প্রবৃদ্ধি বিতর্ক : সরকার-বিশ্বব্যাংক পরস্পরবিরোধী অবস্থানে
নিউজ ডেস্ক : দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক। সরকার বলছে, চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ, যা সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ০৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। অপরদিকে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের দাবির ব্যবধান দশমিক সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ। শতাংশের হিসাবে এ পার্থক্য সামান্য হলেও আর্থিক হিসাবে ব্যবধান বিশাল বলে অর্থনীতিবিদরা জানান।
দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় যুগান্তরকে বলেছেন, প্রবৃদ্ধি দাবি নিয়ে সরকারের পূর্বাভাস অবাস্তব। এক্ষেত্রে সত্যতার দিক থেকে বিশ্বব্যাংক এগিয়ে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, আমদানি কমে যাওয়া ও রফতানি বৃদ্ধির ফলে চলতি হিসাবে ইতিবাচক থাকবে। কিন্তু দেশের বাহ্যিক খাতে দুর্বলতা রয়ে গেছে। আমদানি মূল্য হ্রাস, করনীতি ও রাজস্ব প্রশাসনের দুর্বলতায় রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। আর রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ও বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদার দুর্বলতা সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
এদিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নতুন পূর্বাভাসে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘তাদের (বিশ্বব্যাংক) নানাজন নানা সময় নানান মত দেয়। সংস্থাটির প্রতিবেদন তারা নিজেরাই বিশ্বাস করে না। এমনকি সারাবিশ্বেও কেউ বিশ্বাস করে কিনা, আমার জানা নেই।’ এর আগের অর্থবছরগুলোতেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের আভাস না ফলার তথ্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘গ্লোবাল প্রসপেকটাস ২০১৫ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। পরে আবার কমিয়ে এখন বলছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এভাবেই তারা একেক সময় একেক ধরনের প্রাক্কলন করে, যা আসলে ঠিক হয় না।’
অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিতর্ক করলে তাতে কোনো আলো আসবে না, বরং তাপই ছড়াবে। আমরা কোনো ধরনের বিতর্কে যেতে চাই না। এতটুকুতে সন্তুষ্ট থাকতে চাই যে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ভালো হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির অন্যতম উপাদান ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ। গত বছর ছিল তা জিডিপির ২২ দশমিক ০৭ শতাংশ। কিন্তু এ বছর তা কমে ২১ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে প্রবৃদ্ধি কিভাবে বাড়ল তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। বিবিএস যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তার ডাটাগুলো আমরা বিশ্লেষণ করছি। এ নিয়ে আগামী ৩০ এপ্রিল আমরা বিস্তারিত জানাব।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সরকার বলছে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এটাকে কঠিন বললে উদার বিশ্লেষণ হবে। এটি একেবারে অসম্ভব এবং অবাস্তব। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ অর্জনের কথা বলছে এটাও প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, আমার এই মন্তব্য করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য মোট দেশজ উৎপাদনের ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু সরকারি হিসাবই বলছে বিনিয়োগ হচ্ছে ২৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
সোমবার রাতে দক্ষিণ সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস স্প্রিং ২০১৬ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। এতে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে জিডিপির তিন খাতের মধ্যে কৃষির প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ, শিল্পে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং সেবা খাতে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অর্থবছরের শুরুতে আমদানি, রফতানি, রেমিটেন্স, এডিপি বাস্তবায়ন, ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রভৃতি খাতে ধীরগতি চলছে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, গ্যাস সংকট, ব্যবসা করার উচ্চব্যয় বেশি। এছাড়া রাজনীতিতে অস্থিরতা না থাকলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। বেসরকারি বিনিয়োগেও গতি নেই। সব মিলিয়ে অর্থবছরের শুরুতে অর্থনৈতিক সূচকগুলো যতটা শক্তিশালী ছিল, নয় মাস পর তা আর বজায় থাকেনি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের শেষ তিন মাস ও চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বিবিএসের হিসাবে, চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ, শিল্প খাতে ১০ দশমিক ১ শতাংশ এবং সেবা খাতে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া চলতি অর্থবছর দেশে মোট জিডিপির ২৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে। গত অর্থবছর এ হার ছিল ২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খারাপ নয়। চীনেরও আগে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। এখন সেটা ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। সবমিলিয়ে বিশ্বের ১০ থেকে ১৫টি দেশ পাওয়া যাবে, যারা ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। আর এই ৬ শতাংশ থেকে কিভাবে বাড়ানো যায়, আমরা সেই চেষ্টা করছি। বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন তথ্যের ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রীর সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রীর বক্তব্য তার নিজস্ব ব্যাপার। এক্ষেত্রে আমার বা আমার প্রতিষ্ঠানের কোনো মন্তব্য নেই।
তবে তিনি বলেন, আমাদেরটিও শতভাগ সত্য তা বলছি না। কারণ আমরা যে সময়ে তথ্যগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেছি, ওই সময়ে সব সূচক দুর্বল ছিল। এ কারণেই কী কী ভিত্তিতে সরকার ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি কথা বলছে, তা আমরা বিশ্লেষণ করছি। এরপর বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত জানানো হবে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ আগের বছরের চেয়ে কমেছে। অন্যদিকে অর্থনীতির ৯টি সূচকের মধ্যে রফতানি ছাড়া কোনোটিতে উল্লেখযোগ্য হয়নি। তিনি বলেন, রফতানিতে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটি ইতিবাচক। অন্যসূচকগুলোর মধ্যে মূলধনী ও কাঁচামাল আমদানি কমেছে। রেমিটেন্স কমেছে। এছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়লেও তা খুবই সামান্য। তাই প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসকে আমি বাস্তব বলব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে প্রাক্কলন দিয়েছে সেটি আমার কাছে খুব বেশি মনে হয়েছে। আবার বিশ্বব্যাংকের ৬ দশমিক ৩ শতাংশের যে পূর্বাভাস দিয়েছে- বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এতটা কমও হবে না। আমি মনে করি চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ অতিক্রম না করলেও এর কাছাকাছি থাকবে। ড. সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, সরকার ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের দাবি করছে। কিন্তু সে অনুযায়ী কিন্তু দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। কারণ কর্মসংস্থান হয়েছে কম। বিনিয়োগ প্রত্যাশিত নয়। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার খুব কম। কৃষিতেও আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে। এসব কারণেই সরকারের পূর্বাভাস আমার কাছে মাত্রাতিরিক্ত মনে হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রাক্কলন মাত্র। এ পূর্বাভাসই শেষ কথা নয়। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চেহারা এ প্রাক্কলনে ধরা পড়বে না। এটি বোঝা যাবে আগামী আগস্টে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব শেষ হলে। তবে ৭ দশমিক ০৫ মাত্রার জিডিপি অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন ড. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, অর্থবছরের আর বাকি মাত্র তিন মাস। জিডিপি প্রাক্কলনে যেসব ডাটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার কোনোটি ৬ মাস, কোনোটি ৭ কিংবা ৮ মাসের। এ সময়ের মধ্যে বিরাজমান অর্থনীতিতে গতবারের চেয়ে দশমিক ৫ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের এডিপি কাটছাঁট করতে হয়েছে। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমেছে। রেমিটেন্সেও নেতিবাচক পরিস্থিতি। কর্মসংস্থানের প্রকৃত চেহারাও ভালো মনে হচ্ছে না। জিডিপি ৭ শতাংশ ছাড়ালে এসব সূচকের ইতিবাচক প্রবণতা এখনই ধরা পড়ত।