শুক্রবার, ৬ই জুলাই, ২০১৮ ইং ২২শে আষাঢ়, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

রাশিয়ায় ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে ইসলাম

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ায় ইসলাম ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। কিন্তু রুশ কর্তৃপক্ষ এতে চুপ করে বসে থাকেনি। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ায় সব ধর্ম ও ধর্মীয় কর্ম নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। মসজিদ, ধর্মীয় উপাসনালয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো ভেঙে ফেলা হয়। নাস্তিক কমিউনিস্টদের নিবর্তনমূলক শাসনের ফলে রাশিয়ায় ইসলাম ধর্ম ৭০ বছর ধরে প্রকাশ্যে বিকশিত হতে পারেনি। ইসলামের প্রচার-প্রসার, দাওয়াত ও তাবলিগ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। রুশ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুশাসন ও সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি পালন স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে ধর্মীয় স্বাধীনতা আইন পাস হলে ইসলাম তার অন্তর্নিহিত সব শক্তি নিয়ে আবার জেগে ওঠে। ফের শুরু হয়ে যায় দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ। বর্তমানে ১৪ কোটি ২০ লাখ রুশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে শক্তিশালী মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ।

রাশিয়ায় দিন দিন মসজিদের সংখ্যা বাড়ছে। এই বৃদ্ধিতে ভ্লাদিমির পুতিনও সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ায় মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বোঝা যায় এ দেশে ইসলামের প্রসার ঘটছে।’ এছাড়াও তিনি ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘ক্যাথিড্রাল’ নামে একটি মসজিদ উদ্বোধন করেন, যা রাশিয়া তথা ইউরোপের মধ্যে সর্ববৃহৎ মসজিদ। যেখানে একসঙ্গে ১০ হাজার লোকের নামাজ পড়া সম্ভব। মসজিদের সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও ধারণা করা হয়, ৭ হাজার ৫০০-এরও বেশি মসজিদ বর্তমানে রাশিয়ায় রয়েছে, যা কয়েক বছর আগেও ছিল কয়েক শতকের নিচে।

পরিবর্তিত এই পরিস্থিতি মুসলমানদের অনুকূলে হলেও বেশ কিছু সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। কমিউনিজম যদিও আজ এক বিস্মৃত মতবাদের নাম, তবুও সেই মতবাদপুষ্ট লোকজন এখনও সোভিয়েত সংলগ্ন এলাকাগুলোয় নানা অজুহাতে অব্যাহত রেখেছে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক নানান কর্মকাণ্ড। এছাড়া হলুদ মিডিয়ার অপতৎপরতা তো রয়েছেই।

বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়া অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী একটি রাষ্ট্র। এটি বিশ্বের নবম জনবহুল দেশ। রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব পর্যন্ত রয়ছে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, চীন, মঙ্গোলিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত। অন্যদিকে অখতস্ক সাগরের মাধ্যমে জাপান ও বেরিং প্রণালিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার সঙ্গে সামুদ্রিক সীমানাও রয়েছে। দেশটির মোট আয়তন ১৭,০৭৫,৪০০ বর্গকিলোমিটার। কোনো প্রকার যুদ্ধ-জিহাদের মাধ্যমে রাশিয়ায় ইসলামের আগমন ঘটেনি। ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুসলমানদের সঙ্গে ওঠাবসার মাধ্যমে ইসলামের সঙ্গে রুশদের পরিচয় ঘটে। বর্তমান রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা মুসলিম বাহিনীর অভিযানে ইসলাম বিজয়ী হলেও তার প্রভাব রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে পড়েনি। তবে হ্যাঁ, রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত অল্প সংখ্যক মুসলিম দেশ যেমন চেচনিয়া এবং সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণকারী মুসলিম দেশ যেমন তাজিকিস্তান রুশদের মাঝে ইসলাম প্রচারে অল্প-বিস্তর ভূমিকা পালন করেছে।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সমাজতান্ত্রিক সরকার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো দখল করে বহুসংখ্যক বিদগ্ধ মুসলিম আলেমকে হত্যা করে ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইসলামি শিক্ষা হয়ে পড়ে পঙ্গু। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কিছু কিছু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে রাশিয়ার মুসলমানরা নানা অসুবিধা সত্ত্বেও ইসলামী শিক্ষা পুনঃপ্রবর্তনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে রাশিয়ায় গড়ে ওঠা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে মস্কো মুসলিম কলেজ, রাশিয়ান ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কাজান মুহাম্মদিয়া মাদ্রাসা ও বুগুরুসলান মাদ্রাসা। এছাড়া দাগিস্তান ও ইঙ্গুশেটিয়ায় অনেক ছোট ছোট মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর হাজারো যুবক দ্বীনের দায়ি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছেন দেশটির আনাচে-কানাচে।

বর্তমানে রাশিয়ায় ধর্মীয় সহিংসতা নেই বললেই চলে। অন্যান্য ধর্মের লোকেরা ইসলামকে বেশ সম্মানের চোখেই দেখেন। তাই মুসলিম-অমুসলিমের নামে নেই তেমন কোনো ভেদাভেদ বা মনোমালিন্য। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে একজন ইসলাম অনুরাগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি সবসময় রাশিয়ার মুসলিমদের সমর্থনের পাশাপাশি সব রকম সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। কিছুদিন আগে রাশিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি তালাত তাজউদ্দিনের বাসভবনে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বৈঠকে রাশিয়ায় ইসলাম প্রবেশ ও ঐশী ধর্ম বিস্তারের ইতিহাস নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।

Print Friendly, PDF & Email