স্বপ্নে গড়া রাজশাহী কলেজ
---
পদ্মার কূলঘেঁষা সবুজ শহর রাজশাহী। তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে আঠার শতকের এক জ্বলন্ত ইতিহাস, যার জন্ম হয়েছিল জমিদার রাজার হাতে। তারপর কত উজ্জ্বল নক্ষত্র এখানে এসেছেন, নিজেকে গড়েছেন, আবার আলো বিলিয়ে দিয়ে চলে গেছেন। সেই আলোতে আজও পথ চলে তারুণরা। শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃৃতিচর্চা, আড্ডা, বিনোদন সবকিছুই চলে এখানে। প্রতিষ্ঠানটি ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ। শুধু রাজশাহী অথবা উত্তরবঙ্গ নয়, এ কলেজের প্রাচীন ইতিহাস ও সুনামের কথা ছড়িয়ে আছে দেশজুড়েই। রাজশাহী শহরের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এ কলেজটি ব্রিটিশ আমল থেকেই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের মর্যাদা পেয়ে এসেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের দুবলহাটীর রাজা হরলাল রায় বাহাদুরের আর্থিক সহায়তায় ১৮৭৩ সালে এটি স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই তা পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ, বিহার, পুর্নিয়া এবং আসামের একমাত্র উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। প্রথম ব্যাচে একজন মুসলমানসহ মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে এর যাত্রা শুরু হলেও ১৯৩০ সালে এর ছাত্র সংখ্যা এক হাজারে উন্নীত হয় এবং এর পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৩৩ সালে ছাত্রী ভর্তির অনুমতি পাওয়া যায়। ড. মুহম্মদ এনামুল হক, যদুনাথ সরকার, কাজী মোতাহার হোসেন, রামপ্রসাদ চন্দ, অক্ষয় মৈত্রেয়'র মতো অনেক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিই তাদের পদধূলি এখানে রেখে গেছেন। তারই ধারাবাহিতকায় আজও একইভাবে এখানে চর্চা হয় পড়াশোনা ও সংস্কৃতির। একইসঙ্গে চলে আড্ডা ও গল্প-গুজব। সকালবেলা কলেজ চত্বরে পা রাখলেই দেখা যায় নির্মল সবুজ ক্যাম্পাসে আগামীর কর্ণধাররা উপস্থিত। সকালের দিকে তারা ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বেলা গড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে আড্ডা। দুপুর না গড়াতেই পুরো ক্যাম্পাস যেন তারুণ্যের মেলায় পরিণত হয়। পড়ালেখার পাঠ চুকে তখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাই যেন কলেজে আসার মূল আনন্দ হয়ে ওঠে। দুপুরের পর তাদের আনন্দমেলায় বিরতি নামলেও বিকাল গড়াতেই আবারও মুখর হয়ে ওঠে কলেজ চত্বর। কলেজের বিশাল মাঠ হয়ে যায় খেলাধুলা আর সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র। পড়াশোনার চাপও এখানে কম নয়। মাস্টার্সের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শারমিন নাহার বলেন, আগে জানতাম মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পার করে এলে আর পড়াশোনা তেমন না করলেও হয়। এখন পড়তে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। রাজশাহী কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ড. আবদুল মজিদের কথা থেকেই বোঝা যায় কতটা শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি মেনে চলছে কলেজটি। তিনি জানান, এখানে প্রতি বছর তিন টার্ম পরীক্ষা, অসংখ্য ক্লাস টেস্ট ও নিয়মিত ব্যবহারিক ক্লাস নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, এখানে ভর্তি প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের তদবির আমলে নেওয়া হয় না। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার মেধাক্রম অনুযায়ী সেরা মেধাবীরাই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে এ কলেজে। তাই ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের সেরা মেধাবীদের জন্য আমাদের শিক্ষকরা আন্তরিকতার সঙ্গে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। রাজশাহী জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হরগোবিন্দ সেন এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদানাথ রায় বাহাদুর ১৮৭৭ সালে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এখানে স্নাতক কোর্স চালুর ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯০২ সালে পুঠিয়ার রানী হেমন্ত কুমারী তার নামে একটি হোস্টেল নির্মাণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্নাতকোত্তর কলেজ হিসেবে ১৮৮১ সালে এমএ কোর্স এবং ১৮৮৩ সালে আইন কোর্স পরিচালনার অনুমতি লাভ করে। কয়েক বছরের মধ্যে এ কলেজের আটজন শিক্ষার্থী এমএ ডিগ্রি এবং ৬০ জন আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯০৯ সালে এমএ ও আইন কোর্স দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজশাহী কলেজ পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রথম অনুমোদিত কলেজ এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে ১৯৫৩ সালে। এ কলেজের শুরুই হয়েছিল উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে, এরপর মাঝে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৬ বছর বিরতি দিয়ে ২০১০ সাল থেকে আবার শুরু হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ভর্তি। এখানে প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানে ৩০০, বাণিজ্য আর মানবিকে ১৫০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে ১৯টি বিষয়ে সম্মান এবং ২১টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে কলেজটিতে।