কাজির কাণ্ড!
নিউজ ডেস্ক : বাবা বিয়ে করেছেন ২০০১ সালে। তাঁর মেয়ের জন্মতারিখ ১৯৯৯ সাল!
গতকাল সোমবার গ্রীনরোড এলাকার কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ের কাগজপত্রে মেয়ের এই জন্মতারিখ দেখে বাবা ভিমরি খেলেন। ভুয়া জন্ম সনদে তাঁর ১০ বছরের মেয়েকে ১৯ বছর দেখিয়ে বিয়ে করেছে এলাকার এক কিশোর। তার নিজের বয়সও ১৮ বছরের কম। বন্ধুদের নিয়ে সে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা দেওয়া মেয়েটিকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে বলে মেয়েটির পরিবারের অভিযোগ।
মেয়ের বাবা বলেন, ১৩ ডিসেম্বর মেয়েটি তার চাচাতো বোন ও বান্ধবীকে নিয়ে কলাবাগান থেকে রাজাবাজার যায়। ফেরার পথে চার-পাঁচজন তাকে তুলে নিয়ে যায়। গ্রীনরোডের একটি কাজি অফিসে গিয়ে তাদের একজন মেয়েটিকে বিয়ে করে। বাকিরা সাক্ষী হয়। অভিযুক্ত ছেলেটি মাদকাসক্ত বলে মেয়ের পরিবার জানায়।
এই বিয়ে পড়িয়েছেন গ্রীনরোড এলাকার কাজি শফিকুল ইসলাম। মেয়ের নাম বলতেই তিনি বলেন, ‘গত ১৩ ডিসেম্বর বিয়ে হয়েছে। আমিই পড়িয়েছি। সব নিয়মকানুন মেনেই হয়েছে।’ বিয়ে পড়ানোর সময় কী কী নিয়ম মানতে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর-কনের সম্মতি, সাক্ষী ও জন্মসনদ—এই তিনটি জিনিস হলেই হয়।
বিয়ের কাগজপত্র দেখতে চাইলে কাজি প্রথমে বলেন, ‘যাঁর কাছে কাগজপত্র থাকে তিনি নেই।’ তিনি আসা পর্যন্ত এই প্রতিবেদক অপেক্ষা করবেন এমন কথায় তাঁর সঙ্গে থাকা বাকি লোকজন বলেন, নিবন্ধন খাতা যাঁর কাছে তিনি পরদিন আসবেন।
শেষ পর্যন্ত কাজি শফিকুল ইসলামকে বিয়ের কাগজপত্র বের করতে হলো। দেখা যায়, বিয়েতে মেয়েটির ভুয়া জন্মসনদ ব্যবহার করা হয়েছে। মেয়েটির আসল জন্ম নিবন্ধন সনদ অনুযায়ী তার জন্ম ১২ মে, ২০০৭। ওই সনদে নিয়ম অনুযায়ী নাম, সই ও সিল আছে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব (মো. শফিকুল ইসলাম) নিবন্ধক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (মো. হাফিজুর রহমান)। কিন্তু যে জন্ম নিবন্ধন সনদ কাজি শফিকুল ইসলাম বের করে দেখান, সেখানে জন্মতারিখ দেওয়া আছে ১২ মে ১৯৯৯। তাতে ইউনিয়ন পরিষদ সচিবের সই ও নামসহ সিল নেই। নিবন্ধকের সই ও নামসহ সিলের জায়গায় একটি সই আছে, তবে সিল বা নাম নেই।
আরও : বাংলাদেশের উপকূলে আসতে থাকা জ্বলন্ত জাহাজ আটকে দিলো ভারত
কাগজপত্র দেখে এই প্রতিবেদকের সামনেই মেয়ের বাবা হায় হায় করে ওঠেন; বলেন, ‘আমিই তো ১৯৯৯ সালে বিয়া করি নাই। আর এইটা আমার ছোট মেয়ে!’
কাজি শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি এক লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়েটা পড়িয়েছেন। তার বিনিময়ে ১ হাজার ২৫০ টাকা পেয়েছেন। তিনি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাজি। ১৯৯৬ সাল থেকে আট হাজারের বেশি বিয়ে পড়িয়েছেন। সেই বিয়েগুলোও কি এমন ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে পড়িয়েছেন—এমন প্রশ্নে তিনি চুপ করে থাকেন। কাজি দাবি করেন, মেয়েটিকে দেখে তিনি বুঝতে পারেননি যে সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ১০ বছরের শিশুকে তিনি ১৯ বছরের তরুণী মনে করলেন কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবেও চুপ করে থাকেন শফিকুল ইসলাম।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীর বাল্যবিবাহ নিয়ে কলাবাগানে তার এলাকায় এখন ব্যাপক আলোচনা। শিশুটি কী করে এই সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাবে, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন পরিবার-প্রতিবেশীরা।
স্থানীয় লোকজন জানান, যে ছেলেটি এ ঘটনা ঘটিয়েছে, সে মাদকসেবী। তার বাবা বেকার, মা ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে কোনো রকমে ভাতটুকু জোটান।
ছেলে-মেয়ে দুজনের বাসাও একই পাড়ায়। কাজির ওই কাণ্ডের পর মেয়েটি নিজের বাসায় চলে আসে। এখনো সে বাবার হেফাজতে আছে।
মেয়েটির বাবা বলেন, কোথায় গেলে ঘটনার প্রতিকার পাবেন বুঝতে না পেরে তিনি কলাবাগান সোসাইটিতে গিয়েছিলেন। পেশায় নিরাপত্তারক্ষী এই বাবা জানেন না তাঁর আদরের মেয়েটির ভবিষ্যৎ কী। কীভাবে কাগজপত্রে হওয়া এই বিয়ের ফাঁড়া থেকে তিনি মুক্ত করবেন মেয়েকে।
সমাধান জানতে মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলীর দ্বারস্থ হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনে অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ের বৈধতা নেই। এ ক্ষেত্রে কাজির ভূমিকা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। ঘটনা বুঝে ভুক্তভোগী পরিবার অপহরণের মামলাও করতে পারে। প্রথম আলো