খুলনায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে বখাটেদের আড্ডাস্থল
খুলনা প্রতিনিধি : ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ এমন মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে মহানগরী খুলনায় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া বখাটে ছেলেদের আড্ডাস্থল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ইভটিজিং, নেশা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এমনকি খুনের পরিকল্পনাও হয় এ সকল আড্ডাস্থল থেকে। আড্ডায় মেতে থাকা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা গভীর রাত পর্যন্ত বাড়ি ফিরে না আসায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন অভিভাবকসহ সচেতন মহল। এখনই আড্ডাস্থলগুলো চিহ্নিত করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা না নিলে পাবলিক কলেজের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ফাহমিদ তানভীর রাজিনের মত অকালে ঝরে পড়তে পারে অনেক কিশোরের জীবন। ঘটতে পারে বড় ধরনের অঘটন।
এদিকে তরুণদের এ আড্ডাকে ঘিরে গড়ে উঠছে ইয়াবা সার্কেলসহ বড় ভাইদের আধিপত্য। পাশাপাশি পাড়া-মহল্লার উঠতি বয়সীদের একটি বড় অংশ এসব বন্ধুদের সাথে বাজে আড্ডায় জড়িয়ে সময় পার করছে। অসৎসঙ্গের আড্ডা থেকেই কিশোর বয়সে তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। কেউ কেউ নেশার ফাঁদে পা দিচ্ছে। মাদকাসক্ত সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হিমসিম খেতে হচ্ছে পরিবারকে। অভিভাবক, মসজিদের ইমাম ও সচেতন মহলের মতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকা এবং খেলার মাঠগুলোতে বড় বড় বিল্ডিং গড়ে ওাায় খেলাধুলার সুযোগ না পেয়ে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা এ সকল আড্ডায় মেতে উঠেছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক গাজী আলাউদ্দিন আহমদ বলেন, কৈশোর বয়সে ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। তাই অবসর সময়ে তারা যাতে খেলাধুলায় সময় কাটাতে পারে সে সুযোগ থাকতে হবে। এর পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারী প্রয়োজন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কিশোর অপরাধ রোধ করা সম্ভব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দীর্ঘদিন খুলনায় অবস্থানরত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, খুলনার প্রতিটি থানায় বিশেষ করে স্কুল কলেজের সামনে অল্পবয়সীদের এ ধরনের আড্ডার স্পটগুলো চিহ্নিত করা দরকার। ওইসব স্থানে মূলত স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা কোন সময়, কেন আড্ডা দেয়, আড্ডার বিষয়বস্তু কী, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা চলছে কি না, আড্ডায় নিষিদ্ধ কিছু ব্যবহার হচ্ছে কি না এসব মনিটরিং করে সারপ্রাইজ চেকিং করা যেতে পারে। এরপর অপরাধমূলক কিছু পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের অপরাধ কতটা তা বিবেচনা করে, প্রথম অবস্থায় তাদের মা-বাবাকে ডেকে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ তার দ্বারা হবে না মর্মে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। যদি তাদের কাছে মাদক বা অস্ত্র পাওয়া যায়, তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
নবম শ্রেণীর এক ছাত্রের অভিভাবক লিপি আক্তার বলেন, আমাদের সন্তানরা যতক্ষণ স্কুল-কলেজে থাকে ততক্ষণ নিরাপদে থাকি। কিন্তু স্কুল-কলেজ থেকে ফেরার পর শুরু হয় যত চিন্তা। কত সময় সন্তানদের বাসার মধ্যে আটকে রাখা যায়। আগে স্কুল থেকে ফিরে খেলার মাঠে খেলতে যেত খেলা শেষে বাসায় ফিরতো। কিন্তু এখন একদিকে ডিজিটাল যুগ অপর দিকে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় সন্তানরা অবসর সময় বাজে আড্ডায় মেতে ওঠে। এক সাথে যখন অনেকে আড্ডা দেয় তখন আমাদের পক্ষে কী সন্তানরা যাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে তারা ভাল না মন্দ তা সব সময় খুঁজে বের করা সম্ভব?
মসজিদের ইমাম ও তালিমুল মিল্লাত রহমাতিয়া মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল আবু সাঈদ মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বলেন, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, পিতা-মাতার অসচেতনতা, বিনোদন ও খেলাধুলার পরিবেশ না থাকায় অবসর সময় ছেলে-মেয়েরা এসব বাজে আড্ডায় মেতে উঠছে। মসজিদে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলোচনা করে কোন লাভ হয় না কারণ যারা বখাটে বাজে আড্ডা দেয় তারা কখনও মসজিদে আসেনা। সুতরাং প্রশাসন এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে এদের ফিরিয়ে আনতে হবে।
অভিভাবকরা জানান সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন তারা। ভাবেন সন্তান মানুষ হচ্ছে। কিন্তু মা-বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা সময় কাটায় বিভিন্ন পার্কে কিংবা রাস্তার মোড়ে। এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতে দেখা যায় নগরীর বিভিন্ন আড্ডাস্থলে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে আড্ডাস্থলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খালিশপুরে পার্কের মোড়, নয়াবাটির মোড়, পিপলস মোড়, রাজধানীর মোড়, সাতরাস্তার মোড়, নিউ মার্কেটের প্রতিটি গেটের সামনে, নিউ মার্কেটে নুর জামে মসজিদের সামনে, বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের গলির মধ্যে, জিয়া হলের সামনে, টাইগার গার্ডেনের রাস্তার বিপরীত পাশে, শিববাড়ি জাদু ঘরের সামনে, সিটি ইন হোটেলের পাশের গলিতে, মুজগুন্নী পার্কের সামনে, বয়রা চার রাস্তার মোড়, মোস্তর মোড়, বয়রা পুলিশ লাইনের পাশে বটতলার মোড়, সার্কিট হাউসের মূল গেটের সামনে, জিলা স্কুলের সামনে, সরকারি সুন্দরবন কলেজের পাশে, কলেজিয়েট স্কুলের পাশে, রূপসা খানজাহান আলী সেতুর নিচে, দৌলতপুর সেফ এন্ড সেভ-এর সামনে, আবু নাসের হাসপাতালের দক্ষিণ গেটের সামনে, হাসপাতালের সামনের চার রাস্তার মোড়, সার্জিক্যাল ক্লিনিকের পাশে সোনাডাঙ্গা ৯নং রোডের মধ্যে, নর্থ ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে তেঁতুল তলার মোড়ে, ময়লাপোতা রাঁধুনী হোটেলের নিচে, নিরালা আবাসিকে চার রাস্তার মোড়ে, জিরো পয়েন্ট মোড়। এসব আড্ডাস্থল থেকেই জন্ম হচ্ছে ডেঞ্জার বয়েজ, টিপসি বয়েজ, গোল্ডেন বয়েজের মত গ্রুপের। আড্ডাস্থলের আরিফ নামের যুবক বলেন, আমাদের মধ্যে যখন পাঁচ-দশজনের একটা জোট গড়ে উঠে, তখন বুকে বল আসে। কারণ একজনের কিছু হলে আমরা একসাথে সকলে তার পাশে দাঁড়াতে পারি। তখন আর মনে ভয় থাকে না। এখনই বখাটেদের এ সকল আড্ডাস্থল চিহ্নিত করা না গেলে ইভটিজিং, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নেশার মাত্রা এবং খুনের মত কিশোর অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যাবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
কেএমপি পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবীর (পিপিএম) বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা অবসর সময় কোথায় যাবে? তাদের তো বিনোদনের কোন সুযোগ নেই। পাবলিক কলেজের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ফাহমিদ তানভীর রাজিন হত্যার পর আমরা তিনটি বখাটে গ্রুপ ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছি। বর্তমানে বখাটেরা জোটবদ্ধ হয়ে কোথায় আড্ডা দিচ্ছে, তা আমার জানা নেই। তবে আপনাদের মাধ্যমে সঠিক তথ্য পেলে খুঁজে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে’।