‘ধ্রুব ও লুব্ধকের বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই’
দাম্পত্য জীবনের দূরত্ব ঘোচাতে দুই শিশু সাদমান ধ্রুব ও সাদমান লুব্ধকের বাবা মেহেদী হাসান ও মা কামরুন্নাহার মল্লিকাকে ১ আগস্ট পর্যন্ত সময় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তালাক হয়ে যাওয়ার পরও ওই দম্পতি আবারও নিজেদের মধ্যে সংসার শুরু করতে চান কি না এবং এ ব্যাপারে কী অগ্রগতি হয়েছে তা ওইদিন আদালতকে জানাতে হবে। উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে বুধবার বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টে বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে শিশুদের মা কামরুন নাহার মল্লিকার পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তার সঙ্গে ছিলেন একেএম রিয়াদ সলিমুল্লাহ। অন্যদিকে বাবা মেহেদী হাসানের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল।
চাকরিজীবী কামরুন্নাহার মল্লিকা ও মেহেদী হাসান ২০০২ সালে বিয়ে করেন। ওই দম্পতির দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে সালিম সাদমান ধ্রুবর বয়স ১২ বছর ও ছোট ছেলে সাদিক সাদমান লুব্ধকের বয়স ৯ বছর। দাম্পত্য কলহের জেরে ২০১৭ সালের ১২ মে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকে শিশু দুটি বাবার তত্ত্বাবধানে তার ফুফুর কাছে থেকে লেখাপড়া করছে। ধ্রুব চতুর্থ শ্রেণিতে ও লুব্ধক দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
বুধবার শুনানিকালে হাইকোর্ট ওই দম্পতির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা উচ্চশিক্ষিত। আপনারা সব কিছু বোঝেন। সন্তানদের জন্য হলেও আপনাদের ফিরে আসা উচিত। আপনারা হবেন সমাজের উদাহরণ।’
শুনানির শুরুতে হাইকোর্ট জানতে চান পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে কি না? জবাবে মেহেদী হাসানের আইনজীবী তাপস কান্তি বল আদালতকে বলেন, ‘হ্যাঁ কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে ঘুরেছেন। বাবাও বাচ্চাদের সময় দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটি সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ছোট বাচ্চাটি তার বাবাকে একদিন রাতে থেকে যাওয়ার আবদার জানালে বাবা রাজি হন। কিন্তু মা রাজি হননি। রাত একটায় বৃষ্টির মধ্যে বাবাকে বের হয়ে যেতে হয়েছে।’
এ সময় আইনজীবী আরো জানান, পারিবারিক সমস্যার কারণে ব্যাংকে অভিযোগ দেওয়ায় ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে বাবা মেহেদী হাসানের চাকরি চলে যায়।
পারিবারিক এই বিষয়টি স্মরণ করে দিয়ে এ সময় আদালত বলেন, ‘এই ঘটনা মিডিয়ায় কিভাবে গিয়েছে দেখেছেন? জনগণ সেটাকে কিভাবে দেখছেন? এটা একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তাপস বলেন, ‘বাবা সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করেছেন, বাচ্চারা যেভাবে চাইবেন বাবা তাই করবেন।’
আদালত বলেন, ‘এটাকে কি পরিস্থিতির উন্নতি মনে করেন?’
তাপস বলেন, ‘কিছু তো উন্নতি হয়েছে।’
এ সময় মা কামরুন নাহার মল্লিকার পক্ষের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘এটা পুরোপুরি পারিবারিক ইস্যু। দুইজনের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে আরও কিছু সময় লাগবে।’
আদালত বলেন, ‘ঠিক। এটা তো রাতারাতি উন্নতি হবে না।’
কাজল বলেন, ‘বাচ্চা দুটি এরইমধ্যে ঢাকার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাচ্চারা খুশি যে, প্রতিদিন মা স্কুলে তাদের আনা নেওয়া করছেন।’
আদালত বলেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করলে হবে না।’
এ সময় আইনজীবী কাজল বলেন, ‘এই ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর যেখানে গিয়েছি সেখানে সকলেই বলেছে তোমরা পূণ্যের কাজ করেছ। এ ঘটনায় আদালতের প্রতি মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেছে। কোর্ট সমঝোতার জন্য সময় দিয়েছেন। এটা সর্বমহলে বার্তা দিয়েছে। শিশুদের কল্যাণ বিবেচনায় পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে হবে। তবে উভয়পক্ষকে মনে রাখতে হবে, আদালতের নমনীয়তায় যদি তারা অন্যকিছু ভেবে থাকেন তাহলে সেটা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে আদালতের হাত খাটো না। বাচ্চাদের মঙ্গল চিন্তা করে আদালত যে কোনো আদেশ দিতে পারেন।’
তখন আদালত বলেন, ‘শুধু এ বিষয় না, প্রত্যেক ডিভোর্সে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের সবার অনুভূতি একইরকম। হয়ত এ দুটি বাচ্চা আজকে আমাদের সঙ্গে অনুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। সারাদেশের ডিভোর্সি দম্পতির সব বাচ্চারই অনুভূতি এক, তবে তারা সেটা বলতে পারে না। এই বাবা-মা শুনলেও অন্য বাচ্চাদের বাবা-মা এসব অনুভূতি কানে নেন না।’
এ সময় আইনজীবী তাপস বলেন, ‘বাচ্চারা যদি চায় বাবাকে যেন বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। প্রয়োজনে ড্রয়িং রুমে থাকবে।’
আদালত বলেন, ‘অপেক্ষা করুন, সমঝোতা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এ সময় আদালত উপস্থিত শিশু দুটিকে কাছে ডেকে নিয়ে তাদের বক্তব্য শোনেন। বড় ছেলে ধ্রুবকে আদালত জিজ্ঞাসা করেন, ফুটবল বিশ্বকাপে তুমি কোন দল করো? তার জবাব, ‘ব্রাজিলকে সাপোর্ট করি।’ এরপর আদালত ছোট ছেলে লুব্ধককে (৯) জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কোন দল করো? উত্তরে সে নিজেকে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার উল্লেখ করে। এরপর আদালতের প্রশ্ন, ‘সবকিছু ভালো আছে তো?’ লুব্ধক জবাব দেয়, ‘সবকিছু ভালো আছে।’
আইনজীবী কাজলের ভাষ্য, ‘ধ্রুব ও লুব্ধক ইতোমধ্যে ঢাকায় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তারা খুশি। প্রতিদিন স্কুলে আনা-নেওয়া করছেন তাদের মা।’ এসব তথ্য জেনে আদালত বলেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করলে হয় না।’
আদালত জানতে চান, নতুন স্কুল কেমন লাগছে? ধ্রুব বলে, ‘ভালোই।’ আদালতের প্রশ্ন, তোমরা ঘুরতে গিয়েছিলে? ধ্রুব বলে, ‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।’ কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলে, আদালত জানতে চাইলে ধ্রুব জায়গার নাম মনে করতে পারেনি। ব্যারিস্টার তাপস কান্তি জানান, মা ছুটি নিয়ে ঘুরছেন। বাবাও ছেলেদের নিয়ে ঘুরতে যেতে চান। আদালত তখন বলেন, ‘বাবাও ঘুরতে পারবেন। প্রয়োজনে তাদের মাকেও সঙ্গে নিয়ে ঘুরবেন।’
পরে বাবা-মাকেও ডাকেন। তাদের উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘আপনারা দুইজনই শিক্ষিত সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষের কাছে কি বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।’
পরে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘আজ আদালতে শিশু দুটিসহ বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন। আদালত আমাদের কাছ থেকে শুনে দুজনের পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন পুনরুদ্ধারের জন্য আবারও সময় দিয়েছেন। এ বিষয়ে আগামী ১ আগস্ট পরবর্তী তারিখ রেখেছেন।’
ডিভোর্স হওয়ার পরে আবার নতুন করে দাম্পত্য জীবন ফিরে পেতে আইনের কোনো বাধা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে কাজল বলেন, ‘এখানে আইনগত কোনো বাধা নেই। আইনি কোনো বাধা থাকলে তো আমরা এ বিষয়টি নিয়ে আদালতে যেতাম না। এখানের দুজনের পারস্পরিক সদিচ্ছা, সম্মতি ও তাদের উপলব্ধি হলেই কলহ মিটে যাবে। তাদের পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা হলেই হবে।’
আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, ‘বাবা ও মা নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব পূরণ করে তাদের সন্তানের জন্য কতটা এগিয়ে আসতে পারবেন সেটাই এখন আদালত দেখবেন। এটা দেখে আদালত পরবর্তী আদেশ দেবেন। আদালত আজ বলেছেন, এ সময়ের মধ্যে বাবা অবশ্যই মায়ের বাড়িতে গিয়ে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। সন্তানদের নিয়ে যেখানে ইচ্ছা ঘুরতে পারবেন।’
আদালত থেকে বেরিয়ে সন্তানের বাবা মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি আগের অবস্থায় ফিরতে পারব।’
মা কামরুন নাহার মল্লিকা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি পারবো। সন্তানদের জন্য হলেও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে।’
দুই সন্তানকে কাছে পেতে হাইকোর্টে মা কামরুন নাহার মল্লিকা আবেদন করলে গত ২৫ জুন বাবার কাছ থেকে সন্তানদের নিয়ে মায়ের কাছে দেন আদালত। একই সঙ্গে সন্তানের জন্য হলেও বাবা-মাকে তাদের দাম্পত্য জীবনে ফিরে আসার পরামর্শ দেন। এছাড়া শিশু দুটির সঙ্গেও কথা বলে আদালত তাদের ইচ্ছার কথা জানতে চান।
দুই শিশু বাবা-মাকে একসঙ্গে দেখতে চায়। সেদিন আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এরপর বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় এবং আলোচনায় উঠে আসে।