অতিবৃষ্টি, উজানের পানি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট এবারের বন্যায় দেশের অর্ধেক জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মোট মানুষের সংখ্যা ৮২ লাখ ১৭ হাজার ৪৩২ জন। আর ক্ষতিগ্রস্ত মোট ফসলি জমির পরিমাণ ছয় লাখ ছয় হাজার ৯৫৫ হেক্টর। এর মধ্যে এক লাখ দুই হাজার ৮০৮ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে এবং পাঁচ লাখ চার হাজার ১৪৭ হেক্টর জমির ফসল আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল ডিজ্যাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) থেকে পাওয়া সর্বশেষ ৫ সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো— দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাঙামাটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, যশোর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, শেরপুর, মৌলভীবাজার, নওগাঁ, ঢাকা, কুমিল্লা, রংপুর, মানিকগঞ্জ, জয়পুরহাট, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, নাটোর ও চাঁদপুর।
এনডিআরসিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩২টি জেলার মধ্যে বন্যাকবলিত উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও গ্রামের সংখ্যা; জেলাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও বাড়িঘরের সংখ্যা; ক্ষতির শিকার রাস্তাঘাটের পরিমাণ বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন জেলার সংখ্যা ১০টি। এগুলো হলো— দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, নওগাঁ, নাটোর, জয়পুরহাট, জামালপুর ও গাইবান্ধা। মাঝারি ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১৭টি জেলায়। অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতি হয়েছে বাকি ৫টি জেলায়।
এনডিআরসিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করায় ও বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দেশের সব জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বন্যাকবলিত ৩২টি জেলার মধ্যে এ পর্যন্ত ২৮টি জেলার নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং বন্যার পানি নেমে গেছে। ফলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে শরীয়তপুর ও চাঁদপুর জেলায় নদী ভাঙ্গন চলছে।
প্রতিবেদনে জানা গেছে, এবারের বন্যায় মোট একশ ৪৫ জন মানুষ মারা গেছেন। ৮৫টি ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর চার হাজার ৭৩৫টি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা দুইশ আটটি, পৌরসভার সংখ্যা ৬৫টি। বন্যায় এক হাজার ৩২৪টি ইউনিয়নের ৯ হাজার ৭৯৫টি গ্রামের মোট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৩৬ হাজার ২৬৩টি। এর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতি হয়েছে— এমন পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ১১ হাজার ১২৮টি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের বন্যায় এক লাখ তিন হাজার ৫১৬টি বাড়িঘর সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে, আংশিকভাবে ভেঙে যাওয়া বাড়িঘরের সংখ্যা ছয় লাখ ১৮ হাজার ৫১৬টি। মোট ৮২ লাখ ১৭ হাজার ৪৩২ জন মানুষ এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৫৯৯ জন মানুষ সম্পূর্ণভাবে ও ৭৯ লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৩ জন মানুষ আংশিকভাবে ক্ষগ্রিস্ত হয়েছেন। এবারের বন্যায় মোট ১৭২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ৪৬ হাজার ৪৮ জন মানুষ আশ্রয় নেন।
এদিকে, এবারের বন্যায় ৮৮৫ কিলোমিটার রাস্তার সম্পূর্ণ ও ১০ হাজার ৩৬৬ কিলোমিটার রাস্তার আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৮৪টি ব্রিজ ও কালভার্ট। সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে ১৩২ কিলোমিটার বাঁধ, আংশিকভাবে ভেঙে পড়েছে ৬৬৪ কিলোমিটার বাঁধ। ৩২ জেলায় হাঁস-মুরগি মারা গেছে ৮৪ হাজার ৭৭০টি।
এবারের বন্যায় সারাদেশের ৩২ জেলায় মোট ৭০ হাজার ৭৮টি টিউবঅয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ক্ষতি হয়েছে ৩৮টি। এক হাজার ৪৬১টি মেডিক্যাল টিম এবার বন্যাকবলিত অঞ্চলে দুর্গত মানুষদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বন্যা কবলিত ৩২ জেলার বন্যাদুর্গতদের জন্য এ পর্যন্ত ২৭ হাজার দুইশ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ১৭ হাজার ৩৯৪ মেট্রিক টন চাল। এসব জেলায় ৯ হাজার ৮১৩ মেট্রিক টন চাল বর্তমানে মজুদ রাখা হয়েছে। এর বাইরে এসব জেলার জন্য বরাদ্দ করা ৭১ হাজার ২৬০ প্যাকেট শুকনো খাবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৬৯ হাজার ১২০ প্যাকেট। বাকি প্যাকেটগুলো মজুদ রাখা হয়েছে। এছাড়া, বন্যাকবলিত জেলাগুলোর ঘরহারা মানুষের ঘর তৈরি করার জন্য এ পর্যন্ত ৩১ হাজার ৯৮০ বান্ডিল ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে ৯ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব জি এম আব্দুল কাদের জানান, বন্যাকবলিত ৩২ জেলায় এ পর্যন্ত ১৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি বৈঠকে জানানো হয়, সম্প্রতি দেশব্যাপী অতিবৃষ্টি ও বন্যাজনিত কারণে কৃষকের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষকের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার ওপরও বিস্তারিত আলোচনা হয় ওই বৈঠকে।
গত বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলেরও একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার প্রস্তুত। দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি ভালো থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম রাখা সম্ভব হয়।’ এবারের বন্যায় সরকারের দুর্যোগকালীন প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল বলেই কেউ না খেয়ে মরেননি। সরকারের সব দফতরের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছে বলেই দুর্গত মানুষের কাছে খাদ্য, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী যথাসময়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।’
ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরকার খাদ্য আমদানি করছে। ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি করে বন্যা কৃষকের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনলেও এটি সঙ্গে করে অনেক পলিমাটিও বয়ে আনে, যা জমির উর্বরতা বাড়ায়।
সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের কল্যাণে সরকারি প্রশাসনের লোকজন কাজ করছে। এখন চলছে পুনর্বাসনের কাজ। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা মিলে সেই কাজটি করছে।’