বৃহস্পতিবার, ৮ই মার্চ, ২০১৮ ইং ২৪শে ফাল্গুন, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

খুনি যখন নিঃশ্বাসের দূরত্বে

চাপাতি ছুরি নিয়ে খুনিরা স্যারের নিঃশ্বাস ছোঁয়া দূরত্বে চলে এসেছে এবং খানিকক্ষণ ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে! সারাক্ষণ জীবনের হুমকিতে থাকা জাফর স্যারের এত কাছে যখন খুনিরা অবস্থান নিতে পেরেছে তখন নিশ্চিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকারের সকল বাহিনী এবং স্যারের ছাত্ররা তার সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। এই জাতিটাই জাতির সম্পদ রক্ষায় ব্যর্থতা দেখিয়ে ধর্মান্ধদের বাম্পার ফলনে খুব কার্যকর।’

এভাবেই ফেসবুকে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের এক কলকাতা প্রবাসী ভক্ত সঞ্জয় মল্লিক।

তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের ছবিতে দেখা যায়, হামলাকারী যুবক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের একেবারে নিঃশ্বাস ছোঁয়া দূরত্বে অবস্থান করছে। এতো আইন শৃঙ্খলাবাহিনী থাকার পরও কীভাবে এই যুবক মঞ্চে উঠল তা সঞ্জয় মল্লিক নামের এই ভক্তের প্রশ্ন।

তিনি মনে করেন,‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকারের সকল বাহিনী এবং স্যারের ছাত্ররা তার সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।’

প্রসঙ্গত, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছুরিকাহত বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ (সিওমেক) হাসপাতালে থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় আনা হয়েছে।

শনিবার বিকেল ৫টা ৩৫মিনিটে সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চ এলাকায় শিক্ষক জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। মুক্তমঞ্চে বসে থাকা অবস্থায় পেছন থেকে তার মাথায় আঘাত করেন সেই যুবক।

আহত ড. জাফর ইকবাল শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. দেবপদ রায়।

তিনি বলেন, ‘আমি ওটি’র ভিতরে ছিলাম। স্টিল নাও হি ইজ আন্ডার এনেস্থেশিয়া। ৬-৭ জন প্রফেসর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা অপারেশন করেছেন। ওনার কন্ডিশন খারাপ না, শঙ্কামুক্ত।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের একটি উৎসব ছিল। সেই উৎসবে অংশ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে মুক্তমঞ্চে বসে ছিলেন মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। বিকেল ৫টা ৩৫মিনিটের এক যুবক হঠাৎ পেছন থেকে তার মাথায় ছুরিকাঘাত করেন। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে পুলিশের একই মাইক্রোবাসে করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে ঢাকা সিএমএইচ-এ উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।

এদিকে, হামলাকারী ওই যুবককে আটক করে গণপিটুনি দিয়েছেন উপস্থিত শিক্ষার্থীরা। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলাকারীকে এই হামলার পরপরই আটক করা হয়। তাকে বর্তমানে সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার এলাকায় শুক্রবার ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠান চলছিল। শুক্রবার বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে এর উদ্বোধন করেছিলেন ড. জাফর ইকবাল। শনিবার বিকালে এর সমাপনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চ এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক মো. রাশেদ তালুকদার জানিয়েছেন, মুক্তমঞ্চ এলাকায় পেছন থেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ড. জাফর ইকবলের মাথায় আঘাত করা হয়। তবে সঙ্গে সঙ্গে হামলাকারীকে আটক করা হয়।

ড. জাফর ইকবালের ব্যক্তিগত সহকারী জয়নাল আবেদীন জানান, স্যারকে মাথায় আঘাত করা হয়। এ মুহূর্তে তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে (সিএইমএইচ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ওসমানি মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, উনার মাথায় চারটি আঘাত করা হয়েছে। এগুলো রডের আঘাত বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া তার বাঁ হাত ও পিঠে ছুরিকাঘাতের জখম রয়েছে। জাফর ইকবালের শরীরে ২৫ থেকে ২৬টি সেলাই পড়েছে। তবে উনি শঙ্কামুক্ত।

রাত পৌনে ১০টার দিকে ওসমানি মেডিকেল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে জাফর ইকবালকে সিলেট বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। সেখান থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় আনা হয়।

রাত ১২টায় জাফর ইকবালকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জাফর ইকবালকে ঢাকায় আনা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এহতেশামুল হক দুলালও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

এদিকে, সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আবদুল ওহাব জানিয়েছেন, ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়। হামলাকারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আটক করে।

জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন বলেন, একজনকে আটক করা হয়েছে। তার নাম ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল নামের ওই তরুণ পরিবারের সঙ্গে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ায় থাকেন।

কী কারণে ওই তরুণ জাফর ইকবালের উপর হামলা করেছেন, সে বিষয়ে কিছু তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন জাফর ইকবাল। র‌্যাগিংয়ের দায়ে পাঁচ ছাত্রের শাস্তি দেওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, এদের শাস্তির পরিমাণ কম হয়েছে, তাদের পুলিশে দেওয়া উচিৎ।

আবার এর পেছনে জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে বলেও সন্দেহ রয়েছে কোনো কোনো শিক্ষার্থীর। জাফর ইকবাল বরাবরই জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ফেস্টিভাল চলছিল ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জাফর ইকবাল।

প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছুরি নিয়ে এক তরুণ বিচারকের আসনে বসে থাকা জাফর ইকবালকে পেছন থেকে হামলা করে। হামলার পরপরই হামলাকারীকে ধরে পিটুনি দেয় শিক্ষার্থীরা। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন পুলিশ-র‌্যাব কর্মকর্তারা।

ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল নামের ওই শিক্ষার্থী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন।

এদিকে হামলাকারীর এক মামাকে আটক করেছে পুলিশ।

শনিবার গভীর রাতে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়া থেকে ফজলুর রহমানকে আটক করা হয় বলে জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, শেখপাড়ায় হামলাকারী ফয়জুর রহমান ওরফে ফজলুর বাসা ও আশপাশের এলাকায় অভিযান চালানো হয়। ফজলুর আত্মীয়-স্বজন আর কাউকে পাওয়া যায়নি। তার মামা ফজলুরকে পেয়ে আটক করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email