গত সাড়ে ছয় মাসে ৭০ জন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে আর্থিক খাতে বড় জালিয়াতির হোতা হিসেবে পরিচিত অনেকেরই তারা নাগাল পায়নি। এ নিয়ে ব্যাংক খাতে একধরনের আতঙ্কও তৈরি হয়েছে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় জনতা ব্যাংকের দুই উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) গ্রেপ্তার হন। বিসমিল্লাহ গ্রুপের যে মামলায় দুই ডিজিএম গ্রেপ্তার হলেন, সেই একই মামলার অন্যতম আসামি মো. আবদুস সালাম আজাদ বর্তমানে জনতা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মামলা থাকা সত্ত্বেও সরকার তাঁকে পদোন্নতি দিয়েছে।
এদিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন তিন ব্যাংকের সাবেক তিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আসামি হলেও তাঁদের এখনো হেফাজতে নিতে পারেনি দুদক। তাঁরা হলেন সোনালী ব্যাংকের হুমায়ূন কবির, বেসিক ব্যাংকের কাজী ফখরুল ইসলাম ও অগ্রণী ব্যাংকের সৈয়দ আবদুল হামিদ। তবে এমডিদের নামে মামলা করা হলেও সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। যদিও দেশের ইতিহাসে এ দুটি সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা।
দুদকের হিসাব অনুযায়ী, নতুন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে নতুন কমিশন গঠিত হওয়ার পর ১৯৩ দিনে মোট ৩১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন ৭০ জন এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪১ জন।
দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছেন, তাঁদের অবশ্যই ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে হবে। আর ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে যাঁরা ঋণ দিয়েছেন, তাঁদের টাকা আদায় করে দিতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। অনুসন্ধান পর্যায়েই যে কাউকে গ্রেপ্তারের আইনি ক্ষমতা পেয়েছে সংস্থাটি। ক্ষমতার প্রয়োগও করছে তারা। দুদকের অভিযান নিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনাও রয়েছে। ব্যাংকাররাও রয়েছেন আতঙ্কে। গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনও রাজউকের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের সমালোচনা করেছেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘এবিবি ও ব্যাংক উদ্যোক্তারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দেখা করে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। এভাবে ভয়ভীতি দেখাতে থাকলে ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসবে, যার প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে। তবে যারা দোষী, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
তবে আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ খাতের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে অভিযান সুফল দেবে না। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার হলে সেই পর্যায়ে কিছুটা আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি হতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, দুর্নীতি করে সহজে পার পাওয়া যাবে না এবং যেকোনো সময় তাঁদের আইনের মুখোমুখি হতে হবে—এ বার্তা দুর্নীতিবাজদের কাছে পৌঁছে গেছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, দুর্নীতিবাজ যারা, তাদের আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তবে এসব অভিযানের নাম ভাঙিয়ে নামে-বেনামে কেউ যাতে চাঁদাবাজির সুযোগ না নিতে পারে, সেদিকে কমিশনকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
ব্যাংক খাতে কঠোর দুদক: অবৈধভাবে ঋণ দেওয়ার অভিযোগে গত ২৯ জুন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ওই দিন দুপুরে চলতি দায়িত্ব পেয়েই বিকেলে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হন ভারপ্রাপ্ত এমডি মিজানুর রহমান খান। পরে তিনি জামিন পান। একই মামলায় গ্রেপ্তার হন মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানও।
গ্রেপ্তারকৃত ব্যাংকারদের মধ্যে চাকরিচ্যুত ও অবসরপ্রাপ্তদের পাশাপাশি কর্মরতরাও রয়েছেন। রয়েছেন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার থেকে শুরু করে মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তারাও। উল্লেখযোগ্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের চাকরিচ্যুত অতিরিক্ত এমডি মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, প্রথম সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) ইফতেখার হোসেন; স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সাবেক এভিপি, বর্তমানে সিলেট শাখার ম্যানেজার হোসেন আহমদ; এবি ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ও ঋণ বিভাগের প্রধান, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জিএম (চুক্তিভিত্তিক) বদরুল হক খান; আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শওকত ইসলাম; ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এভিপি মো. ইনামুল হক; সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার মো. নুরুজ্জামান; সোনালী ব্যাংকের ভালুকা শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মো. একরামুল হক খান ও সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মো. আসাদুজ্জামান; রূপালী ব্যাংকের ঢাকার নবাবগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক ফরিদ আহম্মদ; অগ্রণী ব্যাংকের বংশাল শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মো. ফারুক আহমেদ প্রমুখ।
বড়রা নাগালের বাইরে
ব্যাংক ও আর্থিক খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া শুধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের পক্ষে ঋণ দেওয়া সম্ভব না। অথচ বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি, হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতির ঘটনায় আসামি হয়েছেন শুধু ব্যাংক কর্মকর্তারাই।
বেসিক ব্যাংকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্টতার কথা আলোচিত হলেও তাঁকে বাদ দিয়েই গত বছর ৫৬টি মামলা করে দুদক। ওই সব মামলায় ব্যাংকটির ২৭ জন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাকে আসামি করা হলেও পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি। বর্তমানে মামলাগুলোর অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান পর্যায়ে ৫ ব্যাংক কর্মকর্তাসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ জন। অথচ আবদুল হাই কিংবা পরিচালনা পর্ষদের কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হয়নি।
বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে আবদুল হাইয়ের দায় থাকার কথা বলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ব্যাংকটিতে ‘হরিলুটের পেছনে আবদুল হাই বাচ্চু জড়িত’ বলে একাধিকবার উল্লেখ করেন। তাঁকে আসামি না করায় একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে দুদককে কমিটিতে তলব করেন, যদিও দুদকের কোনো কর্মকর্তা হাজির হননি।
হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলামসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নাম ঘুরেফিরে এলেও তাঁদের বাদ দিয়েই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতিতে আসামি হয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তারাই।
বড় এই তিন কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের এমডিদের মধ্যে দুজন দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরেকজন জামিনে।
সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ূন কবিরের মেয়াদকালেই ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় এ ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটে। তবে এ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশের আগেই অবসরে চলে যান তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে হল-মার্ক জালিয়াতির জন্য তাঁকে প্রধানভাবে দায়ী করা হয়। দুদকের মামলায় তাঁকে অন্যতম আসামি করা হয়। এরপর দুদক, সোনালী ব্যাংক কেউই তাঁর খোঁজ করে পায়নি। তিনি বর্তমানে কানাডায় রয়েছেন বলে শোনা যায়।
ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে ২০১৪ সালের ২৫ মে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৫ সালে দুদকের করা ৫৬ মামলার ৪৮টিতেই তিনি আসামি। ব্যাংক থেকে অপসারণের পর থেকে তাঁকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন এবং তাঁকে মালয়েশিয়ায় দেখা গেছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদের ছয় বছর মেয়াদে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ হয়েছে দ্বিগুণ, মুনাফা কমেছে পাঁচ গুণ। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর গত ৯ জুলাই ছিল তাঁর শেষ কর্মদিবস। তবে এর ১০ দিন আগে তাঁকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সানমুন গ্রুপকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার ঘটনায় ২৯ জুন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ওই মামলায় ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত এমডি মিজানুর রহমান খান গ্রেপ্তার হলেও সৈয়দ আবদুল হামিদকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি দুদক। ২১ আগস্ট জামিন পান তিনি। ওই জামিন আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘জনগণের টাকা যারা লুটপাট করেছে, তাদের বিষয়ে আগের কমিশন কিছু করেনি। বর্তমান নেতৃত্ব যে এ বিষয়ে সক্রিয় হয়েছে, সে জন্য তাদের স্বাগত জানাই। আর্থিক খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে অবশ্যই এটি ভূমিকা রাখবে। তবে তাদের সতর্ক হতে হবে, অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। বড় বড় চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের আগে গ্রেপ্তার করতে হবে।’
মামলা ছাড়াই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা: এখন অনুসন্ধান পর্যায়েই সন্দেহভাজন যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে দুদক। আগে এ ক্ষমতা ছিল তদন্ত পর্যায়ে, অর্থাৎ মামলা হওয়ার পর। এ জন্য দুদক আইন, ২০০৪-এর দুটি ধারার সংশোধন করা হয়েছে। গত ২১ জুন সংশোধিত আইনের গেজেট প্রকাশ করা হয়। দুদক আইনে মামলার আগের প্রক্রিয়াকে বলা হয় অনুসন্ধান। আর মামলার পরের কার্যক্রমকে বলা হয় তদন্ত। নতুন এ আইনের ক্ষমতাবলে অনুসন্ধান ও তদন্ত দুই পর্যায়ে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) ক্ষমতা ভোগ করবেন।
সামগ্রিক বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি করলে যে আইনের মুখোমুখি হতে হবে, সেই বার্তা দুর্নীতিবাজদের দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এর মাধ্যমে দুদকের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষমতা অপব্যবহারেরও ঝুঁকিও আছে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আসা মানে তিনি অপরাধী না-ও হতে পারেন। তাই গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তারের যথার্থতা নিশ্চিত করা দুদকেরই দায়িত্ব। আইনিভাবে ওই ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণ করতে না পারলে দুদকের কর্মকাণ্ডও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।