নির্মম ছকের ১৪ ডিসেম্বর
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। দেশব্যাপী তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী তখন সরাসরি অংশ নিয়েছে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। ওইদিন হতে পূর্ব-পাকিস্তানে কারফিউ জারি করা হয়। নিশ্চিত পরাজয় জেনেই কারফিউ জারি করে পাকিস্তান সরকার। যুদ্ধের দামামা বাজলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পিছুটান তখন স্পষ্টতই টের পাওয়া যাচ্ছিল। ডিসেম্বরের শুরু থেকে দেশের অনেক এলাকা মুক্ত হতে শুরু করে।
তবে পরাজয়ের আগে ঘাতক পাকিস্তান বাহিনী এবং তাদের দোসররা বাঙালির সর্বোচ্চ ক্ষতি করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় মেতে উঠে ঘাতকরা।
লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কন্ঠশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ওনাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী এবং সংস্কৃতিসেবীদের হত্যার মধ্য দিয়ে তারা জাতিকে মেধাশূন্য করতে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
২৫ মার্চ ১৯৭১ কলো রাতেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবীদের নিধনযজ্ঞ কার্যক্রম। অার পরিকল্পিতভাবে ১০ ডিসেম্বর হতে শুরু হয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয়। এদিন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবী নিধন করা হয়েছিল। এদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা হতে ধরে নিয যাওয়া হয়। তাদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ওপর বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।
আরও : ঈদ শেষে ঢাকা ফিরতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ
নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে প্রতি বছর ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তাকে তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের পেছনে ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক গঠিত কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলেন বদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনুদ্দীন (অপারেশনইন-চার্জ) ও আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)।
১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল। তার গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের দেয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী রায়েরবাজারের বিল ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ির বধ্যভূমি হতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধজীবীর গলিত মরদেহ পাওয়া যায়। যাদের আশরাফুজ্জামান খান নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিলেন।
আর চৌধুরী মঈনুদ্দীন ৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি অবজারভার ভবন হতে বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে পৌঁছে দিতেন। এছাড়া আরো ছিলেন এ বি এম খালেক মজুমদার (শহীদুল্লাহ কায়সারের হত্যাকারী), মাওলানা আবদুল মান্নান (ডা. আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী, আবদুল কাদের মোল্লা (কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী) প্রমুখ। চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং গিয়াস কাদের চৌধুরী।