বৃহস্পতিবার, ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ইং ১১ই ফাল্গুন, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

২১ শে ফেব্রুয়ারী ও অমর একুশে গ্রন্থমেলা

AmaderBrahmanbaria.COM
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬

Phootoআলহাজ্ব মোঃ নূরুজ্জামান (বীর মুক্তিযোদ্ধা)
কোন জাতির জাতিসত্তা ও কৃষ্টি-কালচারের সাথে সেই জাতির সহিত্য উৎপ্রোত ভাবে জড়িত। মানুষ নিজের ভাব কল্পনাকে বহুরূপ পরিগ্রহ করিয়ে তার মার্ধুয উপভোগ করতে চায়। এভাবে আত্ম প্রকাশের জন্য মানুষের মনে তীব্র আকাঙ্খার জম্ম নেয়। মানুষের এ আত্মপ্রকাশের বানীবদ্ধ রুপই হয়ে উঠে সাহিত্য।
অন্য সব কিছুর মত ভাষাও জম্ম নেয়, বিকশিত হয়, রুপ বদলায় কালে কালে। আবার কালের গর্ভে হারিয়েও যায়। আজ যে ভাষায় আমারা কথা বলি, কবিতা লিখি, গান গাই, অনেক আগে এ ভাষা এ রকম ছিল না। হাজার বছর ধরে ক্রম পরিবর্তনের ফলে বাংলা ভাষা বর্তমান রুপ ধারন করেছে। যে প্রাচীন ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জম্ম হয়েছে, তার নাম প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা।
স্বাধীনতা (পাক-ভারত) তখনো আসেনি এবং পাকিস্তানের কোন সরকারই গঠিত হয়নি, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে তখনই আলোচনা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ৩ রা জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষনার সময় ভাবে পূর্ববঙ্গ সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত লেখক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিরাট অংশই ছিলেন কলকাতায়। তখন পাকিস্তানের সমর্থক দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্র-পত্রিকায় এবং বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত লেখক ও সাংবাদিকরাও ছিলেন ঐ মহানগরীতে। বামপন্থী মুসলিম তরুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী (নেতৃস্থানীয় প্রধান অংশ) ছিলেন সেখানেই। বস্তুত কলকাতা তখন শুধু অখন্ড বাংলাদেশের নয়, কিছুদিন খন্ডিত পূর্ববাংলারও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানীর ভুমিকায় ছিল(আগষ্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত)। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষনার পর পরই আসন্ন পাকিস্তানের বিভিন্ন সমস্যা তাদের দৈনন্দিন উত্তেজনাময় আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। এই সব আলোচনার একটা প্রধান বিষয় ছিল রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্ন। কেননা ইতিমধ্যেই প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল যে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চলছিল। ১৯৪৭ সালের ৩০ শে জুন ‘দৈনিক আজাদ’-এর সম্পদকীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। সূচনায় বলা হয়ঃ-
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা এখন স্থির করার সময় এসেছে। যে ভাষাকেই আমরা রাষ্টভাষা হিসাবে গ্রহণ করি, তার আগে আমাদেরে বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে- ‘কোন ভাষায় পাকিস্তানে বেশী সংখ্যক লোক কথা বলে,পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠভাষা কোনটি , কোন ভাষায় সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যে সৃষ্টি হয়েছে এবং কোন ভাষা ভাব প্রকাশের পক্ষে সব থেকে বেশী উপযোগী। যেদিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবীই সবচেয়ে বেশী……… এর মধ্যে র্স্বাথ যদিও কিছু নেই, তবু এখানে স্পষ্ট করেই বলা প্রয়োজন বোধ করছি যে, কেবল র্পূব পাকিস্তানের জন্যই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানসহ সমগ্র পাকিস্তানেই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবী এবং যোগ্যতা সবচেয়ে বেশী বাংলা ভাষার।
এরপর উর্দুর প্রশ্ন আলোচিত হয়। উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে এমন কথা কেউ কেউ বললেও সরকারীভাবে বলা হয়নি। স্বাধীনতা তখনো আসেনি। কিন্তু বহু বছরের উর্দু হিন্দী বিরোধ এবং মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সংগঠন ও স্বরূপের কথা স্মরন করে বাঙ্গলী বুদ্ধিজীবি সমাজ অনুমান করতে পেরেছিলেন (এ ধরনের কথা তখন রটে ও ছিল) যে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু সেটা হবে অসঙ্গত। পাকিস্তানে বাঙ্গালীর চেয়ে উর্দুর ভাষীর সংখ্যা বেশী নয় এবং ‘‘ভাষাগত উৎকর্ষ ও সাহিত্য সৃষ্টির দিক থেকে উর্দু চেয়ে বাংলা ভাষাই শ্রেষ্টতর। তাসত্ত্বে উর্দু রাষ্ট্রভাষা ঘোষিত হলে ইংরেজীর স্থান নেবে উর্দু। ইংরেজী না জানা যেমন সরকারী চাকরীর জন্য অযোগ্যতা, উর্দু না জানা তেমনি অযোগ্যতা বলে গন্য হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচ কোটি লোক সরকারী চাকরীর অনপযুক্ত হয়ে পড়বে।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়েছে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করলে আমাদের সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নতি শুধু ব্যাহত হবে না, রুদ্ধ হয়ে যাবে। কেননা ইংরেজ আমলে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব যেমন পড়েছে বাংলা ভাষা ও সহিত্যের উপর পাকিস্তান আমলেও তেমনি প্রভাব পড়বে উর্দু ভাষা ও সহিত্যে কিন্তু ইংরেজী-বাংলার চেয়ে শ্রেষ্টতর ভাষা ও সাহিত্য উর্দু নয়। যে সাহিত্য শ্রেষ্টতর নয়, তার প্রভাব পড়বে শ্রেষ্টতর সাহিত্যের উপর এবং তার ফলে বাংলা সাহিত্য লাভবান না হয়ে বরং ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারুপে বরন করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকতে পারে না। আরবরা যখন মিশর জয় করে, মিশরবাসী তখন কপটিক ভাষায় কথা বলত। কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর প্রচন্ড তাড়নায় কপটিক ভাষার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। আরবীই সেই আসন গ্রহণ করে। আজ কপটিক ভাষা মৃত। তার রূপ নির্নয় ভাষাতত্ত্বের গবেষনা সাপেক্ষ। আর মিশরবাসী অকাতরে আরবী ভাষা বলে চলছে। কোনো ভাষার মৃত্যু হয় কখন? যখন সে ভাষার সঙ্গে বৃহৎ জনপ্রবাহের বিচ্ছিন্নতা ঘটে।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ অগষ্ট পাকিস্তানের পূর্ব অংশ (বর্তমানে বাংলদেশ)ও পশ্চিম অংশের মাঝে দূরত্ব ছিল ১১০০ (এগারশত) মাইল। স্থল যোগাযোগের বিচ্ছন্নতা বিশাল দুরত্ব এবং ভাষা ও ঐতিহ্য গত পার্থক্য থাকায় দুই অংশের মধ্যে অসন্তোষ ও পূর্ব অংশের উপর পশ্চিম অংশের নগ্ন খবরদারী ক্রমান্বয়ে তীব্র হতে তীব্রতর হতে থাকে। সকল সম্পদের উপরই পশ্চিমারা একচ্ছত্র ভোগে প্রত্যয়ী হয়ে উঠে। এই একচ্ছত্র ভোগ ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দিনে দিনে গড়ে উঠে ক্ষোভের পাহাড়। আর এই ক্ষোভের সার্বিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৫২-এরভাষা আন্দোলনে। ১৯৫১ সালে জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৫৪.৬% এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৪৫.৪%। তন্মধ্যে উর্দুভাষী লোকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭.২%। ১৯৫১ সালে ভাষার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জনতার শতকরা হার ছিল নিম্নরূপ:-
বাঙালী  ৫৪.৬
পাঞ্জাবী  ২৮.৪
পশ্তু  ৭.১
হিন্ধী  ৫.৮
উর্দু  ৭.২
ইংরেজী  ১.৮
(মোট ১০৫.১, কারন অনেকেই নিজেদের দ্বিভাষী বলে জানিয়েছিলেন)
উর্দু পাকিস্তানের বিশেষ অঞ্চলের ভাষা ছিল না। পাকিস্তানের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা ভাষাই ছিল সর্বাপেক্ষা উন্নত। সংখ্যা গরিষ্ঠের দাবীকে উপেক্ষা করে সংখ্যা লঘিষ্ঠের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন পাক সরকার। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের গনপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ইংরেজী ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে গনপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হবার পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে কার্জন হলে এক ভাষনে বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের  রাষ্ট্রভাষা তখন প্রতিবাদী কন্ঠে বাঙালী ছাত্র-জনতা বলেছিলেন’ না না না.
ভাষা আন্দোলনে ’৫২-এর অমর একুশে ফেব্রুয়ারীতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, প্রমুখের আত্মত্যাগের মাধ্যমে পাকিস্তান বিরোধী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠে এবং প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালীর স্বাধীনতার আন্দোলনের সূচনা হয়। মাতৃভাষার শ্রদ্বা প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালী জাতির এমনিভাবে জীবন উৎসর্গ করা বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বাঙালী জাতির ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট র্নিবাচন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গনঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারন নির্বাচন ও জাতির জনক বঙবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং মহান মুক্তিুযদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছে কাঙ্খিত স্বাধীনতা। কাজেই বাঙালীর জাতিসত্তা ও অস্তিত্বের শেকড় ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই প্রোথিত।
ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল হিসেবে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৬ নং দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের ৩, ডিসেম্বর গড়ে উঠে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষনামূলক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী। ‘বাংলা একাডেমী’ বাংলা ভাষা, সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরনে প্রবর্তন করেছে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। শুধুমাত্র গ্রন্থকে উপলক্ষ্য করে মাসব্যাপী এমন মেলার দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। এটি আমাদের জন্য পরম আনন্দের, অতি গৌরবের। বই মেলার চিন্তাটি এদেশে প্রথমে মাথায় আসে প্রয়াত সাহিত্যিক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েন-উদ-দীনের। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীর (বর্তমানে ঢা: বি: লাইব্রেরী) নীচতলায় একটি শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। বাংলা একাডেমীর বর্তমান মহাপরিচালক জনাব শামসুজ্জামান খান-এর বক্তব্য হতে জানা যায় এটাই ছিল পূর্ব বাংলার প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ ইং সালে। ১৯৭০ ইং সালে তারই(জয়েন উদ্দীন সাহেবের প্রচেষ্ট্য়া নারায়নগঞ্জ ক্লাবের সহযোগীতায় নারায়নগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। উহাতে অনেক প্রকাশক বইয়ের দোকান সাজিয়েছিলেন। বেচা-কেনাও মন্দ ছিল না। উহাতে রঙ্গরসপূর্ণ শিক্ষামূলক বিষয়ও ছিল। মেলার ভিতরে একটি গরু বেঁধে রেখে উহার গায়ে লিখে দিয়েছিল ‘আমি বই পড়ি না’। জয়েন-উদ-দীন সাহেবের এই উদ্ভাবন দর্শকদের মধ্যে অনেক সাড়া সৃষ্টি করেছিল। এখানেই সরদার জয়েন-উদ-দীন থেমে থাকেন নি। ১৯৭২ ইং সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে একটি আন্তর্জাতিক বই মেলার আয়োজন করেন। ইউনেসকো (টঘঊঝঈঙ) এই বৎসরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থ বর্ষ’ হিসেবে ঘোষনা করে। সেই থেকেই বাংলা একাডেমীর বই মেলার সূচনা। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মেলার উদ্বোধন করেন। এই মেলার স্লোগান ছিল – ‘সবার জন্য বই’।
১৯৭২ ইং সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমীর একুশে অনুষ্ঠানে কোন বই মেলা হয় নি। তবে বাংলা একাডেমীর প্রাচীরের বাইরে স্ট্যান্ডার্স পাবলিসার্সের রুহুল আমিন নিজামী, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনী কিছু বইয়ের দোকান সাজিয়ে বসেন। মুক্তধারা প্রকাশনী ও বর্ণমিছিল ওভাবেই তাদের কিছু বই নিয়ে বসেন।
১৯৮৪ ইং সালে কাজী মনজুরে মাওলা যখন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক তখন তিনি বাংলা একাডেমীতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থ মেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। শ্লোগান নির্ধারন করা হয় ‘একুশে আমাদের পরিচয়’। কিন্ত শিক্ষা ভবনের সামনে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দু’জন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বই মেলা করা সম্ভব হয় নি।
১৯৮৪ ইং সালে আড়ম্বরপূর্ণভাবে বর্তমানের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়’। এরপর প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারন করে। মেলা উপলক্ষ্যে বিপুল সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়। বলা চলে এই মেলা উপলক্ষ্য করেই বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে। অনেক নূতন প্রকাশক এই শিল্পে এসেছেন। পাঠকের সংখ্যাও এখন অনেক এবং প্রতিবছরই বাড়ছে। এই মেলা এক মাস ধরে চলে। পৃথিবীতে আর কোন বইমেলা এতদিন ধরে চলে না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এটি পৃথিবীর দীর্ঘদিনব্যাপী আয়োজিত একটি বইমেলা।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৬০ বছর ধরে বাংলা একাডেমী ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষনা এবং বাঙালী সংস্কৃতি চর্চায় অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। বাঙালী জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতিক হয়ে উঠে। নবম জাতীয় সংসদে ‘বাংলা একাডেমী আইন-২০১৩’ পাশ হয়। এই আইনের মাধ্যমে বাংলা একাডেমীর কার্য পরিধি বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বাঙালীর চিরন্তন উৎসবের রূপটি ফুটে উঠে। জাতি, ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের আগমন ঘটে এই মেলায়। মাসব্যাপী গ্রন্থ প্রকাশ ও ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াও মেলামঞ্চে আয়োজিত হয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের পরস্পর মতবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অমর একুশে গ্রন্থমেলা জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রসরতা নিশ্চিত করে। স্বাধীন বাংলা দেশে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সম্মেলনের দ্বার উন্মোচন করে মুক্ত চিন্তা এবং বিশ্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি বাঙালীর উদার মনোভাবের পরিচয়টি তুলে ধরেছিলেন। এ বছর (২০১৫) বাংলা একাডেমী আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রথম চারদিন ‘আন্তজার্তিক সাহিত্য সম্মেলন-২০১৫ এর আয়োজন’ এ মেলাকে বিশেষভাবে তাৎপর্যমন্ডিত করেছে। আমাদের প্রত্যাশ্যা সাহিত্য সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ভাষার চল্লিশের অধিক লেখক সমাগম বাংলা ও সমকালীন বিশ্ব সাহিত্যের মেলবন্ধনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
এরই মধ্যে ১৯৯৬ ইং সালে প্রবাসী বাঙালীদের সহায়তায় এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় একুশে ফেব্রুয়ারী ইউনেসকো (টঘঊঝঈঙ) কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
অমর একুশের চেতনাকে সমুজ্জল রেখে জাতিকে আগামীর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নানামুখী কর্মকান্ডের বিস্তার ঘটায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের জাতীয় জীবনে এক আনন্দ যোজনা। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, দেশের মানুষ বাংলা একাডেমীর একুশের গ্রন্থমেলার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে। দেশে যেমন লেখক ও প্রকাশকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে এই বইমেলার পরিসর। ২০১৪ ইং সালে গ্রন্থমেলার উপর্যুপরি ভীড়কে সামাল দিতে বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গন ছাড়িয়ে মেলা ছড়িয়ে পড়েছিল ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এ বছর (২০১৫ সালে) ওই উদ্যানেই মেলার ক্ষেত্রকে আরো সম্প্রসারিত ও আকর্ষনীয় করা হয়েছে। নানা ভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এই স্থানেই জাতির জনককে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। এই স্থান খেকেই ১৯৭১ ইং সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙ্গালির মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের দলিল ও এই উদ্যানেই স্বাক্ষরিত হয়। আরো রয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ, শিখা চিরন্তন, মুক্তিুযদ্ধের মোরাল ও স্বাধীনতা যাদুঘর। এই ঐতিহাসিক উদ্যানের চারিদিকে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছে। যেমন উহা বেষ্ঠিত রয়েছে  শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় যাদুঘর, গন গ্রন্থাগার, কারু ও চারুকলা প্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, টিএসসি, বাংলা একাডেমী ও শিশু একাডেমী দ্বারা।
ড: মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘কোন জাতির উন্নতির মাপকাঠি তাহাদের ধনৈশ্বর্য কিংবা রত্ন সম্ভার নহে। সাহিত্যই তাহাদের উন্নতির ও গৌরবের একমাত্র পরিচায়ক। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল যেমন ‘বাংলা একাডেমী’, তেমনি বাংলা একাডেমীর শহীদদের নামাঙ্কিত ‘অমর একুশে গ্রন্তমেলা’ বাংলা ও ভাষা ও সাহিত্যের ক্রম বিকাশের এক মূর্ত প্রতিক।
এই মেলাটি এখন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্পসারিত হওয়ায় বাঙ্গালী জাতিসত্তার স্মৃতিবাহী একুশের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যুক্ত হয়ে এক নূতন আঙ্গিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও জাগরনের প্রতীকে পরিুুনত হয়েছে।

লেখক:- বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য ও সভাপতি, কৃষ্ণনগর আ: জব্বার স্কুল এন্ড কলেজ গভর্নিং বডি, নবীনগর, ব্রাহ্মনবাড়ীয়া।
=০=