ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মত্যাগ কি বৃথা যাবে
---
বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সমাজের তলা থেকে চূড়ায় উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু এই যে উত্তরণ সেখানে কোনো উল্লম্ফন নেই। নেই কোনো প্রকার শঠতা, চাতুর্য কিংবা চাটুকারিতার পৃষ্ঠপোষকতা। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে পা রেখে তাঁকে উঠে আসতে হয়েছে। উত্তীর্ণ হতে হয়েছে একের পর এক অগ্নিপরীক্ষায়। স্বীকার করতে হয়েছে অপরিসীম ত্যাগ। এ প্রসঙ্গে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, শুধু ব্রিটিশ শাসনামলেই তাঁকে ৫ বার কারাবরণ করতে হয়েছে। একতরফা বিচারে কারাভোগ করতে হয়েছে দিনের পর দিন। পরিতাপের বিষয় হলো, যে-স্বাধীনতার জন্যে তিনি এতো ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেই স্বাধীন পাকিস্তানেও বিনাবিচারে জেল খাটতে হয়েছে তাঁকে। মাথা পেতে নিতে হয়েছে গৃহবন্দিত্বের দুঃসহ দুর্ভোগ। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে আমৃত্যু তাঁকে বহন করতে হয়েছে পদে পদে লাঞ্ছনা আর অপমানের দুর্বহ যন্ত্রণা। বাকি ছিল শুধু নিজের জীবন। সেটাও তিনি উৎসর্গ করে গেছেন স্বদেশের স্বাধীনতার বেদিমূলে। একা নন, সঙ্গে ছিলেন কনিষ্ঠ পুত্র দিলীপ দত্তও।
আনিসুজ্জামানের এ-মূল্যায়ন যথার্থ যে : স্রোতকে যেমন আলাদা করা যায় না নদীর থেকে, তেমনি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের (১৮৮৬-১৯৭১) নাম পৃথক করা যায় না বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে। সে-ইতিহাসের আগের যে-ইতিহাস, সেই পর্বেরও এক শক্তিমান চরিত্র তিনি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী সংগ্রামের সৈনিক, পাকিস্তান-রাষ্ট্রে বাংলাভাষার মর্যাদা-প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রবর্তক, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বাপ্নিক। এর প্রতিটি পর্যায়ে নিজের বিশ্বাস ও কর্মের জন্যে মূল্য দিয়েছেন তিনি; সর্বাধিক মূল্য দিয়েছেন ১৯৭১-এর মার্চে। তখন তিনি নিজের হাতে কুমিল্লার বাড়িতে তুলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তার কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর রক্তে সিঞ্চিত হয়েছিল বাংলাদেশের মাটি। তাঁর আর সকল কাজের মতো সে আত্মদানও বৃথা হয়নি। যে-মাটিতে বোনা হয়েছিল স্বাধীনতার বীজ, সে-মাটি উর্বর হয়েছিল তাঁর রক্তে; ফসল ফলতে দেরি হয়নি।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর ভারতীয় পার্লামেন্টে একটি শোকপ্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে তিনি এমন একজন নেতা যাঁকে নিয়ে যে-কোনো জাতি গর্ব করতে পারে। কথাটি একটুও অতিরঞ্জিত নয়। পরাধীন ভারতবাসীর স্বাধীনতার জন্যে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। লড়েছেন পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধেও। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কাটিয়ে দিয়েছেন কারার অন্তরালে। সাধারণ পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে সর্বভারতীয় নেতাদের সারিতে ঠাঁই করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর অতুলনীয় ত্যাগ, নিষ্ঠা ও অনাড়ম্বর জীবনাদর্শের কারণে। ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্যে পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি যে অসামান্য যুক্তি তুলে ধরেছিলেন তা আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মূলত তাঁর এ-প্রস্তাবকে কেন্দ্র করেই বায়ান্নোর সেই মহাবিস্ফোরণের ক্ষণগণনা শুরু হয়ে যায়। তবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যদি এ-প্রস্তাব উত্থাপন নাও করতেন- তবু নির্লোভ, নিরহঙ্কার ও অসামান্য মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকতেন।
খুবই নিরীহ একটি প্রস্তাব এবং কোনো আড়ম্বর ছাড়াই তা উত্থাপিত হয়েছিল। যাদের স্বার্থে এটা করা হয়েছিল, সেই পূর্ব বাংলাবাসীও এ প্রস্তাব-সম্পর্কে পূর্বে তেমন একটা অবহিত ছিলেন না। এমনকি দলীয়ভাবেও এটি উত্থাপিত হয়নি; ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্ব-উদ্যোগে, স্বতঃপ্রণোদিতভাবে, এটি উত্থাপন করেছিলেন। সেদিন সম্ভবত একমাত্র পাকিস্তানি শাসকবর্গ ছাড়া আর কেউই অনুধাবন করতে পারেননি এই প্রস্তাবের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান গণপরিষদে উত্থাপিত মাত্র দুই লাইনের সেই সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছিল :
“That is sub-rule (1) of rule 29, after the word `English` in line 2, the words `or Bengali` be inserted.”
দু’দিন পরে, ২৫ ফেব্রুয়ারি, উক্ত সংশোধনী প্রস্তাবের স্বপক্ষে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্য উপস্থাপিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা পাকিস্তান গণপরিষদে প্রচণ্ড বিষ্ফোরণ ঘটায়। ক্ষুব্ধ প্রতিপক্ষের বাক্যবাণে ভয়ানকভাবে আক্রান্ত হন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কংগ্রেস দলীয় সদস্যগণ ছাড়া বাদবাকি সকলেই এই আক্রমণে শরিক হন। পাকিস্তান নামক সদ্যোজাত রাষ্ট্রটির তথাকথিত গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার স্বচ্ছ নেকাবটি খসে পড়ে। উন্মোচিত হয়ে পড়ে তার আসল চেহারা- যা আমরা একাত্তরে দেখেছি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাবটি সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে অগ্রাহ্য হলেও, বস্তুত এর মধ্য দিয়েই রোপিত হয়ে গিয়েছিল আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার বীজ।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিঃসন্দেহে ‘আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। সর্বোপরি, মহত্ত্বের তপস্যায় সমর্পিত সত্যিকারের এক বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর বড়ো হয়ে ওঠার কাহিনীটিও পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে অনুসরণীয় এক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অতি সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্ম। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত এখানেই লেখাপড়া করেছেন। প্রবেশিকা পাশ করার পর কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। নানা কারণে এটা তাঁর জীবনের মোড় পরিবর্তনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রথমত, অবিভক্ত ভারতের রাজধানী হিসেবে তখন কলকাতাই ছিল সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। দ্বিতীয়ত, রিপন কলেজে তিনি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ এমন কিছু ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ এবং অসাধারণ মেধাবী শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন যারা তাঁকে শুধু রাজনীতির সেই প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগই করে দেননি, একই সঙ্গে নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তাঁর জীবনের গতিপথও। পারিবারিক কারণে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে। প্রথমে জগন্নাথ কলেজ ও পরে কুমিল্লা কলেজে এসে থিতু হয়েছিলেন। অবশ্য বিএ পড়ার জন্যে আবার কলকাতা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। রিপন কলেজ থেকেই বিএ এবং আইন পরীক্ষায় পাশ করেন। সংক্ষেপে এই হলো তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। ছাত্র হিসেবেও তাঁকে কোনোভাবেই অসাধারণদের পর্যায়ভুক্ত করা যাবে না। তবে শিক্ষার প্রয়োজনে এবার কলকাতায় তাঁর অবস্থানকাল কিছুটা দীর্ঘ হয়েছিল। তাঁর জীবনে এ-সময়টার গুরুত্ব ও তাৎপর্য যে অসাধারণ তাতে সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেও সচেতন ছিলেন :
১৯০৬ হইতে ১৯১০ সন আমার কলিকাতার ছাত্রজীবনে, তৎকালীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি সন্ধিক্ষণ। কংগ্রেসের মধ্যে নরমপন্থী ও উগ্রপন্থী- দুই দল গড়িয়া উঠিয়াছে। উগ্রপন্থীদের নেতা ছিলেন বালগঙ্গাধর তিলক, বাংলাদেশের বিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষ আর নরমপন্থীদের নেতা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি।
কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি শুধু স্বাধীনতার মন্ত্রেই উদ্বুদ্ধ হননি, সেই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন সক্রিয়ভাবে। নিয়মতান্ত্রিক পথে যে দেশকে স্বাধীন করা যাবে না তা নিয়ে তাঁর মধ্যে দ্বিধা ছিল না। কিন্তু প্রবল প্ররোচনা সত্ত্বেও অনিয়মতান্ত্রিক পথে পা বাড়াননি। যোগ দেননি উগ্রপন্থীদের দলে। তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘নরমপন্থী’ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী মহাত্মা গান্ধীর পথ।
তাঁর কর্মজীবনও শুরু হয়েছিল সাদামাটাভাবে। শিক্ষাজীবন শেষে কলকাতা থেকে ফিরেই তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঙ্গরা উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। তবে তাঁর শিক্ষকতা জীবন এক বছরও স্থায়ী হয়নি। এরপর যোগ দেন ‘ওকালতি ব্যবসায়’। কুমিল্লা বারে ১৯১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইনজীবী হিসেবে যে-কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, রাজনৈতিক ও কারাবাসজনিত বিরতি বাদ দিলে তা অব্যাহত ছিল ১৯৭০ সাল অবধি। দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর তিনি আইন পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। জীবিকার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি বাদ দিলে এ পেশাটিকেও তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর ব্রত পালনের মাধ্যম হিসেবে। আগেই বলা হয়েছে যে, জনসেবার মধ্য দিয়ে বিশ্বমানবের কল্যাণসাধনই ছিল তাঁর জীবনের মূল ব্রত। আইন পেশার মধ্য দিয়ে খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তা পালন করে গেছেন আজীবন। সেই সঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও তিনি করেছেন। সেটি তাঁর ভাষায় : জীবনের শান্তি নির্ভর করে সমস্ত বিরোধের শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিষ্পত্তির উপর। সেই জন্য আমি প্রত্যেক মোকদ্দমায় আপস নিষ্পত্তি করিতে চেষ্টা করিয়াছি, আর এই চেষ্টায় আমি সফল হইয়াছি।
ব্রত পালনের মূল্যও দিতে হয়েছে তাঁকে। ভালো আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও আমৃত্যু অর্থকষ্টে ভুগেছেন। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধু আর্থিক অনটনের কারণে মৃত্যুর মাত্র একমাস আগে পর্যন্ত নিয়মিত আদালতের কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনাও জাঁকজমকপূর্ণ নয়। জওহরলাল নেহরুর মতো পারিবারিক ঐতিহ্য কিংবা মহাত্মা গান্ধীর মতো পেশাগত খ্যাতি কোনোটাই তাঁর ছিল না। বলা যায়, একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল তাঁকে। তৃণমূল পর্যায়ের নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে উদ্দীপনামূলক পত্রপত্রিকা পাঠ করেছেন, নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শোনার জন্যে ‘নির্দিষ্ট সময়ের ৩-৪ ঘণ্টা পূর্বে সভাস্থলে উপস্থিত থেকেছেন, দলীয় সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সব কিছু ছেড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কংগ্রেসের আদর্শ প্রচার করেছেন মাসের পর মাস। প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। দলের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন, কারাভোগ করেছেন, কিন্তু কর্তব্য থেকে পিছপা হননি কখনোই। তাঁর দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের শুরু এভাবেই।
তারপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কুমিল্লা পৌরসভা থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইনসভা পর্যন্ত যতো নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়েছেন- নানা ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও একটি ছাড়া সব নির্বাচনেই তিনি জয়ী হয়েছেন। এর কারণ তিনি নিঃস্বার্থভাবে সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতেন। তাদের নাড়ির ও হাঁড়ির খবর রাখতেন। সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় তাঁদের সেবা করাকেই অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে জ্ঞান করতেন। জনগণ বরাবরই তাঁর সেই ভালোবাসার যথাযথ প্রতিদান দিয়ে এসেছে। জনগণের এই আস্থা ও ভালোবাসাই ছিল ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সবচেয়ে বড়ো শক্তি। অবিভক্ত ভারতে ও পাকিস্তানে একাধিকবার আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন; আইনসভার ডেপুটি লিডার ছিলেন; পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হিসেবে শাসনতন্ত্র প্রণয়নসহ পালন করেছেন বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব; প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনৈতিক সংস্থা (NEC) এর হাতে গোনা ভাগ্যবান সদস্যদের একজন ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, নিজের অনন্যতার দ্যুতিও ছড়িয়েছেন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। বিশেষ করে অভিজ্ঞ ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে দলমত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে একজন বিদেশি লেখক মন্তব্য করেছেন, ‘Ôa man described by his colleagues as the Burke of Pakistan Parliament’- মন্তব্যটি অযথার্থ নয়।
আগেই বলা হয়েছে যে, মাতৃভূমির মানুষের প্রতি প্রবল ভালোবাসা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের চরিত্রের একটি উজ্জ্বলতম দিক। এর জন্যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু এ নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপ বা অনুশোচনা ছিল না। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের ডেপুটি লিডার। ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের একজন। দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেলে উচ্চপদে আসীন হতে পারতেন, পেতেন উপযুক্ত সম্মান ও স্বীকৃতি। অন্যদিকে, ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান যে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবাবিক নিরাপত্তার জন্যেও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে তা তিনি জানতেন। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ, তাঁর ভাষায় :
… ত্রিপুরা জেলার জনগণ আমার অত্যন্ত প্রিয়। পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিপুরা জেলার হিন্দু-মুসলমান খ্যাত-অখ্যাত বহু কর্মী পল্লী অঞ্চলে ছড়াইয়া রহিয়াছে। তাহারা প্রকৃত প্রস্তাবে আমার পরিবারভুক্ত। তাহাদিগকে ছাড়িয়া আমি যাইতে পারিব না। সমস্ত বিপর্যয়ের ভিতর এই বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর প্রাক্কালে এই মনোভাব প্রতিষ্ঠিত।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পরেও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের অনেকেই দেশ ছেড়ে গেছেন প্রাণভয়ে। তখনও তিনি দেশত্যাগের কথা একবারও ভাবেননি। বরং বরাবরের মতোই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্নকে ছাপিয়ে উঠেছে তাঁর কর্তব্যবোধ। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন :
…যাহাই ঘটুক না কেন, হিন্দু সমাজের বহুসংখ্যক লোক পাকিস্তান ছাড়িয়া যাইতে পারিবে না। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে জাগিল, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সংস্রবহীন থাকিয়া, নিরপেক্ষ থাকিলে কর্তব্যের ত্রুটি হইবে। কারণ আমি চাই জনগণের আকাঙ্ক্ষিত শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হউক।
একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যাযজ্ঞের পর যখন দলে দলে লোক দেশ ছেড়ে যাচ্ছে, তখনও তিনি দেশত্যাগে সম্মত হন নি একই কারণে। সপুত্র জীবন দিয়েই তিনি মাতৃভূমি ও মাতৃভূমির মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধের অনবদ্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। সন্তের মতো এ-সন্তানরা ছিলেন বলেই আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। পেয়েছি বিশ্বসভায় স্থানলাভের অনন্য মর্যাদা। কিন্তু আমরা যে তাঁদের জীবন ও আদর্শ থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করিনি তার প্রমাণ রামু, তার প্রমাণ নাসিরনগর। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ চোখ-ধাঁধানো আলোর নিচেও যখন অন্ধকারের উদ্বাহু নৃত্য দেখতে হয় প্রতিনিয়ত, তখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো মানুষের শূন্যতা আরও বেশি করে বাজে।