স্বপ্ন নিয়ে ভারতে গিয়ে যৌনদাসী
---
অনলাইন ডেস্ক : কোনো এক মেঘলা বিকালে একটি নৌকায় মাছ ধরার জালে নিজেকে লুকিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী নদী পাড়ি দেন ১৬ বছরের তরুণী আদৃতা (ছদ্মনাম)। চোখে তার স্বপ্ন কোনোভাবে ভারতে পা রাখলেই মিলবে নৃত্যশিক্ষকের চাকরি। দালালই দেখিয়েছিল তাকে এই স্বপ্ন।
কিন্তু কয়েকদিন বাদেই ঘটে স্বপ্নভঙ্গ, জন্মভূমি থেকে দুই হাজার কিলোমিটার দূরে মহারাষ্ট্রের পুনের এক পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে যায় মেয়েটি।
সেখানে নির্যাতনের বিবরণ দিয়ে বাংলাদেশি এই তরুণী বলেন, প্রতিনিয়ত নিপীড়ন ও মারধর সইতে হয়েছে তাকে। তালাবন্ধ একটি কক্ষে আটকে রেখে তাকে বাধ্য করা হত পতিতাবৃত্তিতে। প্রতিদিন অনেক খদ্দেরের মনোরঞ্জন করতে হত তাকে।
প্রায় সাড়ে নয় মাস আগে আদৃতাকে উদ্ধার করে পুনের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়। কেউ তাকে বাড়ি ফিরতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে বলে ভাবতে পারেনি মেয়েটি।
সম্প্রতি থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভারতের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে বাংলাদেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকা অনেকের দুঃসহ জীবনের কথা।
আদৃতার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন সেখান থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনের কনসুলার বিভাগের প্রধান মোশাররফ হোসেন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন দালালের খপ্পরে পড়ে ভারতে আসা অনেক বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর কাজে।
২০১৫ সালের মার্চে হাই কমিশনে যোগ দেওয়া মোশাররফ হোসেন থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন, আমি অনেক বাংলাদেশি মেয়ে ও ছেলেকে পেয়েছি, যারা অনেক কষ্ট সয়েছেন| তারা দীর্ঘদিন ধরে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন।
উদ্ধার হওয়াদের দেশে ফিরতে দেরির কারণ হিসেবে পাচারের ঘটনাগুলোর তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার কথা বলেন তিনি।
গত দুই বছর ধরে এই কাজ করছেন মোশাররফ। বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে আসা যেসব নারী ভারতে পতিতাপল্লীগুলোতে কাজ করছেন, তাদের উদ্ধার করে দ্রুত দেশে পাঠানোই তার লক্ষ্য।
মোশাররফ বলেন, আমি (কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার পর) দ্রুত কাজে নেমে পড়ি এবং উদ্ধার হওয়া অনেক বাংলাদেশি নারীর খোঁজ পেতে থাকি। কেরালায় আমি কয়েকটি মেয়েকে পাই, যারা দেশে ফেরার অপেক্ষায় একটি আশ্রয় কেন্দ্রে সাত বছর ধরে অবস্থান করছে।
মোশাররফ গত বছর পুনের আশ্রয়কেন্দ্রসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান রেসকিউ ফাউন্ডেশন পরিচালিত পুনের আশ্রয় কেন্দ্রে তিনি আদৃতার দেখা পান দুই সপ্তাহ আগে।
গত সপ্তাহেই তার দেশে ফেরার কাগজপত্র প্রস্তুত হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে তিনি দেশে ফিরতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
আদৃতা বলেন, আমার দেশে ফেরার কথা শুনে মা কেঁদেছে। মাকে বলেছি, কয়েক মাস আগেও আমার অবস্থা খারাপ ছিল, এখন অনেক ভালো আছি। পতিতাপল্লী থেকে নয়, আশ্রয় কেন্দ্র থেকে দেশে ফিরতে পারছি, আমি খুশি।
মোশাররফ হোসেন শেষ ছয় মাসে ৪৩৮ জন নারীকে বাংলাদেশে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন, যাদের অর্ধেকই মহারাষ্ট্র থেকে উদ্ধার হয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া নারীদের অন্যতম গন্তব্য এই রাজ্য।
আদৃতাসহ আরও ১৭ নারী বাংলাদেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে।
মানব পাচারবিরোধী ভারতের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা বলছেন, পাচারকারীরা মূলত বাংলাদেশের দরিদ্র নারী আর শিশুদের টার্গেট করে। ভারতে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের হয় পতিতাপল্লীতে বিক্রি করে দেওয়া হয়, নয়ত গৃহকর্মী হিসেবে কাজে লাগানো হয়।
পাচার হওয়া নারী ও শিশুদের অধিকাংশকেই উদ্ধার করা সম্ভব হলেও তাদের দেশে ফিরতে অপেক্ষায় থাকতে হয় দীর্ঘ সময়।
এর কারণ হিসেবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি টাস্ক ফোর্স গঠনের বিষয়টি এক দশক ধরে ঝুলে থাকার কথা বলেন তারা।
“হাই কমিশনের কর্মকর্তারা বিষয়টিকে (দেশে পাঠানো) গুরুত্ব দেওয়ায় এটি এখন আগের চেয়ে সহজ হয়েছে,” বলেন সেভ দ্য চিলড্রেন ভারতের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর জ্যোতি নাল।
মহারাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে মিলে পাচার হওয়া নারীদের দেশে পাঠানোর কাজে যুক্ত রয়েছেন জ্যোতি।
আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা নারীরা দেশে ফিরতে কতটা মরিয়া থাকে তার একটি চিত্র উঠে এসেছে পুনের রেসকিউ ফাউন্ডেশনের আশ্রয় কেন্দ্রের সুপার শাইনি পাডিয়ারার বক্তব্যে।
“আগে ট্রাভেল পারমিট হাতে পেতে মেয়েদের সাধারণত দুই থেকে তিন বছর অপেক্ষায় থাকতে হত। মাঝে মাঝেই তারা ক্ষেপে যেত, ২০১৫ সালে কিছু মেয়ে কেন্দ্রে ভাংচুর চালায়, কয়েকজন পালিয়েও যায়।”
গত মে মাসে এই কেন্দ্র থেকে ২২ জন নারী বাংলাদেশে ফিরে গেছেন জানিয়ে শাইনি বলেন, এখন সেখানে থাকা ১৯ জন নারীর মধ্যে ১৮ জনেরই দেশে ফেরার কাগজপত্র পৌঁছেছে।
আশ্রয় কেন্দ্রে অপক্ষোর সময়টা এখন চার-পাঁচ মাস থেকে কমে দুই সপ্তাহে এসে দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি।
হাই কমিশনের কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন এখন প্রতিটি পাচারের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের কর্মকর্তা এবং পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করেন। পাশাপাশি তিনি সীমান্তের দুই পাশে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়াদের ঠিকানা নিশ্চিত হন। উদ্ধারদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকদের ফোনে যোগাযোগও করিয়ে দেন তিনি। সব মিলিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ।
মোশাররফ বলেন, আমাদের অসহায় ছেলে-মেয়েগুলোর দেখভাল এবং তাদের নিরাপদে দেশে পাঠানো নিশ্চিত করাটা আমাদের দায়িত্ব।
তবে পাচার সংক্রান্ত মামলাগুলো সমাধানের আগেই তাদের দেশে ফেরত পাঠানোয় নতুন জটিলতাও তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন পুনের রেসকিউ ফাউন্ডেশনের আশ্রয় কেন্দ্রের সুপার শাইনি পাডিয়ারা।
তিনি বলেন, ভারতের আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোয় হাজিরা দিতে তাদের (দেশে ফেরা) ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেওয়ার সুবিধা আছে কি না আমি জানি না।
“বিচার শেষ করতে কমপক্ষে দুই বছর লাগতে পারে, আর এসব মেয়েদের ভারতে ফেরার পাসপোর্টও নেই, তারা এখানে থাকতেও চাইবে না।”