বাজেট প্রসঙ্গে কিছু কথা

মহিউদ্দিন আহমাদ : আগামী অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রাক্ বাজেট সভায় আলোচনা ও মতবিনিময় হচ্ছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, চেম্বার অব কমার্স এবং অর্থনীতিবিদ ও বিজ্ঞজন সুচিন্তিত পরামর্শ দিচ্ছে। পত্র-পত্রিকা থেকে দেখা যায় বাজেট সংক্রান্ত প্রস্তাব ও সুপারিশ বিভিন্ন মহল থেকে দেয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে সব কিছু পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে যুগোপযোগী বাজেট প্রস্তাব তৈরী ও বিল চূড়ান্ত করা হবে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী একটানা ৮ বছর বাজেট পেশ করে এবং গত বছর এ যাবৎ বৃহত্তম বাজেট তৈরী করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এ বছরের বাজেট আরও বড় চ্যালেঞ্জ হলেও তিনি সেরা বাজেটই দিবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে এবার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে এবং ভিন্ন আঙ্গিকে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছে- এটা আমাদের গৌরবের, গর্বের। কিন্তু এ অর্জন ও সাফল্য ধরে রাখতে সর্বক্ষেত্রে প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। দেশের মর্যাদা বৃদ্ধির কারণে জি,এস,পি ও অন্যান্য সুবিধা কমে যাবে; চড়া সুদে বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। এক কথায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তাই, পরমুখাপেক্ষী দেশ থেকে স্বনির্ভর উন্নয়নশীল বাংলাদেশে উন্নীত হওয়ার জন্য সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ লক্ষ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং রপ্তানীর ক্ষেত্রে সুবিধাসহ বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়ন জরুরী। আশার কথা, সরকার ইতোমধ্যে ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে উন্নয়ন কর্মকান্ডে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্মক্ষেত্র বিস্তারের জন্য প্রেরণা লাভ করবে। সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে উন্নতির ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছা ত্বরান্বিত হবে। এ প্রেক্ষাপটে অপ্রদর্শিত টাকা বৈধভাবে বিনিয়োগের বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
দেশে অপ্রদর্শিত টাকা আছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এর পরিমাণ কত, তা ধারণা করতে না পারলেও বিপুল পরিমান টাকা হিসাবের বাইরে আছে এবং দেশে বৈধভাবে বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় নানাভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে, দেশের সম্পদ বিদেশে চলে যাচ্ছে এবং আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। অতীতে বিভিন্ন সময় সরকার এরূপ টাকার বৈধতা দিয়েছে; কিন্তু বর্তমানে এর সুযোগ ক্রমে সংকুচিত হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে নীতি-দুর্নীতির যুক্তি তুলে অপ্রদর্শিত টাকার বৈধতা দেয়ার বিরোধিতা করা হয়ে থাকে। এটা স্বাভাবিক; অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, সব টাকাই দেশের সম্পদ। আবার অনেক সময় সাদা টাকাও অপ্রদর্শিত থেকে যায়। যেমন সম্পত্তি ও জমি-জমা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নানা কারণে বিক্রয় মূল্য প্রকৃত মূল্য থেকে অনেক কম দেখানো হয়। এক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত টাকা থেকে যায়। বিভিন্নভাবে আমাদের সমাজে অপ্রদর্শিত কালো টাকা অনেকের কাছে থেকে যায়। তাছাড়া কালো টাকা হলেও দেশের সম্পদ দেশে রাখা প্রয়োজন।
কিন্তু বিনিয়োগের সুবিধা না পেয়ে বা হয়রানির ভয়ে এরূপ টাকা অন্যত্র অবৈধ পথে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করলে বিপুল পরিমান অর্থ দেশের উন্নয়নে বিনিয়োগ হতে পারে। বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করে আসন্ন বাজেটে অপ্রদর্শিত টাকা ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগের সুবিধা দিলে দেশের উন্নয়নে এ টাকা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা যায়। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং অন্যান্য জনহিতকর কাজে বা প্রকল্পে অর্থবিনিয়োগ বা ব্যয়ের টাকার উৎস সম্পর্কে নাজেহাল না হলে অনেকেই এগিয়ে আসবে এবং জনগণ বিভিন্ন সুবিধা পাবে, সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে। অপ্রদর্শিত টাকা এক্ষেত্রে বিনিয়োগের বৈধতা দেয়া যেতে পারে। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়াতে কোন মঙ্গল নেই; বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। সংশ্লিষ্ট মহল গুরুত্বসহ বিষয়টি ভেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে দেশ উপকৃত হবে। পরবর্তী সময়ে বৈধতার সুবিধা দেয়া হবে না এ শর্তে সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত টাকা বিনিয়োগের জন্য এবারের মতো সুযোগ দেয়া যেতে পারে।
বাজেটের জন্য সিংহভাগ রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব রাজস্ব বোর্ডের উপর অর্পিত। বর্তমানে রাজস্ব বোর্ড সচেতনতার সঙ্গে করদাতাদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। করমেলা, করসপ্তাহ, প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে করদাতাদের আস্থালাভের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেকটা সফলও হয়েছে। হয়রানির ভয় না থাকলে দেশের স্বার্থে এ দেশের নাগরিকগণ ত্যাগ স্বীকার করতে দ্বিধা করবে না। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ। দেশকে সকলেই দিতে চায়, কিন্তু ভয়-ভীতি তাদের বিমুখ করে রাখে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারলে দেশ অনেক এগিয়ে যেতে পারে। মামলা, জরিমানা বা হয়রানির ভয় দূর করে নতুন করদাতাদের এগিয়ে আসতে উৎসাহ দিতে হবে। কর না দেয়ার কারণে বা কর ফাঁকি দেয়ার কারণে কঠোর শাস্তির পরিবর্তে ন্যায্য কর দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দিলে ‘কর নেটওয়ার্ক’ বিস্তৃত হবে।
দেশের উন্নয়নে জনসাধারণের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে স্বচ্ছল ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের উপর ‘উন্নয়ন কর’ হিসাবে নতুন কর ধার্য করা যেতে পারে। বৃটিশ আমলে পথ ও শিক্ষার উন্নয়নের জন্য খাজনার সঙ্গে পথকর ও শিক্ষাকর ধার্য করা হত। পথের সুবিধা ও শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণে প্রজাগণ জমিদার ও সরকারকে এ কর প্রদান করতে আপত্তি করেনি। বর্তমানে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি ও উন্নয়নে অংশীদার হতে দেশবাসী আগ্রহী হবে বলে আশা করা যায়। তাই তারাও উন্নয়ন কর দিতে আপত্তি কববে না; বরং দেশের অগ্রযাত্রায় সামিল হতে পেরে গর্ব অনুভব করবে। মোট কথা ব্যবসায়ী মহল, চাকুরীজীবি ও জনগণকে আস্থায় নিতে হবে, কাছে টানতে হবে এবং দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলেই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হবে।
বাজেট প্রণয়নে স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত লোকজনকে সঞ্চয়ের জন্য প্রেরণা দেয়া প্রয়োজন। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক ও সঞ্চয় পত্রের মাধ্যমে জমা আকর্ষণীয় করতে হবে। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক কোন বাণিজ্যিক ব্যাংক নয়, চেকে আদানপ্রদানের ব্যবস্থাও নেই, ক্লিয়ারিং হাউজের সদস্যও নয়। জনগণকে সঞ্চয়ের সুযোগ দেয়া এবং উদ্বুদ্ধ করাই সঞ্চয় স্কীমের মূল লক্ষ্য। চাকুরীজীবি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও নির্ধারিত আয়ের লোকজন যাতে তাদের আয়ের কিছু অংশ সঞ্চয় করতে উৎসাহী হয় তজ্জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক অপেক্ষা অধিক হারে মুনাফা দেয়া হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে আয়কর মুক্ত মুনাফা দেয়া হত; এর ফলে সঞ্চয় করা ও টাকা বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে আগ্রহ লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু মেয়াদী সঞ্চয় হিসাব ও সঞ্চয় পত্রের উপর মুনাফার হার কমানো এবং উৎসে কর কর্তনের কারণে সঞ্চয়ের স্পৃহা অবদমিত হয়ে থাকে। ফলে, সঞ্চয় স্কীমে জমা হ্রাস পায়। প্রয়োজনের সময় সরকারের ঋণ নেয়ার সুযোগও কমে যায়। তাই, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক ও সঞ্চয় পত্রে জমাদান আকর্ষণীয় করার জন্য অন্তত উৎসে করকর্তন বন্ধ করা যেতে পারে।
বাজেটে যে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার পরিবর্তে উপেক্ষিত থেকে যায়, তা হল গত দু’যুগ আগে যারা অবসরে গিয়েছেন তাদের অপ্রতুল পেনশন প্রদান। এখন যাদের বয়স ৮০ বছরের ঊর্দ্ধে তারা স্বল্প পেনশন পেয়ে অবসরে গিয়েছেন। সচিবের তখন বেতন ছিল ১০,০০০/- (দশ হাজার) টাকা। বিভিন্ন গ্রেডে ৫০% পেনশন সমর্পণ করার পর অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী স্বল্প টাকা পেনশন পেয়েছে। এরপর কিছু বৃদ্ধি করা হলেও বর্তমানে প্রাপ্ত টাকা অতি নগণ্য। অনেকে কষ্টে জীবন যাপন করছে, অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তাদের বিষয়টি পরীক্ষা করে যথাযথভাবে পেনশন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আবার যারা ১৫-২০ বছর আগে ১০০% পেনশন সমর্পণ করে এককালীন টাকা নিয়েছেন তাদের অবস্থা নাজুক। সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করে পুন: আর্থিক সুবিধা দেয়া প্রয়োজন। বাজেটে এবিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করলে অসহায় অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ কিছুটা স্বস্তি পাবে ।
আশা করা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয় সুপারিশগুলো যথাযথভাবে পরীক্ষা করে বাজেটে প্রয়োজনীয় প্রস্তাব অর্ন্তভুক্ত করবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা