতিল করে পার পাবেন ট্রাম্প?
ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি রাখা না-রাখা নিয়ে ১২ মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফয়সালা দেবেন। ১২ মে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসবেন বলে হুমকি দিয়েছেন তিনি। সে অনুযায়ী সত্যিই যদি তিনি তা করেন, তাহলে আমাদের আরও একটি বিপর্যয়ের দিকে যেতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে বিচার-বিবেচনাবিবর্জিত আরও একটি যুদ্ধের সূচনা হবে।
৬০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র বোকার মতো যে ভুলটি করেছিল, তার খেসারত আজও তাকে দিতে হচ্ছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি বক্তৃতায় সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ১৯৫৩ সালে ইরানে সিআইএর ঘটানো একটি অভ্যুত্থানের কথা তোলেন। ওই অভ্যুত্থানে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেঘকে উৎখাত করা হয়। পশ্চিমাদের তেলের স্বার্থ বিবেচনায় রেখে নিষ্ঠুর, দুর্নীতিবাজ ও চরম অজনপ্রিয় শাহকে ক্ষমতায় বসানো হয়। স্যান্ডার্স ব্যাখ্যা করছিলেন, ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বিপ্লবীরা শাহকে উৎখাত করে ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। স্যান্ডার্স প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘ওই সময় গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত না করলে আজ ইরানের চেহারা কেমন হতো? আমেরিকান মদদপুষ্ট অভ্যুত্থানের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কতটা ছিল? এর ধারাবাহিকতায় আমাদের কি খেসারত দিয়ে যেতে হচ্ছে?’
স্যান্ডার্সের এসব প্রশ্নের জবাব হলো, যুক্তরাষ্ট্র তখন ইরানের গণতান্ত্রিক সরকারের পতন না ঘটালে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবও হতো না এবং দশকের পর দশক ধরে ইরানের নেতাদের সঙ্গে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বও চলত না। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় ওই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ইরানের নতুন বিপ্লবী সরকারের নেতারা মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের সুন্নি নেতাদের সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। সেই দ্বন্দ্ব আজও চলছে। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানিরা ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ পাপেট ভাবতে শুরু করে এবং ফিলিস্তিনিদের নিগ্রহ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়। সৌদি আরব ও ইসরায়েল উভয়েই ইরানের সঙ্গে তাদের কয়েক দশক ধরে চলা বৈরিতার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করে আসছে। সৌদি আরব ও ইসরায়েল উভয়েই ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করেছিল।
ইরানের হাতে একটিও পরমাণু অস্ত্র নেই এবং ইসরায়েলের কাছে কয়েক শ পরমাণু অস্ত্রের মজুত আছে। তারপরও ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর ওপর বোমা ফেলার জন্য ইসরায়েল মার্কিন সামরিক বাহিনীর কাছে গিয়ে তদবির করেছিল। অন্যদিকে কোটি কোটি ডলার খরচ করে সারা দুনিয়ায় অসহিষ্ণু ওহাবি মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া সৌদি আরব বলছে, ইরান নাকি বিশ্বে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে।
সৌদি আরবের কট্টর সুন্নি মতাদর্শকেই আল-কায়েদা থেকে আইএসের মতো সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর আদর্শিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ধরা হয়। অবশ্য ইরানের সরকারব্যবস্থা সৌদি রাজতন্ত্রের মতো অতটা দমনমূলক না হলেও সেখানে গণতন্ত্র নেই। ইরানে ব্যক্তিস্বাধীনতায় নিষেধাজ্ঞা আছে। সরকারের প্রায় সব শাখাতেই নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। কিন্তু চুক্তি থেকে সরে এলে তারা বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পাবে এবং রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতারা মাত্রাতিরিক্ত সাহসী হয়ে উঠবেন। যে রক্ষণশীল নেতারা পশ্চিমাদের সঙ্গে আপসের ঘোর বিরোধী, তাঁদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি সরে দাঁড়াতে বাধ্য হবেন। রক্ষণশীলদের প্রাধান্য ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থী সাধারণ মানুষের ওপর আরও বেশি নিগ্রহ বয়ে আনবে।
কট্টরপন্থীদের শক্তিশালী করে দিলে ওই অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। ইসলামি বিপ্লবী সেনাবাহিনী (আইআরজিসি) নামক ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামরিক বাহিনী দেশটির ইসলামি সরকারকে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের যেকোনো হুমকি থেকে মুক্ত রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত। হিজবুল্লাহর মতো মিত্রদের সঙ্গে এক হয়ে আইআরজিসি ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সৌদি আরবের সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ট্রাম্পের প্রধান উদ্বেগ তিনটি ‘এইচ’ নিয়ে। সেগুলো হলো হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুতি। কিন্তু তিনি যদি চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান, তাহলে এই তিন ‘এইচ’ তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারে। চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে আইআরজিসি প্রকাশ্যে তাদের মদদ দেওয়ার নৈতিক ন্যায্যতা পাবে। ইরাক, আফগানিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্য যেসব ঘাঁটিতে মার্কিন ও ইসরায়েলি বাহিনীর উপস্থিতি আছে, সেখানে আইআরজিসি হামলা চালানোর সাহস দেখাবে।
চুক্তিটি ভেঙে গেলে ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার স্বাধীনতা পাবে এবং অস্ত্র বানানোর লক্ষ্যে তারা দ্রুত কাজ শুরু করে দেবে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য দেশ ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, রাশিয়া ও চীনও চায় চুক্তিটি অটুট থাকুক। চুক্তি থেকে বের হলে তারাও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অসন্তুষ্ট হবে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সদ্যই ওয়াশিংটন সফর করলেন। সফরের সময় তিনি ট্রাম্পকে চুক্তি থেকে বের না হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। গত শুক্রবার জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলও ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁকে একই বার্তা দিয়েছেন।
এই পরমাণু চুক্তিটি শুধু যে ছয় জাতির মধ্যে হয়েছে, তা নয়। এর সঙ্গে পুরো জাতিসংঘ ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট। নিরাপত্তা পরিষদ এই চুক্তিটি ১৫-০ ভোটে পাস করেছে। চুক্তিটি ভেঙে দিলে আন্তর্জাতিক কাঠামোর মধ্যস্থতার ওপর আস্থা নড়বড়ে হয়ে যাবে। এতে মার্কিন নেতৃত্বের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের শ্রদ্ধার জায়গাটাও অনেক নিচে নেমে যাবে।
আর এখন, বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার কথা চলছে। ইরানের সঙ্গে চুক্তি ভেস্তে গেলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক মহলের অনুমোদিত ইরানের চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলে একই ধরনের চুক্তি উত্তর কোরিয়া করতে যাবে কোন ভরসায়?
এ কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের শুধু ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা নয়, বরং তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে আঞ্চলিক শান্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এই নীতির ঠিক বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। এখন তাঁদের থামাতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। গত দশকে বৈশ্বিক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বিশ্ব যতটুকু অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা যদি ট্রাম্প ভেঙে দিতে উদ্যত হন, তাহলে জাতিসংঘ, মার্কিন কংগ্রেস ও মার্কিন জনগণকেই ট্রাম্পকে বাধা দিতে হবে। অন্যথায় সামনে ঘোর বিপদ।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মেদেয়া বেনইয়ামিন শান্তিবাদী গ্রুপ কোডপিংকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও লেখক