‘মিয়ানমারে যৌন লালসা থেকে রেহাই পায়নি ৬ বছরের শিশুও’
‘৬ বছরের শিশুও রেহাই পায়নি মিয়ানমারের সামরিক জান্তার যৌন লালসা থেকে। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য-যা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের জন্যে হৃদয় ভেঙ্গে যাবার নামাবলী। আর এমন পরিস্থিতির অবতারণা হয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে। ভিকটিমদের দোষ একটাই, তা হচ্ছে-তারা রোহিঙ্গা।’
জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের এক মুক্ত আলোচনায় এমন তথ্য উপস্থাপন করেন ‘নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা’ বিষয়ক এনজিও ওয়ার্কিং গ্রুপের পক্ষে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি রাজিয়া সুলতানা ।
‘আমি তেমন একটি স্থান থেকে এখানে এসেছি, যেখানে নারী-শিশু কেউই গণধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বর্বরোচিত আচরণের পাশাপাশি হত্যা এবং নির্যাতন চালাচ্ছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী’-উল্লেখ করেন রাজিয়া সুলতানা।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে ১৬ এপ্রিল সোমবার ‘নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার মাধ্যমে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ (Preventing Sexual Violence in Conflict through Empowerment, Gender Equality and Access to Justice)’ শীর্ষক এ মুক্ত আলোচনায় সুলতানা নিরাপত্তা পরিষদসহ জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের সাথে সরাসরি কথা বলতে। ‘তাহলে মানবতা বিপর্যয়ের লোমহর্ষক ঘটনাবলির অনেক কিছুই তারা জানতে পারবেন’-উল্লেখ করে রাজিয়া বলেন, ‘গত আগস্ট থেকে ৬ লাখ ৭০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা প্রাণ-সম্ভ্রম বাঁচাতে ভিটে-মাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। রোয়ান্ডা গণহত্যার পর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কেউ দেখেনি। অথচ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি। বলা যেতে পারে যে, নিরাপত্তা পরিষদ আমাদেরকে হতাশ করেছে। ২০১২ সালের সতর্কতাকে জাতিসংঘ যদি কঠোর দৃষ্টিতে গ্রহণ করতো, তাহলে হয়তো এমন বর্বরতার ভিকটিম হতে হতো না।’
নিজের অনুসন্ধান-গবেষণার মধ্য দিয়ে রাখাইন প্রদেশের ১৭ গ্রামের ৩০০ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে নিশ্চিত রাজিয়া বলেন, ‘সরকারি বাহিনী এহেন বর্বরতা চালিয়েছে। ধর্ষণ করেছে, ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করেছে অনেক নারীকে।’
রাজিয়া বলেন, ‘কমপক্ষে ৩৫০টি গ্রামে হামলা করে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী’। ‘কালক্ষেপন না করে মিয়ানমার পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সোপর্দ করা উচিত’-দাবি রাজিয়া সুলতানার।
জাতিসংঘের উপ-মহাসচিব আমিনা মোহাম্মদ (Deputy Secretary-General Amina Mohammed ) এবং ‘সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যৌন সহিংসতা’ বিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেন (and Pramila Patten, Special Representative of the Secretary-General on Sexual Violence in Conflict) ও বক্তব্য রাখেন।
উল্লেখ্য, এ মাসেই নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে যাবে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনসহ বিস্তারিত জানতে। সে আলোকে এ মুক্ত আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম বলে অনেকে মনে করছেন।
উপ-মহাসচিব আমিনা মোহাম্মদ বলেন, এ বছর মিয়ানমারসহ বহু দেশেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে। আর এর ভিকটিম হচ্ছেন নারী-শিশু এবং অসহায় জনগোষ্ঠি। নীতি-নৈতিকতা ভুলুন্ঠিত হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর লোকেরাও বর্বরতায় লিপ্ত হচ্ছেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এহেন নৃশংসতায় বহু মানুষকে গৃহত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। এর চেয়ে নিষ্ঠুর আচরণ আর কী হতে পারে। এমন যৌন সহিংসতা এবং দাঙ্গা রোধে আসুন সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করি। বিরাট জনগোষ্ঠির সকলের নিরাপত্তা জরুরী। এভাবে মানবতা অটুট রাখা সম্ভব নয়।
প্রমিলা প্যাটেন বলেন, ‘এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাস্তবে যা ঘটছে, তার চিত্র নথিতে পাচ্ছি না। এজন্যে সরেজমিনে গিয়ে ভিকটিমদের সাথে কথা বলা জরুরি। এহেন পরিস্থিতির অবসান তথা রোহিঙ্গাদের সসম্মানে নিজের বসতভিটায় ফিরতে কার্যকর একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রমিলা ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘শত শত শিশু-নারীকে অপহরণ করে দিনের পর দিন ধর্ষণ করছে বকোহারাম অথবা আইএসআইএল’র সন্ত্রাসীরা। আজ অবধি একজনকে আদালতে সোপর্দ করা সম্ভব হয়নি। আমরা শুধু কথা বলছি, সমালোচনা করছি, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না’।
যনি হামলার শিকার নারী-পুরুষের করুণ কাহিনীর অবতারণা করে বাংলাদেশের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক মো: আরিফুল ইসলাম এ সময় বলেন, ‘সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে যদি সংশ্লিষ্ট দেশ এগিয়ে না আসে তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকেই দায়িত্ব নিতে হবে’।
নিরাপত্তা পরিষদের চলতি এপ্রিল মাসের সভাপতি পেরু আয়োজিত এ আলোচনায় নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য রাষ্ট্রসহ ৭০টি দেশের প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধি রাজিয়া সুলতানাকে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, “আমরা ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে ‘নারী শান্তি ও নিরাপত্তা’ বিষয়ক মুক্ত বিতর্কে অংশে নিয়ে এই পরিষদে রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের কথা বলার সুযোগ দানের বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। আজ সুলতানা রোহিঙ্গাদের পক্ষে বক্তব্য দিলেন। এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেনকে ধন্যবাদ জানাই”।
নিরাপত্তা পরিষদে সুলতানার বক্তব্য বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আশ্রিত প্রায় ৭ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যার বেশিরভাগই নারী ও শিশু, তাদের মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে মর্মে উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি মন্তব্য করেন।
উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি তার বক্তব্যে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী যৌন সহিংসতার শিকার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নারীদের যাদের একটি বড় অংশ গর্ভবতী, তাদের কথা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অনান্য শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের কথা উল্লেখ করেন।
নির্যাতিত এসকল নারী ও মেয়েরা যাতে তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে বিষয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ এবং সেবাদানকারীদের ভূমিকার প্রশংসা করেন।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি আরও বলেন, অতিরিক্ত সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত না হলে এ জাতীয় ঘৃণিত ঘটনা বন্ধ হবে না এবং মর্যাদাসহ নিরাপদে ও নিরাপত্তার সাথে নিজ ভূমিতে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন কোন আশার আলো দেখবে না।
বাংলাদেশে আশ্রিত সহিংসতার শিকার এসকল রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েদের জন্য বাংলাদেশ সরকার সকল পক্ষের সাথে পরামর্শ করে একটি জাতীয় কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে মর্মে তিনি জানান।
সংঘাত সংশ্লিষ্ট যৌন সহিংসতার উপর মহাসচিবের রিপোর্টের সুপারিশমালাকে ভিত্তি ধরে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী ‘সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যৌন সহিংসতা’র বিষয়ে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশের প্রতিনিধি।