শুক্রবার, ৩০শে জুন, ২০১৭ ইং ১৬ই আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

চার মৃত্যুর পর বদলাতে শুরু করেছে দৃশ্যপট

AmaderBrahmanbaria.COM
সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৪

---

de02e6ad75c3488082e0b41048537e8e-5ঘড়িতে তখন সকাল আটটা। রাজধানীর কারওয়ান বাজার রেলক্রসিংয়ের ঘণ্টি বাজছে। নামতে শুরু করল রেলগেটের একটার পর একটা প্রতিবন্ধক। গেটের দুই পাশে থেমে থাকা বাস, পিকআপ ভ্যান, ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর সামনে দিয়ে ধুলা উড়িয়ে চলে গেল চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী।
প্রতিবন্ধক সরে যাওয়ার পর রেললাইন ধরে কারওয়ান বাজার মাছের আড়তের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন মো. শাজাহান (৪০)। আড়তসংলগ্ন রেললাইনের কাছে যেতেই দেখেন, রেললাইনে লাঠি হাতে কয়েকজন যুবক। রেললাইনে জোরে লাঠির বাড়ি দিয়ে যুবকেরা বলছেন, ‘কেউ ডালা নিয়া রেললাইনে বসবি না। বসবি তো মার খায়া মইরা যাবি।’ এসব শুনে থেমে যান শাজাহান।
ওই রেললাইনে গত বৃহস্পতিবার সকালেও বসা বাজারে মাছ বিক্রি করেছেন শাজাহান। তাঁর মতো আরও অনেক বিক্রেতা ছিলেন, ছিলেন অনেক ক্রেতাও। ছিল দামাদামি, হট্টগোল। কিন্তু গতকাল শুক্রবার একই সময়ে সেখানে তিনি দেখলেন, বাজার নেই, নেই ক্রেতা-বিক্রেতা। বদলে গেছে সবকিছু। বৃহস্পতিবার সকালে রেলপথের ওপর মুহূর্তের বিভীষিকা বদলে দিয়েছে দৃশ্যপট। পাশেই আড়তে মাছ বেচাকেনা, দরদাম হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আগের দিনের ঘটনা কেউ ভুলতে পারছেন না।
রেলপথে মুহূর্তের বিভীষিকা
ভুলতে পারছেন না শাজাহানও। ৮-১০ বছর ধরে আড়ত থেকে মাছ কিনে রেললাইনের অবৈধ বাজারে তিনি বিক্রি করছেন। রেললাইনের পাশেই একটি ছিন্নভিন্ন ব্যানার দেখিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘দ্যাখেন, কিছু পড়তে পারেন?’ দেখা গেল, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি লেখাটুকু ছাড়া আর কিছু পড়া যাচ্ছে না। শাজাহান বলেন, ‘মানুষ মইরা আমাগো খরচ বাড়ায়া দিছে, আইজক্যা মাছ নিয়া বইতে পারুম না, তাই মাছ কিনি নাই। আগে ১০০-১৫০ টাকা নিত, এইবার তো ২০০ টাকা চাইব। ঠিক এই জাগায় মানুষগুলা মরছে…মনডা ভালা না।’ খরচ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লাইনে বসতে টাকা দিতে হয়। কাকে দিতে হয়—জানতে চাইলে বলেন, ‘পুলিশ, রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী, নাইটগার্ড, আড়তদার, শ্রমিকনেতা—যে য্যামনে পারে টাকা নেয়।’
বৃহস্পতিবার সকালে এখানেই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকামুখী যমুনা এক্সপ্রেস ও চট্টগ্রামগামী কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের মাঝে পড়ে ও ট্রেনের ধাক্কায় চারজন মারা গেছেন। গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন চারজন।
রেললাইন ধরে আরেকটু এগোতেই শাজাহানের মতো আরও কয়েকজন মাছবিক্রেতার জটলা দেখা গেল। বাজার বসতে না দেওয়ায় তাঁরাও গতকাল আড়ত থেকে মাছ কেনেননি। মৃধা নামের একজন বললেন, ‘এইখানে যার য্যামুন ক্ষেমতা, সে সেইভাবে টাকা নেয়।’
সকাল আটটা ২৫ মিনিট। হঠাৎ শোরগোল। রেললাইন দিয়ে প্লাস্টিকের ব্যারেল গড়াতে গড়াতে নিয়ে যাচ্ছিল ১৪-১৫ বছরের একটি ছেলে। লাঠি হাতে এক ব্যক্তি গিয়ে তাকে দুটি বাড়ি দিয়ে ব্যারেলটিকে ঠেলে লাইনের একপাশে নিয়ে ফেললেন। ছেলেটিও লাইন থেকে সরে গেল। তখন ধীরগতিতে ওই স্থান অতিক্রম করল ঈশা খাঁ এক্সপ্রেস।
সকাল আটটা ৪০, আটটা ৫০ ও নয়টা পাঁচ মিনিটে আরও তিনটি ট্রেন কারওয়ান বাজার রেলক্রসিং পার হয়। লাইনের দুই ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ তখন আগের দিনের দুর্ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন।
নয়টা ৪০ মিনিটে মাথায় লাল কাপড় বাঁধা রেল কর্তৃপক্ষের নিয়োগ করা ২০-২৫ জন শ্রমিক দা-শাবল নিয়ে রেললাইনের দুই পাশের টং দোকানের বেড়া এবং বাইরে থাকা মালপত্র ভাঙতে শুরু করেন। নিমেষে এসব ঘর-দোকানের মালিকেরা মালপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। দু-তিন মিনিট পার হতেই উচ্চ শব্দে হুইসেল বাজাতে বাজাতে এল তিতাস কমিউটার ট্রেন। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, জটলা তখনো লাইনের ওপর। হুড়মুড় করে সবাই লাইন থেকে নেমে আসে, কোনোমতে ট্রেনটি পার হয়ে যায়। দোকানগুলো লাইনের সঙ্গে এতটাই লাগোয়া যে সহজে নিরাপদ জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তেজগাঁও থানার পুলিশ, রেলপুলিশ, রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সকাল ১০টার দিকে আসে বুলডোজার। কারওয়ান বাজার ক্রসিংয়ের পূর্ব পাশ থেকে শুরু হয় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। বুলডোজার ভেঙে ফেলতে থাকে লাইনঘেঁষা টং দোকানগুলো।
১০টা ২৮ মিনিটে দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রেসের জন্য উচ্ছেদকাজ মিনিট খানেক বন্ধ থাকে। ট্রেনটি চলে গেলে উচ্ছেদ আবার শুরু হয়। উচ্ছেদকাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা নুরুন্নবী কবীর। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ‘আজ (শুক্রবার) কারওয়ান বাজার ক্রসিং (এফডিসি গেট) থেকে তেজগাঁও স্টেশন পর্যন্ত উচ্ছেদ করা হবে। অভিযান ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে।’ তিনি দাবি করেন, রেললাইনের দুই ধারে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ সব সময় চলে।
বেলা ১১টা। চলছে উচ্ছেদ অভিযান। সঙ্গে মালপত্র আর ভেঙে ফেলা দোকানের টিন-বেড়া নিয়ে দোকানমালিকদের দৌড়াদৌড়ি। আবার দেখা হয় শাজাহানের সঙ্গে। কারওয়ান বাজার কাঠপট্টিসংলগ্ন লাইনের ওপর তখন তিনি দাঁড়িয়ে। তিনি বলেন, ‘কতবার যে এই লাইনে উচ্ছেদ হইল! ভাঙে, সাত দিনের মইধ্যে আবার ঘর ওঠে। আর মাইনষের থিকা টাকা নেয়। এইভাবেই চলব। আপনে আবার সাত দিন পর আইয়া দেইখেন, কথাডা ঠিক কইলাম কি না।’ স্মিত হেসে তিনি বলেন, ‘বুঝলেন, ভাঙা-গড়ার জীবন আমাদের।’
মাঝে মাঝে ট্রেন অতিক্রমের জন্য এক-দুই মিনিটের বিরতি দিয়ে দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ উচ্ছেদ চলে। রেললাইনের পশ্চিম পাশের ঝুপড়ি ঘরগুলোর বাসিন্দারা জানান, তাঁদের মালপত্র নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়েছে।
জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল এফডিসি গেট থেকে তেজগাঁও স্টেশন পর্যন্ত ১৫০টি দোকানঘর উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযান চলবে।

এ জাতীয় আরও খবর