পদ্মার ভাঙনের কবলে বাবা-মার কবর, শেষবারের মতো জিয়ারত
রাজবাড়ী প্রতিনিধি: গেল কয়েক বছরের অব্যাহত পদ্মার ভাঙনে ভূখণ্ড হারাচ্ছে বাংলাদেশ। রাজবাড়ীতে পদ্মার তীব্র ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
ঘরহারা মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। আশ্রয়হীন পরিবারের ঠাঁই হয়েছে খোলা আকাশের নিচে কিংবা মসজিদ আর স্কুলে।
চোখের সামনে নদীতে চলে যাচ্ছে ফসলি জমি ও বসতভিটা। এমনকি পদ্মায় বিলীন হতে বসেছে বাবা-মায়ের কবর। তাই শেষ বারের মতো বাবা-মার কবর জিয়ারত করতে গোয়ালন্দ থেকে ছুটে এসেছেন ছেলে মো. ইউনুস আলী শেখ।
মো. ইউনুস আলী শেখ জানান, নদীতে ভাঙনের খবর পেয়ে ছুটে এসেছি। বাবা-মায়ের কবর হয়তো আর জিয়ারত করতে পারব না। মনে হয়ে সব নদী নিয়ে যাবে। তাই শেষবারের মতো কবর জিয়ারত করতে এলাম।
একই এলাকার বাসিন্দা জয়নাল মণ্ডল বলেন, রোববার রাত ১টার সময় ভাঙন শুরু হয়। উঠে দেখি ঘরের পেছনের বাঁশঝাড়টি আর নেই। ওই অবস্থায়ই ঘর ভেঙে জিনিসপত্র নিয়ে শহররক্ষা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি।
এদিকে পদ্মায় পানি বৃদ্ধির ফলে রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া, দেবগ্রাম ও ছোটভাকলা ইউনিয়নের পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। তিন সপ্তাহ ধরে অতিমাত্রায় এ ভাঙনে মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
সদর উপজেলার গোদার বাজারে নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে গত সোমবার রাত থেকে। এসময় পদ্মার তীব্র স্রোত ও ঘূর্ণিতে নিমিষে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় শহররক্ষা বাঁধের স্থায়ী তীর সংরক্ষণ বাঁধের প্রায় ২০০ মিটার এলাকা। একই সঙ্গে বিলীন হয় ৩০টি বসতবাড়ি। এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে শতাধিক বসতবাড়ি, ২টি স্কুল, মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
ভাঙন কবলিত এলাকার স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, পাউবো কর্মকর্তাদের বারবার বলা সত্ত্বেও তারা কোনও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। গতকাল সকাল থেকে দুটি ট্রলারে বালি এনে বস্তায় ভরছে। কিন্তু যেখানে ভাঙন, সেখানে বস্তা ফেলছে না। তাছাড়া তাদের কাজের গতিও খুব ধীর। অথচ ভাঙন আতঙ্কে তাদের ঘুম হচ্ছে না। ঘরবাড়ি, গাছপালা সব ভেঙে যাচ্ছে। যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। এভাবে চলতে থাকলে শত শত বসতবাড়িসহ বিদ্যালয়, মসজিদ নদীগর্ভে চলে যাবে। এমনকি রাজবাড়ী শহররক্ষা বাঁধও রক্ষা পাবে না।
রাজবাড়ীর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয়ের তথ্যমতে, ৮৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে সদর উপজেলার গোদার বাজার থেকে বোতলা স্লুইস গেট পর্যন্ত পদ্মার তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। রাজবাড়ী শহররক্ষা বাঁধ (ফেজ-১) প্রকল্পের আওতায় ২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার এলাকায় সম্পন্ন করা হয় পদ্মার তীর সংরক্ষণের কাজ। গত দুই সপ্তাহে এ আড়াই কিলোমিটারে পাঁচবার ভাঙন দেখা দেয়। এ অবস্থায় শহররক্ষা বাঁধটি মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। এটি রক্ষায় আপাতত জরুরি ভিত্তিতে বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে। দুই সপ্তাহে ওই পাঁচ এলাকায় ১০ হাজার বালির বস্তা ফেলা হয়েছে বলে জানায় পাউবো কর্তৃপক্ষ।
মঙ্গলবার গোদার বাজার এলাকায় সরজমিন দেখা যায়, ভাঙন আতঙ্কে দিশেহারা স্থানীয়রা। সবাই যার যার ঘরের আসবাবপত্র সরাতে ব্যস্ত। এসময় কথা হলে স্থানীয় বাসিন্দা মালেক মণ্ডল জানান, চোখের সামনেই তার বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। দুই সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন শহররক্ষা বাঁধে। এখন বাঁধটিও ঝুঁকির মুখে। এটি ভেঙে গেলে তাদের আশ্রয়ের আর জায়গা থাকবে না।
রাজবাড়ীর ধুঞ্চি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দোলনা সুলতানা জানান, ভাঙনের কারণে বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আপাতত পাশের গোদার বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র রাখা হয়েছে।
ভাঙন পরিস্থিতি নিয়ে কথা হলে পাউবো রাজবাড়ীর নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ কৃষ্ণ সরকার বলেন, রাজবাড়ীর নদীপথের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে ২৩ কিলোমিটার পাউবোর আওতাভুক্ত। এর মধ্যে ১৯টি পয়েন্টে ভাঙন চলছে। গত দুই সপ্তাহে রাজবাড়ী সদর, গোয়ালন্দ ও কালুখালী উপজেলায় অন্তত পাঁচ হাজার বিঘা ফসলি জমি ও অসংখ্য বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে শহররক্ষা বাঁধের গোদার বাজার অংশ। এ নিয়ে আমরা নিজেরাও চিন্তিত। আপাতত বালির বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া, দেবগ্রাম ও ছোটভাকলা ইউনিয়নের পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। স্থানীয় লোকজনের মতে, গত দুই সপ্তাহে প্রায় ৪০০ পরিবারের বসতভিটা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া ঝুঁকিতে বসবাস করছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ পরিবার।
দৌলতদিয়ার ঢল্লাপাড়া গ্রামে দেখা যায়, পদ্মার পাড়ে ঢল্লাপাড়া জামে মসজিদের কিছু অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
মসজিদ থেকে একটু দূরে শূন্য ভিটায় গাছ কাটছেন কয়েকজন শ্রমিক। শ্রমিকদের সর্দার মাইনউদ্দিন শেখ (৬০) বলেন, বাড়িটি ছিল মোস্তফা মুন্সির। তার বিশাল বাড়ির সবকিছু তিন দিন আগে সরিয়ে নেন। ভিটায় থাকা মেহগনি, আম, জামসহ ৫৫টি গাছ গোয়ালন্দ মোড়ে নিমতলার নান্নু মিজির কাছে মাত্র এক লাখ পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। গাছের বাজারমূল্য এর দ্বিগুণেরও বেশি।
মাইনউদ্দিন শেখ বলেন, নান্নু মিজির হয়ে তারা নয়জন শ্রমিক পাঁচ দিন ধরে গাছ কাটছেন। ভাঙনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছেন না। গতকাল কয়েকটি মেহগনির টুকরো রেখে অন্য গাছ কাটছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে সব নদীতে চলে গেল।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ঢল্লাপাড়া রাস্তার ইট তুলে নেয়া দেখছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ও জলিল সরদারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা নদীগর্ভে চলে গেছে। শতাধিক পরিবারের বসতভিটা, একটি মাজার শরিফ বিলীন হয়েছে। ঢল্লাপাড়া জামে মসজিদ নদীতে বিলীন হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে পদ্মার পেটে চলে যাবে।
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, এক মাস ধরে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে ব্যাপক ভাঙন শুরু হওয়ায় ২ নম্বর ওয়ার্ড ঢল্লাপাড়া, ৩ নম্বর ওয়ার্ড আফছের শেখেরপাড়া ও লালু মণ্ডল পাড়ার প্রায় ৩০০ পরিবারের বসতভিটা বিলীন হয়েছে। চলতি সপ্তাহে ১০০ পরিবার ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে অন্যত্র গেছে। প্রতিদিন অনেক পরিবার সরে যাচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু নাসার উদ্দিন বলেন, দৌলতদিয়ায় বন্যা ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৭০০ পরিবারের তালিকা পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে জিআরের চাল ও শুকনা খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।