ফ্যাসিস্ট হামলার মুখে রোহিঙ্গারা
---
কায়ছার আলী : একটি ছোট প্রশ্ন। ছোট জিজ্ঞাসা। অজানাকে জানাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রশ্নটি ছোট হলেও গভীরতা অনেক। প্রশ্নটি করার সাথে সাথে উত্তরদাতা থমকে যান। কিছুক্ষন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তবে উত্তরটি দেন এক কথায় নয়, বিশদভাবে। বিশ্বের ঝানু রাজনীতিক, তুখোড় সাংবাদিক সবার প্রশ্ন নিয়মিত তিনি মোকাবেলা করছেন। তবে গত সোমবার পহেলা জুন ২০১৫ হোয়াইট হাউজে পেনসিরি বাংসিরি নামে এক থাই তরুনীর প্রশ্নে হকচকিয়ে যান স্বয়ং উত্তরদাতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ইয়ং সাউথ ইস্ট এশিয়ান লিডারস্ ইনিশিয়েটিভ ফেলোস প্রোগ্রামে এই নবীন গবেষক প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখেন “আপনি রোহিঙ্গা হলে কোথায় বাস করতে পছন্দ করতেন এবং কেন? হৃদয়গ্রাহী প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন “আমার মনে হয়, আমি যদি রোহিঙ্গা হতাম তাহলে আমি আমার জন্মভূমিতেই থাকতে চাইতাম।
আমার বাবা মা যেখানে বাস করেছে, আমি সেখানেই থাকতে চাইতাম। কিন্তু আমাকে নিশ্চিত হতে হতো যে আমার সরকার আমাকে নিরাপত্তা দেবে। লোকজন আমার সাথে নিরপেক্ষ আচরণ করবে। এটাই আমি চাইতাম। সমুদ্রে ভাসমান রোহিঙ্গাদের সাথে কী ধরনের আচরণ করা হবে, উত্তরে বলেন “এই ইস্যুটি (মিয়ানমারের) গনতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ”। যুক্তরাষ্ট্রও বেশকিছু রোহিঙ্গা আশ্রয় দেবে বলে উল্লেখ করেন এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সরকারকে তাদের আশ্রয় দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার সরকারের বৈষম্যবাদের নিন্দা জানিয়ে আরও বলেন “ধর্ম ও বর্ণের বিভাজন ঘটিয়ে কোন দেশে সফল হতে পারে না।
বর্তমান বিশ্বে Top of the Issue এবং সবচেয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত, আলোচিত ও ভাগ্যবিড়ম্বিত রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা। সেই জাতির ইতিহাস এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট সম্পর্কে যত লেখা হবে আমার মনে হয় তত কম লেখা হবে। Internet Search বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রাপ্ত তথ্য এবং রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস বইয়ের তথ্য সূত্রে বা অল্প ভাষায় তাদের ইতিহাস বর্ননা করা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। রোহিঙ্গা শব্দটি রৌহিঙ্গা বা রোহিঙ্গিয়া শব্দ থেকে এসেছে, যা ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা। আর এই ভাষার সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষার রয়েছে অবিশ্বাস্য মিল এবং বাংলার সাথে কিছুটা । অন্যমতে রোহিঙ্গা শব্দটি ‘রাহমা’ শব্দ থেকে এসেছে। অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকদের জাহাজ রামরি দ্বীপ-এ এসে পৌঁছালে তৎকালীন আরাকানের রাজা তাদের আশ্রয় দেয়।
তবে এই দয়ার কারনে বনিকেরা আরাকানের অধিবাসীদের ‘রাহমা’ বলে ডাকতেন (রাহমা অর্থ দয়াবান) । মতান্তরে ‘ম্রৌহাঙ্গ’ শব্দ থেকে রোহিঙ্গা শব্দটির আগমন। ম্রৌহাঙ্গ ছিলেন আরাকানের পুরাতন রাজা। এ পৃথিবীতে প্রত্যেক জাতির একটি উত্থান কাল আছে। আমার মনে হয়, কোন জাতির উত্থানকালীন সময়ের আচরণই সে জাতির বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে। অধিকাংশ জাতির উত্থান পর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এ সমস্ত সবল জাতিসমূহ পার্শ্ববর্তী দূর্বল জাতির স্বাধীনতা হরণ করেছে, সম্পদ লুন্ঠন করেছে ও তাদের অধিকার হরণ করেছে। কিন্তু বাংলার মুসলিম শাসকগন সে পথে অগ্রসর হননি। তারা পার্শ্ববর্তী ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় গুরুত্বপর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন। সপ্তম-অষ্টম শতকেরও আরাকানে মুসলমানের বসবাস ছিল এবং আরাকানের সাথে আরব বিশ্বের যোগাযোগ সুপ্রাচীন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে রোসাঙ্গ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত আরাকানের ইতিহাস জানার শ্রেষ্ঠ উপাদান হল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। প্রকৃত পক্ষে বাংলা সাহিত্য চর্চা শুরু হয় বাংলার রাজধানী গৌড়ের ইলিয়াস শাহী রাজবংশের ঐকান্তিক আগ্রহ ও আনুকূল্যে।
পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যকালে গৌড়ের পতনের পর আরাকানের রোসাঙ্গ (মণিময় অলংকার) রাজসভাই বাঙালী মহাকবি দৌলত কাজী, মহাকবি আলাত্তল, মরদন, কোরেশি মাগন ঠাকুর, নসরুল্লাহ খান প্রমুখ আরাকানকে রোসাঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। আরাকানের মুসলমানেরা নিজেদের রোহিঙ্গা বলে পরিচয় দিতে থাকেন। ১৪০৬ সালে বার্মা কর্তৃক আরাকান আক্রান্ত হলে আরাকানের তরুন রাজা পালিয়ে তদানিন্তন স্বাধীন রাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় গ্রহন করেন। পরাজিত আরাকানীরা বার্মার কাছে স্বাধীনতা হারায়। কিন্তু রাংলার সুলতান জালালুদ্দিন শাহ্ মতান্তরে নাসিরুদ্দিন শাহ্ এক বিরাট সৈন্যবাহিনী দিয়ে আরাকানের রাজাকে স্বদেশের স্বাধীনতা উদ্ধারে সাহায্য করেন এবং ঐ সৈন্যবাহিনীকে স্বাধীন আরাকানের নিরাপত্তার জন্যে স্থায়ীভাবে আরাকানের রাজার অধীনে ন্যস্ত করেন।
এমন মহানুভবতার নজির পৃথিবীর খুব কম জাতির মধ্যেই দেখা যায়। আরাকানের বর্মী সৈন্যদের দখলদারিত্বের টানাপোড়নেই বাংলা-বার্মার মধ্যে দু’বার সামরিক সংঘাতের সূচনা হয়। সূদীর্ঘ ৩৫০ বছর পর্যন্ত আরাকান রোহিঙ্গা মুসলমান কর্তৃক শাসিত হওয়ার পর ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা ভোদাপায়া আরাকান দখল করে পূর্বের সকল চুক্তি অস্বীকার করে আরাকানকে বার্মার অংশে পরিনত করেন। ভাগ্যের নির্মম, নির্দয়, নিষ্ঠুর পরিহাস, ক্ষমতালোভী সামন্তদের অনুপ্রেরনায় আরাকানীরা বাদযন্ত্র বাজিয়ে পরম আনন্দে বর্মী সৈন্যদের স্বাগত জানালেও এই আনন্দ একমাসেও স্থায়ী হয়নি। অতি অল্পদিনের মধ্যেই আরাকানীরা দেখতে পেল বর্মী সৈন্যদের বর্বর ও পাশবিক চরিত্র। মাত্র দশ বছরে আরাকান দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ১০০ মাইল দীর্ঘ নাফনদীর এপারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সীমানায় গভীর অরণ্যে এবং দক্ষিন চট্টগ্রামের ৭২ মাইল পর্যন্ত পার্বত্য স্থল অঞ্চলে তারা আশ্রয় নেয়। বিপ্লবী আরাকানীরা শক্তি বৃদ্ধি করে হারানো স্বাধীনতা উদ্ধারে যুদ্ধ সূচনা করে। বর্মী সরকার ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের মধ্যে ১৮২৬ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি শান্তি চুক্তি অনুযায়ী বর্মী সরকার আরাকান, আসাম ও মনিপুর হতে দাবি প্রত্যাহার করে নেয়।
১৮৮৫ সালে সংঘটিত বাংলা-বার্মা যুদ্ধের (১ম ১৮১৯, ২য় ১৮৫২) পর সমগ্র বার্মার শাসন ক্ষমতা রাজা থিব থেকে ব্রিটিশদের দখলে যায়। বার্মার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্লোগান ছিলো, “বার্মা বর্মীদের জন্য”। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এর প্রচার করে ‘বার্মা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বর্মীদের জন্য এবং মুসলমানেরা হল বহিরাগত’। ব্রিটিশ সরকার এ নীতি মুসলমানদের নিরাপত্তা বিঘিœত করে তোলে, যা অতীতে কখন ও ছিল না। ১৯৩০ সালে বর্মী- ভারতীয়দের দ্বন্দ, ১৯৩৮ সালে বৌদ্ধ-মুসলিম দাঙ্গা, ১৯৪২ সালে এক লক্ষ আরাকানে নৃশংস রোহিঙ্গা হত্যা কয়েক লক্ষ দেশ ত্যাগে বাধ্য ব্রিটিশ সরকারের সৃষ্ট বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িকতার ফলশ্রুতি। ১৯৪২ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সৈন্যরা ব্রিটিশ কলোনি থাকা অবস্থায় বার্মাকে আক্রমন করে। তখন রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করে। শুরু হয়ে যায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরাকান বৌদ্ধদের জাতিগত দাঙ্গা, জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন । পৃথিবীর সব সীমান্তে একই জাতি সীমান্তের দুইপারে বসবাস করে। এজন্য কোন নাগরিকের জাতীয়তা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া উচিত নয়। ভৌগলিক সীমান্তে ভারত অঞ্চলে যারা ‘নাগা’ জাতি নামে পরিচিত, মায়ানমার সীমান্তে সেই জনগোষ্ঠি ‘কাচিন’ নামে পরিচিত। ভারতে যারা ‘মিজো’ নামে পরিচিত মায়ানমারে একই জনগোষ্ঠি ‘সীন’ জাতি নামে পরিচিত। মায়নমারে যারা ‘শান’ জাতি নামে পরিচিত, থাই সীমান্তের অভ্যন্তরে তারা ‘থাই’ জাতি নামে পরিচিত। ইতিহাস ‘মগ’ নামে পরিচিত জনগোষ্ঠি আরাকানে ‘রাখাইন’ নামে পরিচিত। এদের অনেককে বাংলাদেশে ‘মারমা’ নামে অ্যাখায়িত করা হয়। উল্লেখ্য রোহিঙ্গারা একটি ভাষাভিত্তিক জাতিগোষ্ঠি। একজন জাপানিকে যেরূপ ভাষার মাধ্যমে একজন ভিয়েতনামী থেকে আলাদা করা যায়, ঠিক তেমনি একজন রোহিঙ্গাকে ভাষার মাধ্যেমে একজন বাঙ্গালী এমনকি একজন চট্টগ্রামী থেকেও পৃথক করা সম্ভব। যুদ্ধ কিংবা শান্তি দু’পরিবেশই রোহিঙ্গাদের জন্য নির্যাতন বয়ে আনে।
১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত প্যানলং সম্মেলনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৪৮ সালে ৪ঠা জানুয়ারী বার্মার স্বাধীনতা লাভের পর রোহিঙ্গারা জাতিগত পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৯৫৮ সালে রোহিঙ্গারা প্রথম আরাকান থেকে নির্যাতিত হয়ে এদেশে পালিয়ে আসে। ‘আকিয়াব’ এর কিছু মগ এই সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। ফলে বার্মা সরকার পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়। ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা নব-নারী, যুবা-বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পালিয়ে আসলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষন করে। দ্বি-পক্ষীয় সমঝোতার ফলে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেকে স্বদেশে ফিরে যায়। অবশিষ্টদের ভাগ্যে শরনার্থী হিসেবে কক্সবাজারের দু’টি শিবিরে অমানবিক পরিবেশে দীর্ঘকাল থেকে বাংলাদেশ সরকার ও উদ্বাস্তু বিষয়ক জাতিসংঘ হাই কমিশনের যৌথ ব্যবস্থাপনায় এখানে বসবাস করছে। মিয়ানমার সরকার অতীত থেকেই তাদের দেশে রোহিঙ্গাদের জন্য জাহন্নামের অগ্নিকুন্ডে পরিনত করেছে। পাখিও আপন নীড়ে ফিরে পুনরায় শ্বাস নেয়। এরা তো মানুষ। মায়ানমারের মোট জনসংখ্যা ৫০ মিলিয়ন, মুসলমান কমপক্ষে ৬ মিলিয়ন এবং ৩ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বসবাস করে আরাকান অঞ্চলে। বার্মার সংবিধানের বুনিয়াদী জাতির সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়েছে, “যে সমস্ত জাতিগোষ্ঠি বর্তমান ইউনিয়ন অব বার্মার স্বীকৃত ভুখন্ডে ১৮২৩ সালের পূর্ব হতে জাতিগতভাবে কিংবা গোষ্ঠীগতভাবে বসবাস করে আসছে তারা বুনিয়াদী জাতি হিসেবে পরিগনিত হবে”। নাগরিকত্ব আইনের ১১(১) ধারা মতে বুনিয়াদী জাতির যেকোন সদস্য বার্মার নাগরিক। ইউনিয়ন অব বার্মা একটি বহুজাতিক দেশ। সরকারিভাবে ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীর তালিকায় রোহিঙ্গারা আজ ও স্থান পায়নি। ২০১০ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী পরিচয়পত্র “সাদা কাগজ” প্রথার প্রচলন হয়। ২০১৪ সালের আদম শুমারিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি।
২০১৫ সালে ১১ই ফেব্রুয়ারী “সাদা কাগজ” (অস্থায়ী পরিচয়পত্র) প্রত্যাহার এবং ভোটাধিকার হরণের ফলে বর্তমান তারা বিচ্ছিন্নহীন নাগরিক। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে ২০১২ সালেই শত শত রোহিঙ্গা, দেড় লাখ গৃহহীন আর শিশুদের পুড়িয়ে মারার দৃশ্য বিবিসি প্রকাশ করেছিল। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কিছু রাখাইন কর্মকর্তা আট রোহিঙ্গা মহিলাকে অপহরন, হত্যা ও ধর্ষন করলে রোহিঙ্গারা এর প্রতিবাদ জানায়। তখন এদের ওপরে চলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। আরাকানে আজ রোহিঙ্গারা আমাদের অতীত ছিটমহলবাসী বা জেনেভা ক্যাম্পে অবাঙালী মুসলমাদের চেয়েও বেশি অসহায়। যখন আক্রমন হয় মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনাবাহিনী দর্শকসারিতে ছিল অথবা তাদের সহায়তা জুগিয়েছে। রোহিঙ্গা নিধন আন্দোলনে কলকাঠি নাড়ছে বৌদ্ধদের চরমপন্থী সংগঠন ৯৬৯ Movement of Buddhism যার নেতা উইরাথু বৌদ্ধ ভিক্ষু। যিনি ২০০৩ সালে মুসলিম বিরোধী প্রচারনায় সাত বছর জেলে ছিলেন। গত ২০১৫ম মে-জুন দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলসহ নিজ দেশের নির্যাতিত ও পরবাসী রোহিঙ্গা মুসলিম বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি এবং ভাগ্যান্বেষনের আশায় সাগরে ভাসছিল কিছু বাংলাদেশিকে নিয়ে (৮হাজারের বেশি)। তারা নৌকায় আন্দামান সাগর ও মালাক্কা প্রনালীতে ভাসমান দুঃসহ জীবনযাপন করেছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা মুত্রপান করে খাবার নিয়ে মারামারিতে ১০০জন এবং সাগরে যাত্রাকালে ২০০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পাশাপাশি খুব বড় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল ।
জাতিসংঘ এদের বলেছিল ভাসমান কফিন। সমুদ্রের তীরবর্তী দেশসমুহের গভীর জঙ্গলে শত শত অজানা অচেনা অসংখ্য কবর দেখা গেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বর্তমানে বিশ্ব সমাজ চুপ করে বসে নেই, বিক্ষোভ মিছিল ও নিন্দা জানাচ্ছিল। তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইনামা সহ অনেকে গনতান্ত্রিক নেত্রী ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির নিরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এই দুঃসময়ে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিলো মানবতাবাদী লিথুনিয়ায় জাপানের রাষ্ট্রদূত সুগিহারার মতো মহান ব্যক্তির। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের অন্তর্গত “আশউইচ” এলাকায় প্রতিদিন নাৎসী বাহিনী প্রায় ১২০০ ইহুদিকে নৃশংসভাবে হত্যা করত। একদিন তিনি ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তার দরজার পাশে মৃত্যুভয়ে ভীত দুইশত ইহুদি জাপানে ভিসার জন্য অপেক্ষা করছেন, তাদের পেছনে তারা করে ফিরছে বর্বর নাৎসি বহিনী। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া আগ্রাসী দেশ জাপানের কাছে জানতে চাইলেন, কী করবেন তিনি? জাপান সরকার তাদের ভিসা দিতে নিষেধ করলেন। চোখের সামনে বিপন্ন মানবতার ক্রন্দন তাঁকে বিচলিত করে। তিনি সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঐ সময়ে ছয় হাজার অসহায় ইহুদিকে জাপানের ভিসা ইস্যু করেন, নাৎসি সরকারের অনুরোধে সুগিহারাকে জাপান প্রত্যাহার করে নেয়। ইতিহাস বলছে, যে ট্রেনে ফিরছিলেন সেই ট্রেনের কামরায় বসেও তিনি কয়েকশ ইহুদির ভিসা দিয়েছিলেন।
এক সময়ে ভিসার কাগজ শেষ হয়ে গেলে তিনি সাদা কাগজে হাতে লিখে ভিসা দিতে থাকেন। বিশ্বযুদ্ধের ৭০ বছর পর আজ মানবতাবিরোধী নাৎসিদের খুঁজে বের করে বিচার করা হচ্ছে। অন্যদিকে জাপানের সেই রাষ্ট্রদূত সুগিহারাকে বিশ্বযুদ্ধে মানবতার পাশে দাঁড়াবার জন্য ১৯৮৫ সালে সম্মাননা প্রদান করা হয়। মানবতার জয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। এর শক্তি পারমানবিক বোমার থেকেও বেশি। সাগরের বুকে ভেসে থাকা অসহায় বৃদ্ধ, বিপন্ন মা, ক্রন্দনরত শিশু আর ভীত সন্ত্রস্ত গৃহবধুর প্রকাশিত নিদারুন ছবিগুলো বিশ্ববিবেককে প্রতিমূহুর্তে কষ্ট দিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার পর গত ৩১ আগষ্ট ২০১৫ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন (মিয়ানমার পরিদর্শনের সময়) নতুন বেসামরিক সরকার উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী সূচি সকলের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার প্রদানের কথা বললেও বর্তমানে রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চলছে। শান্তিতে নোবেল জয়ী এবং রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর সূচির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের জন্য সারাবিশ্বে জনমত গড়ে উঠছে। দীর্ঘদিনের জটিল এবং স্পর্শকাতর এই ইস্যুর স্থায়ী সমাধান না হয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে সারাবিশ্ব বাসী মনে করছে রোহিঙ্গাদের জন্য “ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির আর আকাশে শকুন”।
লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, [email protected]