ভবিষ্যৎ আর্জেন্টিনা দল কেমন হবে
রাশিয়া বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে হেরে শেষ ষোলো থেকে বিদায় নিয়েছে আর্জেন্টিনা। যেটির প্রভাব পড়তে যাচ্ছে দেশটির ফুটবল সংস্কৃতিতে। কাতার বিশ্বকাপ জয়কে লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে পুরোপুরি নতুন এক আর্জেন্টিনা দল গড়া হবে। যেখানে লিওনেল মেসির থাকা না-থাকার সম্ভাবনা ৫০-৫০।
রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হবে, সেটি স্বয়ং আর্জেন্টিনার মানুষই হয়তো আশা করেননি। লিওনেল মেসিই বলেছিলেন, সেমিফাইনাল খেলাই হবে আর্জেন্টিনার জন্য সাফল্যের। কিন্তু সেই লক্ষ্যও পূরণ করতে পারেনি লা আলবিসেলেস্তেরা। বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে শেষ ষোলোতেই।
আর্জেন্টিনার শিরোপা–খরা পৌঁছেছে ২৫ বছরে। বিশ্বকাপ না জেতার বয়স বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ বছরে। কাতারে সেটি হবে ৩৬। কাতার বিশ্বকাপকে লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিয়ে আর্জেন্টিনা ফুটবলে বড়সড় একটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে, সেটির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
ফ্রান্সের কাছে হারার পরপরই আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা হাভিয়ের মাচেরানো ও মিডফিল্ডার লুকাস বিলিয়া অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। লিওনেল মেসি হারার পরদিনই একা একা ফিরেছেন ক্লাব বার্সেলোনায়। অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, গঞ্জালো হিগুয়েইন, সার্জিও আগুয়েরোদের ভবিষ্যৎ কী, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়।
আর্জেন্টিনার লক্ষ্য একটি তরুণ দল তৈরি করা, যারা তাদের ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে কাঙ্ক্ষিত ফল এনে দিতে পারবে। সেই দলে লিওনেল মেসি যেমন থাকতেও পারেন, আবার না থাকার সম্ভাবনাও কম নয়। মেসি অবসরের ঘোষণা দিলে তিনি থাকবেন না, এটি নিশ্চিত, যদি দেশের হয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে চান, তাহলে তাঁকে ঘিরেই হয়তো নতুন করে স্বপ্ন দেখবে আর্জেন্টাইনরা।
মেসিকে নিয়ে ও মেসিকে ছাড়া—দুভাবেই আর্জেন্টিনার নতুন দলটি কেমন হতে পারে, সেটি দেখা যাক।
গোলকিপিং পজিশন আর্জেন্টিনার জন্য সব সময়ই এক দুশ্চিন্তার নাম। রাশিয়া থেকে এভাবে বিদায় নেওয়ার পেছনে গোলকিপারদের দোষও কম ছিল না। সেই গোলকিপিং পজিশনে আর্জেন্টিনা দলে আসছেন জেরোনিমো রুয়ি। ২৪ বছর বয়সী এই গোলকিপার বেশ কয়েক বছর ধরেই খেলছেন স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল সোসিয়েদাদে। সেখানে ভালো পারফরম্যান্সই আর্জেন্টিনার পরবর্তী নম্বর ওয়ান হতে সাহায্য করবে রুয়িকে।
রক্ষণভাগে বর্তমান দলের নিকোলাস টাগলিয়াফিকো থেকে যেতে পারেন। ২৫ বছর বয়সী আয়াক্স লেফট ব্যাক রাশিয়ায় আর্জেন্টিনার হয়ে মন্দের ভালো খেলা কয়েকজনের মধ্যে একজন। সেন্টার ব্যাক জুটি হতে যাচ্ছে পুরোপুরি নতুন। ২২ বছর বয়সী জেনিত সেন্টার ব্যাক ইমানুয়েল মাম্মানা এবং একই বয়সের রিভারপ্লেট সেন্টার ব্যাক লুকাস মার্টিনেজ কুয়ার্তা হবেন আর্জেন্টিনার নতুন দলের রক্ষণভাগের সেনানী। রাইট ব্যাক হিসেবে আসবেন ইন্ডিপেনদিয়েন্তে ২২ বছর বয়সী ফ্যাব্রিসিও বুস্তোস।
মাঝমাঠে হাভিয়ের মাচেরানোর অভাব পূরণ করতে আছেন জার্মান ক্লাব স্টুটগার্টের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার সান্টিয়াগো আসকাসিবার। ২১ বছর বয়সী আসকাসিবারের খেলার ধরনে মাচেরানোর সঙ্গে মিল তাঁকে আর্জেন্টিনা দলে জায়গা করে দেবে। মিডফিল্ডে তাঁর সঙ্গী হবেন পিএসজির ২২ বছর বয়সী মিডফিল্ডার জিওভানি লো সেলসো। এবার দলে থাকলেও সেলসোকে এক সেকেন্ডের জন্যও মাঠে নামাননি কোচ হোর্হে সাম্পাওলি। আসকাসিবার ও সেলসোর সঙ্গে থাকবেন লিয়ান্দ্রো পারেদেস।
রাশিয়া বিশ্বকাপে ২৪ বছর বয়সী পারেদেসকে দলে নেওয়া হয়নি বলে সাম্পাওলিকে কম কথা শুনতে হয়নি। সেই পারেদেসই হবেন মাঝমাঠে আর্জেন্টিনার প্রাণভোমরা। সৃষ্টিশীলতার অভাব পূরণ করবেন ওয়েস্ট হাম মিডফিল্ডার ম্যানুয়েল ল্যানজিনি। রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার তুরুপের তাস ভাবা হচ্ছিল তাঁকে, কিন্তু বিশ্বকাপের আগেই মারাত্মক চোট ল্যানজিনি ও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ–স্বপ্নে ধাক্কা দেয়। ২৫ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডারের সামর্থ্য আর্জেন্টিনার জন্য বড় অস্ত্রই হতে যাচ্ছে।
আক্রমণভাগে সবার ওপরে থাকবেন রাশিয়া বিশ্বকাপে দলে না থাকা স্ট্রাইকার মাউরো ইকার্দি। ২৪ বছর বয়সেই ইন্টার মিলানের মতো ক্লাবের অধিনায়ক ও ইউরোপের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন ইকার্দি। নিজের ট্যাকটিকসের সঙ্গে ইকার্দির খেলার ধরন যায় না, এই অজুহাতে রাশিয়ায় তাঁকে দলে নেননি সাম্পাওলি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ইকার্দিই হবেন আর্জেন্টিনার নাম্বার নাইন।
ইকার্দির সঙ্গে আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগের দায়িত্বে থাকবেন পাওলো দিবালা, তাঁকে ভাবা হয় আর্জেন্টিনার ভবিষ্যৎ মহাতারকা।
দিবালা রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলার সুযোগই পেয়েছেন কেবল ২৬ মিনিট। অথচ গেল মৌসুমে জুভেন্টাসের হয়ে ২৬ গোল করেছিলেন ২৫ বছর বয়সী দিবালা। লিওনেল মেসির সঙ্গে খেলার ধরনে মিল থাকায় দিবালাকেও মেসির পরে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ভাবা হয়। সেই দিবালা-ইকার্দি জুটি প্রতিপক্ষের রক্ষণে ত্রাস ছড়াবেন।
এই জুটির পেছনে থাকবেন স্বয়ং লিওনেল মেসি। নিজের মিডফিল্ডার সত্তাটা এবার পুরোপুরি জাগিয়ে তুলতে হবে মেসিকে। দিবালা-ইকার্দিকে গোলের সুযোগ তৈরি করে দিতে মেসির থেকে ভালো বিকল্প আর কেউ হতে পারেন না। মেসির সৃষ্টিশীলতাই গোলের দরজা খুলে দেবে স্ট্রাইকার জুটির জন্য। মেসিকে ঘিরেই নতুন আর্জেন্টিনা দলটি তৈরি করা হবে।
তবে যদি আর্জেন্টিনার হয়ে আর কখনো মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেন মেসি, তখন তাঁর বিকল্প খুঁজতে হবে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনকে। মেসিকে ছাড়া খেলার কোনো পদ্ধতি বের করতে হবে তাদের। সে ক্ষেত্রে পুরো দল একই রকম থাকবে, কেবল মেসির জায়গায় ক্রিস্টিয়ান পাভোন আসবেন। মেসি না থাকায় খেলার পদ্ধতিও বদলাবে আর্জেন্টিনার। আর মেসি থেকে গেলে তো কথাই নেই।
এই দলে জায়গা হবে না অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, গঞ্জালো হিগুয়েইন, সার্জিও আগুয়েরো, নিকোলাস ওটামেন্ডি, সার্জিও রোমেরোদের। আর্জেন্টিনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই দল থেকে ছাঁটাই করা হবে তাঁদের। নিজেদের পরিকল্পনায় অটল থাকলে কাতার বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব থেকেই এক নতুন আর্জেন্টিনাকে দেখার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারেন সমর্থকেরা।