কবি মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্’র পৈতৃকভিটা নাওঘাট ডিপুটি বাড়ি
তারিকুল ইসলাম সেলিম : কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও মানুষের শ্রদ্ধা সম্মান ও ভালবাসায় স্ব-গৌরবেই আছে কবি মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্’র পৈতৃকভিটা নাওঘাট ডিপুটি বাড়ি। এলাকাবাসীর অহংকার ও গর্বের জায়গাটি প্রাচীনকালে মান-মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান ছিল পর্বতসম। সম্মান প্রদর্শন ও নিজেদের আদব রক্ষায় হাতে ঘড়ি পড়ে কেউই ডিপুটি বাড়ির সামনে দিয়ে যেত না।
আজ বাড়িটি জনমানব শূন্যেতা নিঃশব্দ নিরবতায় কেবল নেই তাঁর যৌবনের জৌলুস । যে কারণে নতুন প্রজন্মও ভুলতে বসেছে কবি মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ স্মৃতি বিজড়িত পৈতৃক বাড়িটির কথা। বর্তমানে এই পরিবারের কেউ গ্রামে বসবাস করে না। যে কারণে বাড়িটি অযত্নে অবহেলায় নিশ্চিহ্নের পথে। কয়েক বছর আগেও চার ভিটে বিশাল বড় চারটি ঘর ছিল। ঘরগুলো আজকাল চোখে পরবে না। একটি মাত্র পাকা গেইট ছিল। যাতে লেখা ছিল “নাওঘাট ডিপুটি বাড়ি”। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে স্ব-সম্মানের সাথে দাঁডিয়ে থেকে ডিপুটি সাহেবের নামে প্রক্সি দিয়েছে। সেই গেইটটি বহুদিন নিঃসঙ্গতার যন্ত্রনায় সময়ের সাথে অভিমান করে বিলুপ্তি হয়ে গেছে। এখন পুরো বাড়িটিই বহু প্রজাতিক কাঠ গাছের বাগানে রূপান্তরিত হয়েছে। ইতিহাসের নিরব স্বাক্ষী এই বাড়িতে লেখক-সাংবাদিক অনেকেই ঘুরতে এসে নিরবে ফিরে যান। যাঁদের পদচারণায় বাড়িটি দিন রাত বর্ণিল সাজে সেজে থেকেছে ।
তাঁরাও হারিয়ে গেছে কাল-অতীতে। ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রথম ডিপুটি ম্যাজিস্টেট আব্দুর রহিম গ্রামে আসলে উপস্থিত থাকতেন ব্রিটিশ-ভারত সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক-সহ নানা শ্রেণীর মানুষ আসতেন। কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-লেখকরাও নিয়মিত আসতেন। এ বাড়িতে তাদের অনেকেরই সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি হয়েছে। তাদের আসা-যাওয়ার মধ্যেই বাড়িটি সময় প্রাণবন্তর থেকেছে। ডিপুটি ম্যাজিস্টেট আব্দুর রহিমের অনুপস্থিততে ছোট ভাই আব্দুল আওয়াল সামাজিক বিষয়াদি দেখভাল করতেন। গুণীজনদের আপায়নে বাড়ির সামনে প্রধান গেইটের প্রবেশ দ্বারে বাংলোতে বৈকালিক চা চক্রের আড্ডায় বাজতো গ্রামোফোনে গান। দিন যৌবনার নিভো-নিভে আলো মিশে যাওয়ার সন্ধ্যার পর থেকে মাঝ রাতে পর্যন্ত মাঝে মধ্যে বসেতো বাউল গানের আসর। পুরো নাওঘাট গ্রামজুড়ে ডিপুটি ( এলাকাবাসী ডিপুটি সাহেবের সম্মানার্থে “সাব বাড়ি” নামে সম্বোধন করে ) বাড়িকে কেন্দ্র গ্রামবাসির আনা-গোনা সব সময় যেন উৎসব আমেজের ঢেউ থাকত । মোঃ সফর উদ্দিন ১৮৯০ সালে এ বাড়ির গোড়াপত্তন করেছিলেন ।
তিনি একালে আধুনিক বন্দর আশুগঞ্জ বাজারে ব্রিটিশ সওদাগরদের সাথে পাটের ব্যবসা করতেন । তখনকার সময়ে ব্রিটিশ ভারতের ঐতিহ্যের ধারায় অর্ত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিরা পাটের ব্যবসা করতেন । এ সুবাদে তাঁর ব্যবসা বিত্ত, ধনদৌলত সবই ছিল। মোঃ সফর উদ্দিন পাশের বাড়ির বাসিন্দা প্রতিপত্তিশীল নূর বক্স মুনসির কন্যা ফুলবুন্নেছার সাথে বিয়ে হয়। তাঁদের সংসারে ১৮৯৬ সালে আব্দুল রহিম ও ১৮৯৯ সালে আব্দুল আওয়াল নামে দুই পুত্রসন্তান ও সাত কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহন করেন। আব্দুর রহিম ১৯২৪ সালে বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষা উর্ত্তীন্ন হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুহকুমা থেকে ব্রিটিশ সরকারের ডিপুটি ম্যাজিস্টেট হন। তিনি যখন ডিপুটি ম্যাজিস্টেট হন তখন পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুহকুমা জুড়েই আনন্দের জোয়ার। গৌরবময় কৃতিত্বে ততকালে সরকারি বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান সংবর্ধনা দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম উজ্জ্বল করার জন্য তাকে অনাড়ম্বর সংবর্ধনা প্রদান করেন। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতে কুমিল্লা সোয়াগাজীর জমিদার হাতির উপর চড়ে নাওঘাট ডিপুটি বাড়িতে এসে ছিলেন। এরপর থেকেই ত্রিপুরা (তদানিন্তন) জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুহকুমাজুড়ে ডিপুটি বাড়ি নামে মার্যাদাপূর্ণ গৌরবের সাথে পরিচিতি ও সু-খ্যাতির পান। আব্দুর রহিম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা আলো প্রজ্জ্বলন করেন। তারপর এই ঘরে একের পর এক নক্ষত্রের জন্ম। ১৯৩৬ সালে এই বাড়িতেই দাদা-দাদির ভরা সংসারে আব্দুল আওয়াল ও লুসিয়া খাতুনের ঘরে আলো ছড়িয়ে জন্ম গ্রহন করে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, নজরুল যুগে প্রতিভাধর, শক্তিমান, স্বতন্ত্র ও রোমান্টিক কবি-সাহিত্যিক, প্রবান্ধানিক, নজরুল গবেষক, সাহিত্য আলোচক, সমালোচক, গীতিকবি, প্রবীণ সাংবাদিক ও ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ । সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য সরকার রাষ্ট্রীয় একুশে পদক-০৭ প্রদান করেন। দ্বিতীয় ছেলে মোহাম্মদ হাবিবুলউল্লাহ ছিলেন একজন সৎ উর্ধ্বতন অডিট কর্মকর্তা।
তৃতীয় ছেলে মোহাম্মদ নাসিরউল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশ সোনালী, জনতা ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)-এর সাবেক মহাব্যবস্থাপক। খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ন ও অর্থনীতি সমৃদ্ধির দেশ গড়তে মৎস্য ও পোল্ট্রি শিল্পের প্রবর্তন করেন। মহাব্যবস্থাপক থাকাকালে তিনিই এদেশে কৃষকদের সর্বপ্রথম কৃষিঋণ ব্যবস্থা করে দেন। চতুর্থ ছেলে সমাজ বিজ্ঞানী ড. প্রফেসর মোহাম্মদ মাহবুবউল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, চট্রগ্রাম আর্ন্তজাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে দুই বারের নির্বাচিত ডীন। পঞ্চম ছেলে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ ফরিদ রূপালী ইনসিউরেন্সের ব্যাবস্থাপক।
ডিপুটি সাহেবের বড় ছেলে মোহাম্মদ ওবায়েদ উল্লাহ ছিলেন কুমিল্লা বার্ডের পরিচালক ডিপুটি সাহেব-এর ভাগিনা ও বড় মেয়ের জামাই একেএম কাজী ইব্রাহিম (সিএসপি, ইপিসিএস)। কৈশোরে বাবা মারা যাওয়ার পর নানা বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করেন। তিনি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারে যুগ্ন-সচিব পদে থাকাবস্থায় চাকুরীকালেই আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। নাওঘাট ডিপুটি বাড়িতে থাকলেই উচ্চ শিক্ষা নেওয়া যায়। বহুল প্রচালিত কথাটি এক সময় লোকমূখে শুনা যেত। একেএম কাজী ইব্রাহিম-সহ চাচাতো-মামাতো-ফুফাতো -খালাতো ভাই বোন সহ ১২-১৪ জন ছেলে-মেয়ে একসাথে স্কুল কলেজে পড়ালেখা করতেন। তাঁরা সবাই উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে দেশের-বিদেশে
উচ্চুপদস্থ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ’র বড় ছেলে এ বাড়ির গৌরবের উত্তরাধিকারী প্রখ্যাত সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও গীতিকবি মুকসুদ জামিল মিন্টু-সহ সে তালিকা বেশদীর্ঘ। এ তালিকায় অভিষেক হয়েছে সদ্যপ্রকাশিত ৩৬ তম বিসিএস পরীক্ষায় তথ্য ক্যাডারে পঞ্চম স্থান অধিকারী মোহাম্মদ সাফিউল্লাহ আদনান।
এছাড়াও প্রায় দেড়-দুই ডজন ছেলে-মেয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের কৃতিত্বের ধারা অব্যাহত রেখে ডিপুটি বাড়ির সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছে। আবহমান কাল থেকেই শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাদপীঠ ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যেকে সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অজরপাড়া গ্রামে এই বাড়িটি ভূমিকা অর্ত্যান্ত গৌরবজ্জ্বল। আজকাল তাঁদের ডিপুটি বাড়ির আঙিনায় পদধূলীর চিহ্ন পড়ে না। কৃর্তিমান মানুষগুলো ধীরে ধীরে শিকড় থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে ।
কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এই মহান মানুষগুলোর স্মৃতিচিহ্নটুকু রক্ষা এখন সময়ের দাবি। ইদানিং পরিবারের দুই একজন চেষ্টা করছেন জনকল্যাণের জন্য তাদের পূর্বপুরুষ কবি মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্’র স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটিকে সংরক্ষণ করতে। উদ্দেশ্য এই মহান মানুষগুলো যেন যুগের পর যুগও বিস্মৃতির আঁড়ালে হারিয়ে না যায়।
লেখক: লোক-সাহিত্যনুরাগী ও সংগ্রহক