অনলাইনে হয়রানির শিকার হচ্ছেন মালয়েশিয়ার মুসলিম নারীরা
---
নিউজ ডেস্ক : এ বছরের শুরুর দিকে পনেরো বছর বয়সী মালয়েশিয়ান এক কিশোরী দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নের কথা শেয়ার করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে। এরপর থেকেই হিজাব পরিধান না করার অজুহাতে তাকে অনলাইনে ক্রমাগত বিরূপ মন্তব্য ও আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দেশটির মুসলিম নারীরা এ ধরনের বাজে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বিবিসিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এটা অবশ্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, পৃথিবীব্যাপী নারীরা অনলাইনে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তবে মালয়েশিয়ার মুসলিম নারীদের এ ধরনের তিক্ততা বাড়ছে। সম্পর্কে সামাজকর্মীরা বলছেন, ‘বিশেষ করে মুসলিম নারীরা কিছু প্রত্যাশিত সামাজিক আচার-আচরণের জন্য আরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন।’
‘সাম্প্রতিক মালয়েশিয়ায় আমরা দেখতে পাচ্ছি অনলাইনে মুসলিম নারীরা (বিশেষত মালয় মুসলিম নারীরা) বিভিন্ন পন্থায় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে আছেন। মূলত নারীরা নিজেদের কীভাবে উপস্থাপন করছেন তার ওপর ভিত্তি করেই ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আসে’, বলেন জুয়ানা জাফর। যিনি একজন নারী অধিকার রক্ষা কর্মী এবং আইনজীবী।
তিনি বলেন, ‘আসলে অনলাইনে নারীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক আক্রমণগুলো এতটাই পাশবিক হয় যে, যার কারণে হয়তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একাউন্ট মুছে ফেলতে হয়, না হয় সাহায্যের জন্য অন্য কারও কাছে হাত পাততে হয় অফলাইনে। আর মাধ্যমগুলোতে যদি আপনার একাউন্টের নাম মালয় ধাঁচের হয়, তবে তো আর কথা নেই।’
এখানে মূল ঘটনাটি তবে কী? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের মানুষগুলো প্রতিবেশীদের ব্যাক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোতে সবসময় সচেষ্ট থাকেন। এটি ধর্মীয় নয় বরং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিষয়। জুয়ানা জাফর বলেন, ‘ধর্ম কখনও অন্যদেরকে আচরণের মাধ্যমে কষ্ট দেওয়ার সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করেনি। উল্টো হাদিস শরীফে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্মান প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে।’
তারা খুঁতগুলো নিয়ে বেশি আগ্রহী
‘যদিও এ সমস্যাগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। তবে হয়রানিগুলো মালয়েশিয়ায় এসে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। অবশ্য এগুলোর শেকড় ধর্মের ভুল বা সংকীর্ণ ব্যাখ্যায়ও নিহিত’, বলেন ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়ার জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ড. এলিসিয়া এজহারুদ্দিন।
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে পরিচয় গোপন করে সাইবার বুলিং এবং ঘৃণার বাণীগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে।’
২৫ বছর বয়সী টুইটার ব্যবহারকারী মরিয়ম লি অনলাইনে আক্রোশের শিকার হওয়ায় সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিনি আর হিজাব পড়বেন না। এ সিদ্ধান্ত তাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। তিনি বলেন, ‘এটা শুধু একটি বিষয় নয় যে, মানুষ আপনার মতামতকে পছন্দ করছে না। এটা আপনার আত্মসম্মান এবং অস্তিত্বের ওপর তীব্র আঘাত বলা যায়।’
নারীর শরীরই প্রধান লক্ষ্যবস্তু
চিত্তাকর্ষক আঁটসাঁট পোশাক এবং সাজসজ্জা নারীদের লিঙ্গ ভিত্তিক হয়রানির শিকার হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।
মালয়েশিয়ার সমাজবাদী সংগঠন ডিএপি’র কার্যকরী সদস্য ডায়ানা সুফিয়া বলেন, ‘পুরুষদের আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ জুড়েই থাকে নারীদের শরীর। অনেক সময় দেখা যায় একজন নারী মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের আঙুল পর্যন্ত ঢেকে রেখেছেন পর্দা করার জন্য। এরপরও ব্যঙ্গাত্মকভাবে অনেককে বলতে দেখা যায় এটা পর্দা হিসেবে যথেষ্ট নয়।’
নালিসা আলিয়া আমিন নামের একজন টু্ইটার ব্যবহারকারী পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরোধিতা, সমকামিতাকে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি ‘মালয়েশিয়ায় আদর্শ মুসলিম নারী’ ধারণকে গ্রহণ না করে এর বিরুদ্ধে মতামত প্রদান করায় তীব্র হয়রানির শিকার হতে হয় তাকে।
আলিয়া আমিন বলেন, ‘যারা আমার মতামতের পক্ষে সমর্থন দেননি তারা একসময় আমার উপস্থিতিকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করতে শুরু করেন। বিশেষ করে পরবর্তীতে আলোচনা গিয়ে ঠেকে আমার শারীরিক অবয়বে।’
অধিকাংশ নারীর অভিযোগ, মুসলিম পুরুষরাই বিশেষত এ ধরনের হয়রানি করে থাকে। ঘটনাগুলো যখন সামনে চলে আসে তখন ভুক্তভোগীর শারীরিক নিরাপত্তা তো থাকেই না সঙ্গে মনোজগতেও এর বাজে প্রভাব পড়ে।
বর্তমানে অনলাইনে হয়রানির শিকার হওয়া থেকে নারীদের রক্ষায় মালয়েশিয়ায় কোনো আইন বলবৎ নেই। বৃহত্তর দিক বিবেচনায় অনলাইনের জীবনকে এখনও ধোঁয়াশাপূর্ণ মনে করা হয় যা বাস্তবিক জীবনের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে ওঠেনি।
‘আইন স্থিতিশীল, রক্ষণশীল একই সঙ্গে কেন্দ্রীভূত। চাইলেই একটা আইন তৈরি করা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলে গেলে তা আর বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে না’, বলেন স্থানীয় এনজিও কর্মী শিরিন লিম। যিনি ইন্টারেনেটে নারী স্বাধীনতার বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
অবশ্য ইন্টারনেট ব্যবহার-বিধি সংশ্লিষ্ট একটি আইন বিদ্যমান রয়েছে কমিউনিকেশন এবং মাল্টিমিডিয়া আইন নামে। এ আইনের আওতায় মাঝেমধ্যে বিচার যে হয় না তা কিন্তু নয়। তবে তা ইন্টারনেটে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কণ্ঠরোধের জন্যই। বিশেষত কোনো মতামত বা মন্তব্য সরকার, রাজনীতি এবং ধর্মের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলেই বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
সূত্র: বিবিসি