কখন ও কেন দিতে হয় ‘আকিকা’
---
মাওলানা মিরাজ রহমান : ইসলামের পরিভাষায় সন্তান জন্মগ্রহণের পর আল্লাহর শুকরিয়া ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে পশু জবাই করা হয়, তাকে আকিকা বলা হয়। আকিকা আরবি শব্দ। শব্দটি আককুন হতে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ দীর্ণ করা, ফাঁক করা, খণ্ডিত করা বা আলাদা করা। কারো কারো মতে, এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বিদ্যুতের ঝলক।
পরিভাষায় আকিকা বলা হয়, নবজাতকের মাথায় গজানো প্রথম চুলগুলোকে। সপ্তম দিনে যেহেতু এগুলো মুড়িয়ে মাথা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এ জন্য এ চুলগুলোকে আকিকা নামকরণ করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে মাথা মোড়ানোর সময় যে ছাগল জবাই করা হয় সেটাকেও আকিকা বলা হয়। (মাযাহেরে হক)
আকিকা ফরজ বা ওয়াজিব নয়; বরং সুন্নত। মোস্তাহাব হলো জন্মের সপ্তম তারিখে আকিকা দিবে। ১৪তম অথবা ২১তম তারিখেও আকিকা করলে সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। আবার সপ্তম তারিখের পূর্বে আকিকা করলে ঠিক হবে না। উত্তম হলো সপ্তাহান্তে সন্তানের জন্মবারের আগের দিন আকিকা দেওয়া। যেমন- শুক্রবার জন্ম হলে আকিকা হবে যেকোনো বৃহস্পতিবার । (ফাতওয়ায়ে শামী) বার্ধক্য বয়সে আকিকা জায়েজ আছে বটে; কিন্তু তা সুন্নত হিসেবে গৃহীত হবে না। (কিফায়াতুল মুফতি)
কারো আকিকা করা না হলে বড় হয়ে নিজের আকিকা নিজেও করতে পারবে। হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্তির পর নিজের আকিকা নিজে করেছেন। (প্রাগুক্ত ১/৫২৯; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদিস: ৬২০৩; আলমুফাসসাল ফী আহকামিল আকীকা, ড. হুসামুদ্দীন ইবনে মূসা, জামেয়াতুল কূদস, পৃ. ১৪২)
আকিকার উদ্দেশ্য: ইসলামের পূর্ব যুগে আরবদের মধ্যে আকিকার প্রচলন ছিল, এতে অনেক প্রকার ফায়েদা ও কল্যাণ নিহিত থাকায় রাসূল (সা.) এটাকে বহাল রেখেছেন। তিনি নিজেও আমল করেছেন এবং অন্যদেরকে আকীকা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। মোটা দাগে আকিকার কয়েকটি উদ্দেশ্য নির্ণিত হয়। এগুলো হলো-
১. রাসূলের (সা.) সুন্নতের অনুসরণ।
২. বংশ পরিচয়ের জন্য উত্তম পদ্ধতি হলো আকিকার আয়োজন করা; আর সমাজ রক্ষায় বংশ-পরিচয় হলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৩. আকিকা সম্পাদনের মাধ্যমে ব্যক্তির অন্তর থেকে কার্পণ্য দূর হয় ও দানের মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
আকিকার শরীয় হুকুম: হজরত সালমান বিন জবয়ী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার সঙ্গে একটি আকিকা জড়িত থাকে। সুতরাং তোমরা তার পক্ষ হতে জবাই (আকিকা) করবে এবং তার শরীর হতে কষ্টদায়ক জিনিস (চুল ইত্যাদি) দূর করবে। (বুখারি, মিশকাত)
হজরত সামুরা (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে হাদিস বর্ণনা করেছেন, প্রত্যেক সন্তান নিজ আকিকার সাথে দায়বদ্ধ। সুতরাং সাত তারিখে তার পক্ষ থেকে জবাই করবে, মাথার চুল মুড়িয়ে ফেলবে এবং তার নাম রাখবে। (তিরমিযী – ১: ১৮৩)
হাদিস শরীফে বর্ণিত রয়েছে, সন্তান তার মা-বাবার জন্য সুপারিশ করবে, কিন্তু মা-বাবা যদি সামর্থ্যানুযায়ী সন্তানের আকিকা না করেন এবং বাল্যকালেই শিশুর মৃত্যু হয়, তাহলে সে মা-বাবার জন্য সুপারিশ করবে না। অর্থাৎ বন্দকি সম্পদ দ্বারা যেমন উপকৃত হওয়া যায় না। তেমনিভাবে আকিকা না করলে সে সন্তানও মাতা-পিতার কাজে আসবে না। আকিকা না করলে সন্তান রোগ-ব্যাধি ও বালা-মসিবত থেকে নিরাপদ থাকে না। সন্তান আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত বিশেষ নিয়ামত আর বান্দার জন্য উচিত নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। সব ব্যক্তির জন্য আকিকাই হলো শুকরিয়া আদায়ের উত্তম পদ্ধতি। যতক্ষণ পর্যন্ত আকিকার মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় না করবে সন্তান যেন এর পরিবর্তে বন্ধক থাকবে। (মাআরিফুল হাদিস- ৬ : ২৬)
আকীকার দিন: সাধারণ সন্তান ভূমিষ্ঠের সপ্তম দিন আকিকা করা উত্তম। তবে যদি কেউ কারণবশত সপ্তম দিন না করতে পারে, তবে পরবর্তী সময়ে যেকোনো দিন আদায় করতে পারবে। সপ্তম দিনে সম্ভব না হলে ১৪ বা ২১ তম দিনে করা ভালো। সপ্তম দিন মনে রাখার একটি সহজ পদ্ধতি হলো, সপ্তাহের যে দিনটিতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে, যেমন—শুক্রবার, পরবর্তী সপ্তাহে ঠিক এর আগের দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার আকীকা আদায় করলে তা সপ্তম দিনে পড়বে। (আবু দাউদ : ২৮৩৭)
হযরত আমর ইবনে শুআইব সূত্রে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবজাতকের সপ্তম দিনে আকিকা করা, নাম রাখা ও তার জঞ্জাল দূর করার (অর্থাৎ মাথার চুল কাটার) নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২৬)
হজরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আকিকার পশু সপ্তম বা চৌদ্দতম বা একুশতম দিনে জবাই করা হবে। (আলমুজামুল আওসাত ৫/৪৫৭)
সন্তান জীবিত থাকা অবস্থায় আকিকা করা মোস্তাহাব। সন্তানের মৃত্যুর পর আকিকা করা মোস্তাহাব হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। তবে যদি কেউ মৃত বাচ্চার আকিকা করাকে মোস্তাহাব মনে না করে শুধু পরকালে তার সুপারিশের আশায় আকিকা করে তাহলে আকিকা করা জায়েজ আছে। তবে সতর্কতামূলক এই আকিকা কুরবানির গরুর সঙ্গে না করে পৃথক ছাগল ইত্যাদি দ্বারা করা চাই। (ফতওয়ায়ে রহীমিয়া– ৬: ১৭৩, মাআরিফুল হাদিস)
আকিকা কে করবে: যিনি সন্তানের লালন-পালন কিংবা ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করছেন, তিনিই সন্তানের আকিকা আদায় করবেন। তাই প্রথমত, এই দায়িত্ব বাবার ওপর ন্যস্ত হয়।
বাবার সামর্থ্য না থাকলে সে ক্ষেত্রে মা সামর্থ্যবান হলে তিনি অথবা তাদের পক্ষ থেকে দাদা-দাদি, নানা-নানি আকিকা আদায় করবেন। (আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : ৩০/২৭৭)
তবে অনেকের ধারণা, আকিকার জন্তু নানার বাড়ি থেকে আসতে হয়। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়।
আকিকার পশুর সংখ্যা: নির্ভরযোগ্য মত অনুযায়ী, ছেলেসন্তানের পক্ষ থেকে একই ধরনের দুটি ছাগল ও মেয়ের পক্ষ থেকে একটি ছাগল আকিকা করা সুন্নত। (ফাতাওয়ায়ে শামি : ৬/৩৩৬)
হজরত উম্মে কুরজ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘ছেলের জন্য এক ধরনের দুটি ছাগল এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল আকিকা করবে। (আবু দাউদ : ২৮৩৪) তবে ছেলের পক্ষ থেকে একটি ছাগল আকিকা করলেও মুস্তাহাব আদায় হয়ে যাবে। যদিও দুটি করা উত্তম। (রদ্দুল মুহতার : ৫/২১৩, আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : ৩০/২৭৭)
হযরত উম্মে কুরয (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আকিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, পুত্রসন্তানের পক্ষ থেকে দুটি ছাগল আর কন্যাসন্তানের পক্ষ থেকে একটি ছাগল জবাই করবে। (জামে তিরমিযী ১/১৮৩)
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.)-এর পক্ষ থেকে একটি একটি ভেড়া আকীকা করেছেন। (আবু দাউদ ২/৩৯২)
আকিকার পশুর ধরন: যেসব জন্তু দিয়ে কোরবানি শুদ্ধ হয় না, সেসব জন্তু দিয়ে আকিকাও শুদ্ধ হয় না। তাই আকিকার ক্ষেত্রে জন্তুর বয়স ও ধরনের দিক থেকে কোরবানির জন্তুর গুণ পাওয়া যায়, এমন জন্তুই নির্বাচন করতে হবে। (তিরমিযি : খ. ৪, পৃ. ১০১)
কোরবানির জন্য যেসব পশু উপযুক্ত, আকীকার ক্ষেত্রেও সে ধরনের পশু জবাই করার নিয়ম। অর্থাৎ ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ বা উট দ্বারা আকিকা করতে হবে।
কোরবানির জন্তুর সঙ্গে আকিকা করা: কোরবানির জন্তুর সঙ্গে আকিকা করা বৈধ। একটি পশুতে তিন শরিক কোরবানি হলে সেখানে আরও দু-এক শরিক আকিকার জন্যও দেওয়া যেতে পারে। তদ্রূপ কোরবানির মতো একই পশুতে একাধিক ব্যক্তি শরিক হয়ে আকিকা আদায় করতে পারবে। (দুররুল হুক্কাম : ১/২৬৬) বড় পশু—অর্থাৎ গরু, মহিষ, উট ইত্যাদিতে ছেলের জন্য এক শরিক আকিকা দিলেও তা আদায় হয়ে যাবে। কোরবানির সময়ও (জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ) আকিকা করা যায়।
আকীকার গোশতের হুকুম: এটি কোরবানির গোশতের মতোই। কাঁচা ও রান্না করা উভয়টিই বণ্টন করতে পারবে। সর্বস্তরের লোক তা খেতে পারবে। এমনকি নিজের মা-বাবা, নানা-নানি, ধনী-গরিব সবাই নিশ্চিন্তে আকীকার গোশত খেতে পারবে। (ফাতাওয়ায়ে শামি : ৬/৩৩৬)
এ গোশত তিন ভাগ করে এক-তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনদের জন্য সদকা করে দেওয়া, এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বণ্টন করা এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ নিজের জন্য রাখা সুন্নত অথবা পুরোটা বণ্টন করা বা নিজের জন্য রাখাও বৈধ।
এ ব্যাপারে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, আকিকার গোশত নিজেরাও খাবে এবং সদকাও করবে। আকিকার পশুর চামড়ার বিক্রয়লব্ধ টাকা গরিব-মিসকিনদের মধ্যে দান করে দেবে। আকিকার গোশত রান্না করেও বণ্টন করা যায়, আবার দাওয়াত দিয়ে লোকজনকে খাওয়ানোও জায়েজ আছে।