নৌ-পরিবহনে দুর্নীতি, সংসদীয় কমিটির ক্ষোভ
---
নিজস্ব প্রতিবেদক : নৌপরিবহন প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের গাফলতি এবং সক্ষমতায় ঘাটতিকে দায়ী করেছে সংসদীয় কমিটি। তাদের ভাষ্য, কাজের দিকে মনোযোগের বদলে আর্থিক সুবিধার দিকে কর্মকর্তারা বেশি নজর দেওয়ায় প্রকল্পের এই হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
দেখা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন ৩৬টি প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি অগ্রগতি অসন্তোষজনক; প্রত্যাশার চেয়েও অনেক কম। কোনো কোনো প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১ শতাংশ। বিআইডব্লিউটিসির দিলকুশাস্থ মতিঝিলের বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ৭৩ লাখ টাকা ব্যয় হলেও অগ্রগতি মাত্র ২ শতাংশ।
প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় একদিকে যেমন উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, অপরদিকে যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় ব্যয় বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা নিয়েও নানা প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে প্রকল্প পরিচালকদের যোগ্যতা নিয়েও। অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সম্প্রতি এক বৈঠকের কার্যবিবরণীতে মন্ত্রণালয় দুটির প্রকল্পের কাজের অগ্রগতির এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। মন্ত্রণালয়ের নেওয়া প্রকল্পগুলোর বাস্তব চিত্র দেখে সংসদীয় কমিটির সদস্যরা তীব্র অসন্তোষ জানান।
তারা বলেছেন, এভাবে চৌম্বক গতিতে কাজ চলতে থাকলে সরকারের নেওয়া অনেক অর্জন ম্লান হতে পারে।
কার্যবিবরণীর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন ৩৬টি এবং রেলপথের ৫৩টি প্রকল্পের মধ্যে বেশিরভাগেরই কাজের অগ্রগতি ২৫ শতাংশের কম। যার মধ্যে নৌ মন্ত্রণালয়ের আশুগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার নৌবন্দর স্থাপনে নেওয়া প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ১.০৩১ শতাংশ। এটি আন্তর্জাতিক মানের অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) প্রকল্প স্থাপনের জন্য ২০১০-এর জানুয়ারি মাসে একনেকের সভায় অনুমোদন করে ২৪৫ কোটি টাকা।
তামাবিল স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত জুনে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত (২০১৬-১৭ অর্থবছর) কাজের বাস্তব অগ্রগতি ২.৫০ শতাংশ। আবার বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার ক্রয় প্রকল্পের কাজও সন্তোষজনক নয়। নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জুন ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা। প্রথম ধাপে ১০টি এবং প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আরো ১০টি ড্রেজার কেনা হবে। এই প্রকল্পের এখনও কোনো অগ্রগতি নেই।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম পর্যায়ের ১০ ড্রেজার ও বিভিন্ন ধরনের ৭২টি নৌ-যন্ত্রাংশ কেনায় পূনঃটেন্ডার করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৪০ কোটি টাকা; যার মধ্যে ১০ ড্রেজারেই ব্যয় হবে ৭৭০ কোটি টাকা। এই ড্রেজায় কেনায় অনেক দুর্নীতি রয়েছে বলে অভিযো পাওয়া গেছে। একইভাবে বিআইডব্লিউটিসির বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর নির্ধারণ হয়। ইতোমধ্যে মেয়াদ পূর্ণ হলেও প্রকল্পে অগ্রগতি মাত্র ২.০২ শতাংশ। অথচ এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৭৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় অফিস বিল্ডিং নির্মাণে ব্যয় ধরা রয়েছে ৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবেশ ছাড়পত্রসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পর বঙ্গভবনের নির্দেশে কার্যক্রম থেমে আছে। বলা যায়, এরই মধ্যে ব্যয় হওয়া পুরো টাকার অপচয় হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া পানগাঁও অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরটি দীর্ঘদিন আগে কার্যকর করা হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একটি ক্রেন ক্রয় করা হয়েছে। আর মংলা বন্দরটি ১৯৮৭ সালে চালু হলেও সেখানে এখনও কোনো শোর ক্রেন ক্রয় করা হয়নি বিধায় জাহাজ থেকে কন্টেইনার খালাসের সুযোগ নেই। ফলে খুলনা ও ফরিদপুর অঞ্চলের উৎপাদিত পাট ছোট জাহাজের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে রফতানি করতে হচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন নেওয়া বেশিরভাগ প্রকল্পের চিত্র একই।
অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটন এ প্রসঙ্গে বলেন, নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন ৫৩টি প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজের অগ্রগতি ২৫ শতাংশের কম। কোনো কোনো প্রকল্পের অগ্রগতির চিত্র ভয়াবহ।
আশুগঞ্জ ও বিআইডব্লিউটিসির দিলকুশাস্থ জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুটি প্রকল্পের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে এই সংসদ সদস্য বলেন, আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার নৌবন্দর স্থাপনের অগ্রগতি ১ দশমিক ০৩১ শতাংশ এবং বহুতল ভবন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ২ শতাংশ। এ ছাড়া এই মন্ত্রণালয়ের অধীন আরও ৭টি প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১ শতাংশ।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোর চিত্র একই বলে জানান সংসদীয় কমিটির সভাপতি। আশুগঞ্জ প্রকল্পের বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বলেন, ভারত সরকার আশুগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার নৌবন্দর স্থাপন প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করে এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য এলওসিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ভারত থেকে এই প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ না করায় কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়নি। ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ওই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।